২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তোমার আমার গল্প

-

জীবনে কখনো পরী দেখিনি। কিন্তু মিমিকে দেখলে প্রতিবার মনে হয় আমি যেন জলজ্যান্ত এক পরী দেখছি। আমার দেখা পৃথিবীতে একমাত্র আপাদমস্তক সুন্দরীর নামÑ মিমি। মহল্লার কাজী বাড়ির মেয়ে সে। এই মহল্লার একটাও যুবক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে মিমিকে ফুল আর প্রেমপত্র পাঠায়নি।
সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মিমিকে অন্যদের মতো ফুল আর প্রেমপত্র পাঠাব না। এক পৃথিবী আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরা সাহস নিয়ে বলব, ‘আই লাভ ইউ’।
বিকেলের সোনা রোদঝরা এই বিশেষ দিনে আমি এখন মিমির সামনে দাঁড়িয়ে। ওর চিকচিক করা রূপের বালুচরে আমি যেন এখনই তলিয়ে যাবো। আমি শিওর পৃথিবীর কোনো বিউটিশিয়ান মেকআপের বদলৌতে মিমির মতো সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিমি আমাকে দেখছে।
Ñতুমি কি আমাকে কিছু বলবে রঞ্জু?
Ñবলব?
Ñবলো।
Ñরাগ করবে?
Ñনা। বলো।
Ñআ আ আই লাভ ইউ।
Ñহা হা হা।
মিমি হাসছে। আশ্চর্য, এত সুন্দর হাসি আমি জীবনে আগে কভু দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ছোটবেলায় অন্যদের অনেকবার বলাবলি করতে শুনেছিÑ ‘তোর হাসিটা লাখ টাকার।’ তখন জানতাম না লাখ টাকার হাসি বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে। আজ এই প্রথম বুঝলাম মিমিদের মতো যাদের হাসি এত ঝুরঝুরে সুন্দর, তাদের হাসিই লাখ টাকার হাসি।
Ñশোনো রঞ্জু, এই পাড়ার সব পোলাপান আমার জন্য ফুল আর চিঠিতে প্রেমের আহ্বান করে। সাহস করে কেউ কখনো সামনে আসে না। তুমি এসেছ দেখে তোমার সাহসের তারিফ করা লাগে।
Ñসত্যি?
Ñহ্যাঁ। শোনো, তুমি খারাপ ছেলে নও। শিক্ষিত ছেলে, লম্বা অনেক, বেশ ভদ্র। কিন্তু সমস্যা একটাই...
Ñকী?
Ñতোমার গায়ের রঙ কালো। আরেকটু ফর্সা হলে তোমাকে মন দিতে একটুও বিলম্ব করব না।
Ñএখন তাহলে কি করণীয়?
Ñযেভাবে পারো, ফর্সা হয়ে আমার সামনে আসো। মনে ঠাঁই পাবে। কথা দিলাম।
মিমি হিল জুতায় ঠকঠক শব্দ তুলে চলে গেল। আমার জন্য রেখে গেল প্রস্তাবিত সাধনা। আমার ফর্সা হওয়ার সাধনা। আজ থেকে এই সাধনায় অবতীর্ণ হতেই হবে।

২.
বাজারের কোনো কসমেটিকস দোকান আমি আর বাকি রাখিনি। হন্য হয়ে খুঁজতে লাগলাম রঙ ফর্সাকারী ক্রিম। কোনো বিক্রেতাই আশানুরূপ ক্রিম বের করতে পারেনি। মিমি ভুল বলেনি, যতবার আয়নার সামনে দাঁড়াই, ততবার নিজের কালো কুচকুচে মুখখানা দেখে মনে মনে বলি, ‘যেভাবে হোক, ফর্সা হয়েই মিমির সামনে দাঁড়াবই।’
ডাক্তার কামালকে মনে পড়ল। শুনেছি বাজারের এই ডাক্তারের চিকিৎসা নাকি খুবই বিখ্যাত। সমস্যা যতই হোক, তিনি নুয়ে পড়া রোগীকে মেডিসিনের দ্বারা খাড়া করে পেলেন। হ্যাঁ, আমাকে ডাক্তার কামালের কাছে যেতে হবে।
সুদর্শন যে মানুষটার সামনে আমি এখন বসে আছি, ইনিই ডাক্তার কামাল। বয়স ৪৫ পেরিয়ে। এখনো বিয়ে করেননি। পেশায় ডাক্তার এবং দেখতে নায়কখচিত হওয়ার পরও বিয়ে করেননি কেন, কে জানে! হয়তো বয়সকালে ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছেন।
Ñআপনার সমস্যা কী?
Ñআমার সেভাবে জটিল কোনো সমস্যা নেই। স্লিপে কিছু রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের নাম লিখে দিলেই হবে।
Ñমানে?
Ñমানে আমি সুন্দর হতে চাই। দেখেন না আমার মুখখান কালো কুচকুচে।
Ñএটা ডাক্তারখানা। তামাশার জায়গা নয়। আপনি মেয়ে মানুষ নাকি যে রূপচর্চার জন্য ক্রিম ব্যবহার করবেন!
Ñইয়ে মানে...
Ñএখান থেকে ভাগেন। ভাগেন বলছি। আমি ত্বক বিশেষজ্ঞ নই, গাইনি ডাক্তার।
অনেকটা অপমান হয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। ডাক্তারের কথায় আমি খানিক নার্ভাস হলাম। কিন্তু আমাকে এভাবে নার্ভাস হলে চলবে না। মিমির সামনে দাঁড়াতে আমাকে ফর্সা হতেই হবে।

৩.
ওহাব ভাইকে মনে পড়ল। মহল্লার বড় ভাই। তিনি আগে কালা নিগ্রো ছিলেন। এখন মোটামুটি ফর্সা। রহস্য কী! ওহাব ভাইয়ের কাছে যেতে হবে।
ঘটনার বর্ণনা শোনে ওহাব ভাই বললেন, ‘তোমার ভাগ্য ভালো। মিমি তোমাকে মন পাওয়ার একটি শর্ত দিয়েছে। অনেক ছেলেকে তাও দেয় না। তারেক, তন্ময়, আহাদ, মাসুম, রবিন সবাই যখন প্রথম মিমিকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠায়, সব ক’টাকে ডেকে এনে গালে কষে চড় মেরেছে। যা হোক, ফর্সা হতে হলে তুমি আমার মতো মধু খাও। বাজারে এখন ভালো মানের মধু পাওয়া যায়। আমি রোজ খাই। গায়ের রঙ আগের থেকে কিছুটা উজ্জ্বল।’
ওহাব ভাইয়ের টিপস অনুযায়ী শুরু হলো আমার মধু ভক্ষণ পালা। বাজার থেকে মোটা দরে মধুর বৈয়াম কিনে আনি আর রোজ তিনবেলা করে খাই। রাতে ঘুমানোর আগে খেয়ে বিছানায় যাই, আর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ঠোঁটের চার পাশে পিঁপড়ার জয়জয়কার। আমার ঘুমের ঘোরে ওরা মিঠা মধুর গন্ধ পেয়ে কিভাবে যে আমার ঠোঁটের চার পাশে হানা দেয়, টেরই পাই না। সমস্যা নেই, পিঁপড়া আসে আসুক। তবুও আমার ফর্সা হওয়ার চাই।
কিন্তু বোতলে বোতলে মধু শেষ হয়, আমি ফর্সা হই না। না জানি কত লিটার মধু খেলে ত্বক ফর্সা হবে। একদিন সকালে যথারীতি মধু খাওয়ার পর মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। আব্বা আর আমার ভাই মঞ্জু চেঁচামেচি করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এলো। ডাক্তার পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘রোগীর শরীরে প্রচুর পরিমাণে সুগার জমে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। রোগী মনে হয় মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খায়!’ জ্ঞান ফেরার পর এই সংবাদ শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল।
ডাক্তার ভুল বলেননি। মিষ্টি, মানে মধু আমি বেশিই খাই। ফর্সা হতে। ফর্সা হইনি। ফর্সা হতে গিয়ে ডায়াবেটিস হবে, কে জানত!

৪.
আজ তিন দিন আমি হাসপাতালের বেডে চিকিৎসাধীন। ডাক্তারের বিশেষ সেবা চলছে। সর্বনাশা মধু আমাকে ফর্সার বদলে ডায়াবেটিস রোগী বানাল। আহারে কিসমত।
সকাল সাড়ে ১০টায় হাসপাতালে এক অপূর্ব রূপবতীর আগমন। রূপবতীকে চেনাচেনা লাগছে। কে যেন! আরে, এত মিমি। মিমি আমার শিয়রে এসে বসল। তার হাতে ফুলের বিশাল এক তোড়া।
Ñকাল ওহাব ভাই আমাকে সব বলেছে রঞ্জু।
Ñকী বলেছে?
Ñতুমি আমার শর্ত পূরণে ফর্সা হতে মধু খেয়ে আজ ডায়াবেটিসের কবলে। এ জন্য আমি দায়ী। তুমি আমায় ক্ষমা করো।
Ñনা না মিমি। ঠিক আছে।
Ñতোমাকে আর মধু খেতে হবে না গো! ফর্সা হওয়ার দরকার নেই। তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো বলেই তো আমার শর্ত পূরণে যা যা করার, তা তা করতে গিয়ে শরীরে ডায়াবেটিস বয়ে আনলে। আমি তোমাকে ভালোবাসি রঞ্জু। আই লাভ ইউ...
Ñসত্যি?
Ñসত্যি। তুমি কালো সমস্যা নেই। কালা যে গলার মালা, জানো না?
সত্যি সত্যি আজ আমি মিমির গলার মালা হবো, ভাবিনি। হাসপাতালকে চিরকাল আমার ভয়ানক জায়গা মনে হয়। আজ মনে হচ্ছে এটা কোনো ভয়ানক জায়গা নয়, একটি প্রেমনগর। এই প্রেমনগরে মিমি শুধুই আমার।


আরো সংবাদ



premium cement