দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা
- জোবায়ের রাজু
- ১১ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
কামাল ভাইকে দেখলে আজকাল আমার ভয় লাগে। অতি সাধারণ ভয় নয়, একেবারে গা কাঁপাকাঁপি টাইপের ভয়। ভয়ের প্রধান কারণ হলোÑ দেনা। কামাল ভাইয়ের খাবারের হোটেলের বাকি খাতায় আমার নামে হাজার পাঁচেক টাকার মতো বাকি। এই দীর্ঘ পয়সা বাকি রাখার অপরাধে কামাল ভাই প্রায়ই কল করে গরম গরম কথা শুনিয়ে ভয় লাগিয়ে দেন। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি কামাল ভাইয়ের কল রিসিভ করি না। কামাল ভাই ছাড়াও বাজারের আরো বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী আমার কাছে টাকা পাবেন; কিন্তু কেউ কামাল ভাইয়ের মতো টাকা উদ্ধারে এত ক্ষ্যাপা নয়। তাই বাজারে গেলে আমি সাধারণত কামাল ভাইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে গোপনে দ্রুতপায়ে পালিয়ে বেড়াই। কিন্তু এভাবে আর কত!
ঘড়ির কাঁটায় এখন সকাল সাড়ে ৮টা। আমি বন্ধু তারেকের বাড়ি যাচ্ছি হাজার পাঁচেক টাকা ধারের আশায়। তারেক দিলদরদী মানুষ। মন বলছে, টাকা পাবোই। তারেক না করবে না। হয়তো বুকেও টেনে নিয়ে বলবেÑ ‘টাকা লাগলে নিবি, ধার কেন! টাকা বড় না বন্ধুত্ব বড়! কইগো বউ, চায়ের ব্যবস্থা করো। আমার বন্ধু আসছে।’
এসব ভাবতে ভাবতে পকেটের মোবাইলখানা বেজে উঠল। বের করে স্ক্রিনে যার নাম দেখলাম, বুকটা কেঁপে উঠল। কামাল ভাই ফোন করেছে।
Ñ হ্যা হ্যা হ্যালো।
Ñ তোতলাবি না হালা। টাকা দে!
Ñ কামাল ভাই, আমি ঢাকায়। হাসপাতালে।
Ñ হালা, আমার টাকা না দিয়ে হাসপাতালে কী করছিস?
Ñ আমার কলেরা।
Ñ আমার ডায়রিয়া। চিকিৎসার টাকা নেই। টাকা দে।
আমি লাইন কেটে দিলাম। মুড নষ্ট হচ্ছে। এই নষ্ট মুড নিয়ে তারেকের সামনে স্বাভাবিক হতে পারব না। কামাল ভাইয়ের আবারো ফোন। না, রিসিভ করে বাকি মুড নষ্ট করার দরকার নেই। মোবাইলখানা বন্ধ করে দিলাম।
এই তো আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলে তারেকের বাড়ি পৌঁছে যাবো। হঠাৎ সামনে যাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠি, তিনি কামাল ভাই। চলতি পথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে, কে জানত!
Ñ কিরে, তুই না হাসপাতালে ঢাকায়? তোর না কলেরা?
Ñ ইয়ে মানে...। আপনার না ডায়রিয়া?
Ñ রাখ আমার ডায়রিয়া। হালা মিথ্যুক, দেনা দেয়ার ভয়ে মিথ্যে বললি! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!
আমি ধরেই নিয়েছি কামাল আমাকে হালকা-পাতলা কিছু কথা শুনিয়ে প্রস্থান করবেন। কিন্তু এভাবে যে কিলঘুষি মেরে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটাবেন, কে জানত! হ্যাঁ, কামাল ভাই আমার পেটে-পিঠে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি মারতে মারতে...। একটা সিএনজি আসছে।
Ñ আজ তোকে ওই সিএনজির চাকার তলে ধাক্কা মেরে আকাশে পাঠিয়ে দেবো।
Ñ না কামাল ভাই। অন্তত এ কাজটি করবেন না।
ভাগ্য ভালো। কামাল ভাই দয়া করলেন। সিএনজি গা-ঘেঁষে চলে গেল। চাকার তলে ধাক্কা দেননি। শেষ কিলটি মেরে বললেনÑ ‘তিন দিনের মধ্যে টাকা না দিলে তোর ঘরে আগুন দিমু।’
২.
কামাল ভাইয়ের কিলঘুষি খেয়ে সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে। ব্যথা নিরাময়ের জন্য আসলাম ওহাব চাচার ফার্মেসিতে। ওহাব চাচা আমার বাবার বন্ধু। এই বাজারে তার নামকরা বিশাল ফার্মেসি। ফার্মেসির নাম ‘তন্ময় ফার্মেসি’। তন্ময় ওহাব চাচার বড় ছেলে।
Ñ কিভাবে ব্যথা পেলে তুমি?
Ñ গাছ থেকে পড়লাম চাচা।
Ñ ইস।
আসল ঘটনা লুকিয়ে ফেললাম। দেনা টাকার জন্য কেউ আমাকে মেরেছে, এটা শরমের কথা। ওহাব চাচা কিছু ব্যথানাশক বড়ি দিলেন। মূল্য পরিশোধ করে তার ফার্মেসি থেকে বের হয়ে আসছি, এমন সময় ওহাব চাচা ডাকলেন।
Ñ তুমি মিথ্যে বলছো কেন?
Ñ কী মিথ্যে?
Ñ পথে দেখলাম এক লোক তোমাকে মারছে।
Ñ না চাচা। ভুল দেখেছেন।
Ñ ভুল নয়। তুমি যখন ডিসুম ডিসুম মার খাচ্ছিলে, সে সময় একটি সিএনজি তোমাদের সামনে দিয়ে গেছে, মনে আছে? আমি সে সিএনজিতে ছিলাম। সব দেখেছি।
Ñ ইয়ে মানে...
ওহাব চাচার কাছে ঘটনা অস্বীকার করে আর লাভ নেই। যা দেখার তিনি দেখে গেছেন। এতক্ষণ ব্যথায় গা টনটন করছে, এবার মিথ্যে বলে ওহাব চাচার কাছে ধরা পড়ে লজ্জায় মরছি। গায়ের ব্যথা আর চোখের লজ্জাÑ দুটো মিলে আমার এখন বেহাল দশা।