২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ব্যাচেলর লাইফের ইতিবৃত্ত

-

দরজার ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল বদরুলের। এই ভোরবেলায় বুয়া ছাড়া এহেন বিরক্তিকর কাজ আর কেউই করবে না। বাইরে হইচই হলেও বাসার ভেতরে সুনসান নীরবতা। আধো ঘুমে চোখ মেলে তাকায় বদরুল। রুমে অন্যদের ঘুমে দেখে মুখের ওপর কাঁথা দিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত বদরুল। ব্যাচেলর লাইফের এটি একটি রোগ। সকালে ঘুম ভাঙলে অন্যদের ঘুমাতে দেখলে নিজেকে আরো ঘুমানোর চেষ্টা করার মতো ভালো কাজ আর কিছু হতে পারে না। বুয়া অনবরত দরজা ঠকঠক করেই যাচ্ছেন। সবার কানে আওয়াজ গেলেও কেউ আরামের ঘুম হারাম করে দরজা খোলার মতো দুঃসাহস কারো নেই। বদরুল হাতড়ে লুঙ্গি খুঁজতে লাগল। সে ঘুমালে লুঙ্গি হারিয়ে যায়। এটা শুধু বদরুলের না, তার অন্য রুমমেটদেরও এমন হয়। একবার তো বদরুল লুঙ্গি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কোনো রকম কাঁথা দিয়ে পেঁচিয়ে লুঙ্গি খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে লুঙ্গি পেল আমগাছের মাথার ওপর।
যা হোক, কোনো রকম লুঙ্গিটা নিয়ে পুরো চোখ না খুলে দরজা খুলতে গেল বদরুল। ব্যাচেলর সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে। গভীর ঘুম আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় কোনোক্রমেই যদি জেগে যায়, তবে পুরো চোখ খোলা যাবে না। এতে করে ঘুমের তি হবে। দরজা খোলা মাত্রই বুয়া গরম। পান চিবাতে চিবাতে বলতে লাগল, মামা এ রকম প্রত্যিকদিন দরজার সামনে দাঁড়াইয়া থাকতি পারুম না। আপনেরা নতুন বুয়া দেহেন। আমার কাজের অভাব অইবো না।
বদরুল চুপ করে শুনে থাকে। প্রতিটি বুয়া একই ধরনের প্রলাপ বকে। যা হোক, বুয়া হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। বুয়া একে একে লিস্টগুলো বলতে লাগল। মাছবাজারে দাঁড়িয়ে আছে বদরুল। ব্যাচেলরদের জাতীয় মাছ তেলাপিয়া কিনতে দামাদামি করছে। এক কেজিতে সর্বাধিক কয়টা ধরে সেটি হিসাব করছে বদরুল। মাছ কেনা শেষে একটা ব্রয়লার মুরগি নিয়ে হাজির। বুয়া বাজার দেখে বেশ খুশি হলো। ছোট মাছ বুয়াদের শত্রু। এ মাছ আনলে সেদিন রান্না বন্ধ রাখার হুমকিও দিয়ে থাকে।
খিদায় পেট চোঁ চোঁ করছে। আলুর গোল্লা আর মসুরডাল দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে শুয়ে আছে বদরুল। এ দিকে একজন ঘুম থেকে উঠে চেঁচামেচি লাগিয়ে দিলো। তার জন্য আলুর গোল্লা না রেখে সবাই খেয়ে ফেলছে। এহেন কর্ম কে করেছে তা বের করা মহামুশকিল। কিছুণ চিল্লাপাল্লা করে থেমে যেতেই হয়। বুয়া রান্না শেষে যাওয়ার সময় শাড়ির ভেতর একটা পোঁটলা দেখা গেল। বদরুল এসে জিজ্ঞেস করল, খালা এখানে কী নিলেন?
বুয়া শাড়ি দিয়ে পোঁটলাটি ঢেকে বললÑ কই মামা, কিছু না।
এই যে কী যেন ঢেকে দিলেন।
আরে কিছু না।
বদরুল নাছোড়বান্দা। সে বুয়াকে কিছুতেই ছাড়তে রাজি না। অতঃপর বুয়া পোঁটলা খুলতে বাধ্য হলো। পোঁটলার ভেতর পেঁয়াজ, আলু, রসুন আর মুরগির কলিজা। মেসে বুয়ারা রান্না করলে বেশির ভাগ মুরগির কলিজা হয় না। বুয়ার ভয়ে মুরগির কলিজা হজম হয়ে যায়। বুয়া কাঁদোগলায় বলতে লাগল, মামা আইজকা পরথম নিলাম আর কোনো দিন নেই নাই।
আপনেরে আমরা রাখুম না। আমরা নতুন বুয়া দেখুম।
না মামা, আমারে বাদ দিয়েন না। আমারে মাফ কইরা দেন।
যা হোক, বুয়াকে মাফ করে দেয়া হলো। বুয়া মনে হয় মনে মনে প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা করল। আজ লবণ বেশি হয়তো কাল মসলা কম হয়। এভাবেই চলতে লাগল।
বদরুল টয়লেটের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে খুব সুন্দর একটা লিস্ট আছে। টয়লেট পরিষ্কারের লিস্ট। কেউ এই লিস্টের ধার না ধারলেও এই লিস্ট হালনাগাদের দায়িত্ব বদরুলের ওপরই পড়ে। এখানে একজন আরেকজনের ওপর নির্ভর হতে হতে টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। না এভাবে আর চলা যায় না। একটু বকাঝকা করা দরকার।
বাসা থেকে বের হবে বদরুল। একটা শার্ট-প্যান্টও ধোয়া নেই। কোনো একটা জামা ময়লা হলে সেটি রেখে দিয়ে আরেকটা জামা পরে। এটি আবার ময়লা হলে আগের ময়লা জামা আরো কয়েক দিন পরে।
টিউশনিতে গিয়ে বদরুলের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। নাশতা দেয়ার কোনো লণ দেখতে পাচ্ছে না। সাহস করে ছাত্রকে জিজ্ঞেস করল, বাসায় একটু পানিও নাই?
কেন স্যার?
না মানে গলাটা একটু ভিজাতাম।
আম্মু বলছে আপনাকে আর কোনো নাশতা দেবে না।
বদরুল মনে হয় ইলেকট্রিক শক খেলো। মনের আকাশে বিষাদের ছায়া দেখতে লাগলেন।
কয়েকজন বন্ধুর সাথে নাশতা করতে ঢুকল। নাশতা করা শেষে বিল দিতে গিয়েই বাধল বিপত্তি। কে সে সাহসী লোক, যে বিল দেবে। সবাই ভাগাভাগি করে বিল দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। বদরুলের পকেট ফাঁকা। সে এই বিপদ থেকে বাঁচার ফন্দি করতে লাগল। হঠাৎ করে ফোনে কথা বলার ভঙ্গি করে বের হতে উদ্যত হলো। অমনি তার এক বন্ধু তাকে জাপটে ধরে। বদরুলের নাড়ি-নত্র সবার চেনা আছে। কিভাবে বিল না দিয়ে বের হয়ে যেতে হয়, সেটি বদরুল ভালো করে জানলেও বন্ধুরাও এত দিনে তাকে চিনে গেছে। কী আর করা, মানিব্যাগের আনাচে-কানাচে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে কিছু টাকা দিয়ে পার পেল।
বাসায় এসে টেবিলের সামনে বসে আছে। আজ পড়তে হবে। অনেক দিন পড়াশোনা হয় না। প্রতিদিন প্ল্যান করা হয় কাল থেকে পড়া হবে; কিন্তু কাল আর আসে না। পড়তে বসলে নানা চিন্তা মাথায় আসে। না না আজ পড়তেই হবে। বই খুলল বদরুল। প্রেমিকা ফোন দিলো তাকে। কথা বলতে বলতে পড়ার কথা ভুলে গেল সে। এ কথা গভীর রাত পর্যন্ত চলতে লাগল। তার ফিসফাস শুনতে শুনতে আশপাশে সবাই বেশ বিরক্ত। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বদরুল কথা বলেই চলছে। অমনি এক রুমমেট বিরক্ত হয়ে এসে বলল, বাসার বাইরে গিয়া কথা কও। নাইলে মাইর দিমু।
কী আর করা, বদরুল বাসার বাইরেই চলে গেল।


আরো সংবাদ



premium cement