২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

একটি মেস বৃত্তান্ত!

-

অপুদের মেসের বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর হাসিবুল হাসান। ইতঃপূর্বে তিনি সাধারণ বোর্ডার হয়ে ছিলেন। সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ পদটি পেয়েছেন। এতে তিনি খুশি না হলেও বড় অঙ্কের টাকার গাঁটরি নিয়ে সমস্ত মাস অতিক্রম করতে পারেন বলে নতুন বউয়ের কাছে খুব সচ্ছল ব্যক্তি বলে পরিচিত। বাড়ি থেকে বিলম্ব করে টাকা নিলেও কিংবা অফিসের বেতন দেরিতে পেলেও কোনো প্রবলেম ফেস করতে হয় না। কেননা, তিনি যথাসময়ে মালিককে বাসার ভাড়া দিতে অভ্যস্ত নন। তার ধারণাÑ ‘মাত্র ১৩০০০ টাকা ভাড়া দিয়ে মালিকের কিচ্ছু হবে না। না হয় আমরা ক’জন ফ্রি-ই থাকি।’
কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। মাসের যখন ৫ তারিখ ওভার হয়ে যায়, তখন মালিক একটা স্লিপ নিয়ে হাসিব সাহেবের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কখনই যথাসময়ে নাগাল পায় না। হাসিব সাহেব বাসায় ফেরে প্রায় ১২টার দিকে আবার কোনো দিন ফেরে না। ততণে মালিকের ঘুম অর্ধেক হয়েই যায়। তবে তিনি ১০টার দিকে এসে একবার টহল দেবেন, তার সিউরিটি হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
‘কী খবর অপু সাহেব, হাসিব মিঞার দেখা নাই যে?’
অপু সাহেব একজন ব্যস্ত লোক। একটা কোম্পানিতে গো-খাটা খেটে যাচ্ছে। ভালো বেতনও পায়। বাসার দায়িত্বে তিনি যেন থেকেও নেই।
‘হাসিব ভাই তো, শ্বশুরবাড়ি গেছে।’
হাসিব সাহেব কয়েক মাস আগে প্রেম করে মিরপুরে একটি বিয়ে করেছেন। কিন্তু এখনো ঘরসংসার সাজানো হয়নি। মেসে তার মন বসে না। অফিস শেষে তাই শ্বশুরবাড়ি ছুটে যায়। তাই মালিক রিপ্লাই করে, ‘হাসিব সাহেব বিরহের দিনগুলোই কি মেসে কাটায়? বাসার দায়িত্ব না নিতে পারলে ছেড়ে দিন। আমি অন্যদের ভাড়া দেবো।’
ক্রুদ্ধ মেজাজে মালিক এসব বলতে বলতে স্লিপটা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে যায়। অপু স্লিপটা নিয়ে হাসিব সাহেবের ড্রয়ারে সযতেœ রেখে দেয়।
এ মেসের সিনিয়র সভাপতি হিসেবে মান্য করা হয় জিল্লুর পাটোয়ারীকে। তার বয়স নায়ক সাকিব খানের চেয়ে সামান্য বেশিই বলে তিনি দাবি করে আসছেন মেসে পা রাখা থেকে। দুটো পুত্রও রয়েছে। তাদের ছেড়ে ২৩ বছর ধরে বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে ঢাকায় থেকে কোম্পানির চাকরি করে বেড়ান; কিন্তু কোনো দিন প্রমোশন পান না, আবার চাকরিও ছুটে যায় না। এত অফিস ফাঁকি দিলে আবার প্রমোশন! সকালে ঘুম থেকে উঠে সিগারেট ধরিয়ে সবাইকে ডেকে তুলবে আর বলবে, ‘কী হইছে?’
অথচ মেসে কিছুই হয়নি। তারপর চিরাচরিত কথাটি তিনি অকপটে বলবেন, ‘বাজারে তো ইলিশ বেশ সস্তা। কার বাজার? আজ রাতে সর্ষে-ইলিশ হবে।’
এ লোকটা রোগাটে। নাড়িও চিকন। পেটে ভাত খুব একটা লোড করতে পারে না। কিন্তু সকাল-দুপুর কী খেলাম না খেলাম তা দেখার নেই, তবে রাতের বেলা ইলিশ অথবা পাকিস্তানি মুরগি চাই! বুয়া বিকেলে রান্না করে যায়, সেগুলো রেখে তিনি নতুন রান্না চড়ায় আর সাল্লু খানের হিন্দিগান ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে অপো করে, কখন গ্যাসের স্পিড বাড়বে আর কমপ্লিটলি সুস্বাদু রান্না হবে।
মেসের আরেক সদস্য বিখ্যাত বরিশালের ইমরান হোসেন। মেসের বিষয়ে তার কোনো বোধোদয় নেই। তার হাতে সময় কম। তিনি এক অফিস করতে করতে দুই দিন লাগিয়ে ফেলে। বুঝলেন না তো বিষয়টি। যদি তিনি রোববার বিকেল ৫টায় ডিউটি শুরু করেন, তবে বাসায় ফেরেন সোমবার রাত ৩টায়। বিমানবন্দরে চাকরি বলে কথা! সকালে সবাই যখন অফিস ছোটে, তিনি তখন ভোরের স্বপ্ন দেখেনÑ ‘জিম করে করে বডিটা ফিটই রয়েছে।’
ছুটির দিন ছাড়া তার সাথে মেসের অন্যদের মিট হওয়া বড়ই কষ্টকর। তবে মেসের হিসাব-নিকাশের সাথে সাথে সব পাওনা পরিশোধ করে দেয়। হিসাব শেষে হাসিব সাহেব সবাইকে জানায়, কার কত বিল হয়েছে। ইমরান সাহেব সাথে সাথে তা দিয়ে দেয়। টাকার পরিমাণ যদি ৩০২১ টাকাও হয়, তবুও তিনি এক টাকাও কম দেন না। হাসিব সাহেব এ বিষয়ে ছাড় দেয়ার বান্দা নন, এটা সবাই বুঝে গেছে। কিন্তু হাসিব সাহেবের লেনদেন এখনো বুঝে ওঠেননি নতুন বোর্ডার মুস্তাফিজ সাহেব।
এ লোকটা দারুণ কিপটে ও চাপাবাজ। আজ একজনকে বলে ঢাবির ছাত্রীকে বিয়ে করেছি, কাল আরেকজনকে বলে জবির ছাত্রীকে বিয়ে করেছি। অথচ তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৯ বছর লাগিয়ে ইভিনিং শিফটে বিএসসি করেছেন। কাজ করেন টাওয়ারের মেকানিক্যাল পোস্টে আর ছড়িয়ে বেড়ান, ‘আমি চিফ ইঞ্জিরিয়ার।’
এমন চাপাবাজের বিষয়ে মেসে কারো কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ একটাইÑ তিনি মেসের সবাইকে তুমি করে বলে বেড়ান। তার ভাষ্য, ‘এ মেসের আমি সহসভাপতি আর জিল্লুর ভাই সিনিয়র সভাপতি।’
তুমি করে ডাকতেই অপু সাহেব প্তি হয়ে যান।
‘ওর থেকে আমি শিাগত যোগ্যতা, চাকরির পদ-পদবি ও অভিজ্ঞতায় বড়, আর ও কি না তুমি বলে। হাসিব ভাই, সামনের মাসে কান ধরে ওকে বের করে দিন না!’
হাসিব সাহেব অপু সাহেবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘যাক গা, আর কয় দিনই বা মেসে আছি। আমি তো বিয়ে করেছি। শ্বশুরের নতুন বিল্ডিং উঠলেই চলে যাবো। মিরপুরে ১০ কাঠা জমি কিনেছে আমার শ্বশুর। আর আপনি বিয়ে করলে তো নতুন বাসা নিচ্ছেনই।’
হাসিব সাহেবের ভূত-ভবিষ্যৎ গেইজ করে ইউটিউব দেখতে দেখতে মনে মনে অপু সাহেব বলেন, ‘আপনার আর মেস ছাড়া হইছে। আজ থেকে পাঁচ বছর ধরে কমন ডায়লগটা শুনে আসছি।’
ছয় সদস্যবিশিষ্ট মেসে আরেকজন বোর্ডারের কথা এ প্রসঙ্গে না আনলেই নয়। তিনি নামে শিমুল হলেও দেখতে মাকাল ফলের মতোই। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিচ্ছু মানে না, হেঁটে হেঁটে অফিসে যায়। একটি টাকাও খরচ করতে রাজি না। মেসে তো কোনো খাবার খায় না; বরং কাউকে কোনো দিন এক কাপ চাও খাওয়ায়নি। অফিসে সকালের নাশতা ও রাতে ওভারটাইমের নাশতা খেয়েই দিনটা কাটে। ভাত আর মুখে তোলে না। রাতে যখন ুধা লাগে, তখন দুটো পেঁয়াজ কেটে মাথায় লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। যখনই রান্নাঘর থেকে পেঁয়াজ নেয়, তখন সভাপতি জিল্লুর ধরে বসে। মনে সন্দেহ হয়।
এ রকম খামখেয়ালিপনা ও ছয় কিসিমের সদস্য নিয়ে মেসটি আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। ইদানীং বিবাহ ব্যাচেলরের আধিক্যের কারণে মেসটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু আসল সমস্যা হলো, বিবাহিত তিনজন বাসাবাড়িতে বউ তুলছেন না আর অবিবাহিত তিনজন বিয়ের কোনো পরিকল্পনাই করছেন না। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল