শ্বশুরবাড়ি
- জোবায়ের রাজু
- ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
তুলি আর আমি যখন কোর্টম্যারেজ করি, ভীষণ ভয়ে ছিলাম। আমার ফ্যামিলি এই বিয়ে মেনে না নেয় কি না! মেনে না নিলে তো মহাসর্বনাশ। আমার মতো স্বল্পশিক্ষিত আর অল্প মেধাবী ছেলে যে তুলিকে নিয়ে পথে বসতে হবে, মনের ভেতর এই নিয়ে এক ধরনের গোপন ভয় পুষে রাখতে রাখতে দিন কাটানোর এক শুভবিকেলে আম্মা বললেন, ‘বউ নিয়ে আয়। তোর বাবার আদেশ।’
পরদিন তুলিকে নিয়ে আব্বা-আম্মার সামনে হাজির। ভয়ে তুলির সারা শরীর কাঁপছিল। ঘরের বউয়ের মিষ্টিমুখ দেখে আব্বা-আম্মা দু’জনেই সন্তুষ্ট। তুলিও অল্প দিনে শ্বশুর-শাশুড়ির মন জয় করে নেয়।
রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে তুলি। প্রথমে ভেবেছি অভিমানের বরফ গললে তুলির বাবা-মা এ বিয়ে মেনে নেবেন। কিন্তু বিয়ের এক বছর পার হওয়ার পরও তুলির বাবা-মা কোনো শুভ সঙ্কেত দেননি বলে তুলির এক গোপন দুঃখ বুকে জমা হতে থাকে।
২.
ভরদুপুর। আমার মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করতেই অচেনা পুরুষ কণ্ঠÑ ‘আমি একটু তুলিকে চাই।’
তুলির স্টাডি লাইফের ছেলেবন্ধুরা প্রায়ই কল করে তুলির খবর নেয়। সে রকম কেউ একজন ভেবে তুলিকে ফোন এগিয়ে দিলাম। তুলি কথা বলে যখন ওপারের মানুষটির পরিচয় জানল, হাউমাউ করে কেঁদে বললÑ ‘আব্বু, তুমি ফোন করেছ! বিশ্বাস হচ্ছে না আব্বু...।’
আলহামদুলিল্লাহ। বরফ গলেছে। আমার শ্বশুর কল করেছেন। তুলি কানের কাছে মোবাইল ধরে অঘোরে কাঁদছে। বড় বেদনার দৃশ্য হলেও সে দৃশ্য আমার কাছে অপূর্ব লাগতে শুরু করল। আমাদের বিয়ের পর তুলিকে এই প্রথম কাঁদতে দেখেছি। আশ্চর্য, কাঁদলে কোনো মেয়েকে এত সুন্দর লাগে, আগে জানতাম না।
৩.
ধীরে ধীরে আমার অভিমানী শাশুড়িরও রাগ ভাঙতে থাকে। মেয়ের কাছে রোজ কল করা তার স্বভাবে পরিণত হতে সময় লাগেনি। সময়ের সাথে সাথে তুলি বাবার বাড়ি যাওয়ারও সুযোগ পায়। আমার শাশুড়ি নাকি প্রায়ই মেয়েকে বলেন, ‘তোকে দেখতে মন চাইছেরে মা।’ ব্যস, মেয়ে ব্যাকুল হয়ে মায়ের কাছে ছুটে যায়।
তবে ওই বাড়িতে যাওয়ার পারমিশন আমি এখনো পাইনি। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে এখনো ডাকেননি। না ডাকার কারণও আছে। এমনিতে আমি তাদের মেয়েকে গোপনে বিয়ে করে তাদের বংশে কিছুটা চুনকালি মেখে ইজ্জত নষ্ট করেছি। ফলে আমার প্রতি তাদের রাগ থাকাই স্বাভাবিক। তবে আমি নিশ্চিত, এই রাগের বরফও অচিরেই গলে যাবে।
৪.
দুপুরবেলায় আমার ফোনে আননোন নাম্বারের কল।
Ñ হ্যালো।
Ñ তুমি কি রঞ্জু?
Ñ জি। আপনি?
Ñ আমি তোমার শাশুড়ি।
Ñ হোয়াট?
Ñ হ্যাঁ বাবা। তুমি কি বিকেলে একটু আমাদের বাড়িতে আসবে?
Ñ অবশ্যই।
বাসায় এসে তুলিকে ঘটনা জানাতেই সে বলল, ‘আম্মা আমাকেও সকালে বলেছেন তোমাকে ওখানে যেতে।’
যাক বাবা, শাশুড়ি আম্মা এত দিনে জামাই বাবুর মুখ দর্শন করবেন। এ আনন্দ রাখি কোথায়!
বিকেলবেলায় চললাম শ্বশুরবাড়ি। দামি পাঞ্জাবি পরে পারফিউমের কড়া গন্ধ মেখে শ্বশুরবাড়ি রওনা দিলাম। খালি হাতে নয়, বাজার থেকে ১০ কেজি মিষ্টি কেনার টাকা আব্বা আমার হাতে ভরে দিলেন। পুত্র প্রথম তার শ্বশুরালয়ে যাবে বলে কথা।
৫.
শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ দেখে তো আমি মুগ্ধ। এত বিশাল বাড়িতে চোখ ধাঁধানো প্রাসাদ। এত দিন জানতাম তুলিরা লাখপতি, এখন দেখছি তারা কোটিপতি। বাপরে বাপ!
আমাকে দেখে শাশুড়ি আম্মার যতখানি খুশি হওয়ার কথা, ততখানি খুশি হলেন বলে আমার মনে হলো না। আমার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সোজা ফ্রিজে ভরে বললেন, ‘সোফায় গিয়ে বসো বাবা।’
‘বাবা’Ñ আহা কী মধুর কথা! শুনে আমি সোফায় গিয়ে বসি। মিনিট পাঁচেক পর শাশুড়ি আমার পাশে এসে সোফায় বসলেন। দুনিয়ার গল্পের আসর অল্পতেই জমাতে পারার যোগ্যতা দেখালেন তিনি।
গল্প বলার শেষ পর্যায়ে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন উঠোনের পাশের আমতলায়, যেখানে আমগাছের সাথে বাঁধা দু’টি বড় বড় ছাগল। ওমা! এরা ছাগলও পালে!
Ñ একটা কথা বলি বাবা? কিছু মনে করবে?
Ñ কী?
Ñ এই যে ছাগল দু’টি দেখছো না?
Ñ দেখছি।
Ñএগুলো তুলির বাবা কিনেছেন।
Ñ আচ্ছা।
Ñ আর পাঁচ দিন পর আমার নাতির আকিকা। ওরা শহরে থাকে। আমার ছেলে ওহাব পাঁচ দিন পর ওদেরকে শহর থেকে নিয়ে আসবে।
Ñ ওহ।
Ñ তুলির বাবা কম দামে ছাগল দু’টি পেয়ে আগেভাগে কিনেছেন।
Ñ বাহ।
Ñ এখন অসুবিধে একটাই।
Ñ কী?
Ñ এগুলোকে লালনপালনের ব্যবস্থা। তুমি পাঁচটা দিন এখানে থাকো। ছাগলগুলোকে লালনপালন করবে। মাঠে চরাবে। ঘাস খাওয়াবে। পারবে না?
Ñ ইয়ে মানে...।
Ñ তুলির বাবা এগুলো নিয়ে বিপদে আছেন। তুলি বলেছে, তুমি নাকি পশুপাখি ভালোবাস। তাই তোমাকে নিজ থেকে আমি এ দায়িত্ব পালনের জন্য ডেকেছি।
হায় খোদা, এ কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি! শাশুড়ি ফোন করে ডেকেছেন। শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবারের মতো এসে শুনি আমাকে ছাগল চরাতে হবে। তাও আবার পাঁচ দিন।
Ñ কী বাবা, পারবে না ছাগল চরাতে?
Ñ ইয়ে মানে...পা পা পারব।
Ñ ধন্যবাদ। আমার বিশ্বাস ছিল তুমি না করবে না। আসো, তোমাকে সারা বাড়ি একটু দেখাই।
শাশুড়ি আমাকে উত্তর দিকের ডালিমগাছটার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার পিছু পিছু হাঁটছি। পেছন থেকে ছাগলগুলো ডাকছে, ম্যাঁ ম্যাঁ ম্যাঁ...। মনে মনে বলি, ‘চিল্লাস না, তোদের আমাকে চরাতে হবে আগে জানলে শ্বশুরবাড়ি গোষ্ঠী কিলাতাম।’
জামাই শ্বশুরবাড়িতে প্রথম এসেছে ছাগল চরাতে, এটা বোধহয় নতুন ইতিহাস।