নিঝুম সন্ধ্যায়
- জোবায়ের রাজু
- ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
হক সাহেবরা সপরিবারে শহর ছেড়ে গ্রামে স্থায়ী হয়েছেন কয়েক দিন আগে। পৈতৃক ভিটায় তিনি ঘরও করেছেন বড়সড় আকারে। গ্রামে আসতে না আসতে আমার আব্বার সাথে হক সাহেবের দারুণ ভাব জমে উঠল। আব্বার অমায়িক ব্যবহার আর বন্ধুসুলভ আচরণ হক সাহেবকে এতটাই টানল যে, তিনি রোজ বিকেলে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন আব্বার সাথে খোশগল্প করতে। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়লেই হক সাহেব আয়েশি ভাব নিয়ে আমাদের বাসায় আসেন আর ড্রয়িংরুমের নরম সোফায় পরমানন্দে বসে আব্বার সাথে গল্প জুড়ে দেন। সেসব গল্পে হক সাহেব হয়ে ওঠেন এক অনবদ্য চরিত্র। তিনি পরোপকারী, তার দানের হাত দীর্ঘ, জীবনে কখনো ঘুষ খাননি, চুরি ডাকাতি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন, লোভ নেই, যেখানে বিশ টাকা ভাড়া সেখানে চালককে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেনÑ হক সাহেবের এসব বয়ান আব্বা প্রতিদিন ভালোই গিলছেন। রোজ বিকেলে আমাদের বাসায় এসে হক সাহেব ঘুরে ফিরে একই কথা বারবার বলে নিজের ঢোল অনেকটা নিজেই পেটান। এসব গল্পে মুখর হতে হতে আব্বা মাঝে মধ্যে আমাকে ডাকেনÑ ‘ও রঞ্জু, এদিকে আয়। হক সাহেবের মতো হতে চেষ্টা কর। তুই তো বান্দর।’
আব্বার অনুরোধ রক্ষার্থে আমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি। হক সাহেব আমাকে বলেন, ‘বুঝলে খোকা, জীবন সহজ নয়। জীবনকে সহজ করে নিতে হয়। কারো ক্ষতি করবে না। চুরি লোভ লালসা থেকে দূরে থাকবে।’
কথা বলার এক ফাঁকে আমাদের কাজের মেয়ে রোজ চা নিয়ে আসেন হক সাহেব আর আব্বার জন্য। চা এলে হক সাহেব ধোঁয়া ছড়ানো চায়ের কাপের দিকে যেভাবে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে থাকেন, দেখে মনে হয় তিনি জীবনে কখনো চা দেখেননি এবং রোজ আমাদের এখানে এই চাটুকুর লোভেই আসেন।
মাঝে মধ্যে হক সাহেবকে আমার চাপাবাজও মনে হয়। তিনি এমন সব কথা বলেন, যেগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। একদিন বললেন, ‘আমার অফিসের বস অকারণে দশ লাখ টাকার চেক লিখে দিয়েছিলেন, আমি তা গ্রহণ করিনি। বিনা কারণে এতগুলো টাকা গ্রহণ করার পক্ষে ছিলাম না।’
কথাটা আমার বিশ্বাস হলো না। যে মানুষ রোজ এক কাপ চায়ের লোভে এখানে এসে এমন বকবক করেন, সে মানুষ কিনা দশ লাখ টাকা পেয়েও নেননি!
সেদিনের পর থেকে হক সাহেব প্রায়ই কথায় কথায় ওই দশ লাখের প্রসঙ্গ তুললে আব্বা তাজ্জব ভঙ্গিমায় বলেন, ‘এত টাকা! আমি হলে তো খুশিতে জ্ঞান হারাতাম।’
হক সাহেব বিজ্ঞের মতো বলেন, ‘লোভ লালসা খুব খারাপ জিনিস ভাইজান।’
গতকাল বিকেলে আমাদের ড্রয়িংরুমে আব্বা আর হক সাহেব গল্প করছেন। পাশের ঘর থেকে আমি কান পেতে হক সাহেবের কথা শুনি। তিনি রসমাখা গলায় বলছেন, ‘গত বছর কি ঘটেছে শুনবেন? এলিফ্যান্ট রোডে দিনদুপুরে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি রাস্তার ম্যানহোলের এক কোণে মাঝারি আকৃতির একটি ব্যাগ পড়ে আছে। ব্যাগ খুলে দেখি মোটা মোটা টাকার বান্ডিল।’
আব্বা লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘আহা, এটাকেই বলে চাঁন কপাল। কত টাকা ছিল হক সাহেব?’
হক সাহেব নরম সুরে বললেন, ‘তা জানি না। টাকাগুলো নিয়ে সোজা থানায় গিয়ে পুলিশের হাতে দিয়ে দিলাম। যা করার, ওরাই করবে। আমার ওতো লোভটোভ নেই বাবা!’
হক সাহেব এটা জলজ্যান্ত চাপা মেরেছেন। এটা আমি শিওর। দিনদুপুরে এত টাকা পেয়েও পুলিশের হাতে দিয়ে এসেছেন! হক সাহেবকে একদিন পরীক্ষা করতে হবে। কিভাবে পরীক্ষা করব, একটা বুদ্ধি খাটিয়ে বের করা দরকার।
২.
বুদ্ধি পেয়ে গেছি। এই পড়ন্ত বিকেলে হক সাহেব এসেছেন। সন্ধ্যার আগে তিনি যেহেতু চলে যান, সে সময়ে আমাদের বাড়ির গেটের সামনে আমার পুরনো মানিব্যাগটা, যেটা এখন আর ব্যবহার করি না, সেটা ফেলে রাখব। তারপর আড়াল থেকে দেখব তিনি নিঝুম সন্ধ্যায় মানিব্যাগ পেয়ে লোভ কতটুকু কাটিয়ে উঠতে পারেন। সিদ্ধান্তানুসারে পুরনো মানিব্যাগটা গেটের সামনে রেখে এলাম।
আব্বার সাথে গল্প গুজব করে রোজদিনের মতো চা খেতে খেতে এখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হক সাহেব আজকের মতো চলে যাচ্ছেন। ঘর থেকে হক সাহেবকে বিদায় দিয়ে আব্বা দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি সোজা চলে গেলাম ছাদে। রেলিংয়ের কাছে এসে দেখি হক সাহেব মানিব্যাগের সামনে দাঁড়িয়ে চার পাশের দিকে তাকাচ্ছেন। আমি ছাদ থেকে সে দৃশ্য অবলোকন করছি।
তারপর দেখলাম হক সাহেব মাটি থেকে মানিব্যাগটা তুলে একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে মানিব্যাগ পকেটে ভরে দ্রুত গেট পেরিয়ে চলে গেলেন।
সিঁড়ি দিয়ে আমি নামছি আর মনে মনে বলছি, ‘হক সাহেব, লোভ লালসা থেকে বিরত থাকার বয়ান সবসময় অন্যকে দেন, এই নিঝুম সন্ধ্যায় প্রমাণ পেলাম আপনি কতটুকু লোভী।’ হ