বই এবং চোরের গল্প
- জোবায়ের রাজু
- ৩০ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
এই পনের বছরের জীবনে রকির যে জিনিসটি কখনোই ভালো লাগেনি, তা হলো লেখাপড়া। লেখাপড়ার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই বললেই চলে। মা তাকে রোজ জোর করে স্কুলে পাঠান। বাবা যে প্রাইভেট স্যারকে বাড়িতে নিয়োগ করেছেন, রোজ বিকেলে সে প্রাইভেট স্যার বাড়িতে পড়াতে এলে রকি ছলে বলে কৌশলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সবার চোখের আড়াল হয়ে যায়। এ কারণে রাগে-ক্ষোভে স্যার এ বাড়িতে আর রকিকে পড়াতে আসবেন না বলে টিউশনিটা ছেড়ে দেন।
বিদ্যার্জনে রকির অনীহা দেখে বাবা-মা বেশ ক্ষুব্ধ ছেলের ওপর। চীনাবেত দিয়ে গরুপিটুনি দেয়ার পরও রকিকে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করা যায়নি। ফলে কাসের প্রতি পরীক্ষায় রকি খাতায় ঘোড়ার ডিম পেয়ে প্রতিবার স্কুলজুড়ে ইতিহাস রচনা করে।
টেলিভিশনের প্রতি দারুণ ঝোঁক থাকলেও বইয়ের প্রতি কোনো টান নেই রকির। তার প্রায়ই ইচ্ছে হয় সব বইখাতা ছিঁড়ে কেটে কুচি কুচি করে চুলোয় দিতে। কিন্তু বাবার ভয়ে এ কাজ থেকে রকি আপাতত দূরে আছে।
সন্ধ্যারাত হলো রকির সবচেয়ে খারাপ সময়। এ সময়ে মা তাকে কান টেনে ধরে এনে পড়ার টেবিলে বসিয়ে বই সামনে দিয়ে বলেন, ‘পড়। রাত ১০টা পর্যন্ত পড়বি।’
মায়ের কথা আমলে নেয় না রকি। ফলে তাকে ঘুমের ভান করতে হয়। ঘুমে টলে পড়ছে দেখে মা পিঠে কয়েকটি গুড়–ম গুড়–ম কিল বসিয়ে দিয়ে বলেন, ‘যা, ঘুমা গিয়ে ইতর।’ ব্যস, বই রেখে বিছানায় গা হেলিয়ে দেয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ পেয়ে যায় সে।
২.
আজ শনিবার। আগামী বৃহস্পতিবার রকির বার্ষিক পরীক্ষা। চিন্তায় সে অস্থির হয়ে আছে। কারণ বাবা বলেছেন এবার পরীক্ষায় খারাপ করলে বাবা তার হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে পিঠে পিঁপড়ার বাসা বেঁধে দেবেন। কল্পনায় সে যতবার এ দৃশ্য অনুভব করেছে, ততবার তার পিঠে যেন পিঁপড়ার কামড়ের ব্যথা লেগেছে।
এখন রাত ১টা। চোখে ঘুম নেই রকির। ডিম লাইটের নিয়ন আলোয় হঠাৎ ঘরে কারো অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছে রকি। মশারি উল্টিয়ে দেখে কে যেন ঘরে ঢুকে ভীরু পায়ে সারাঘর পায়চারী করছে। রকি বুঝতে পেরেছে এ আর কেউ নয়, হারামজাদা চোর। চোর ঢুকেছে ঘরে।
ডিম লাইটের আবছা আলোয় চোরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এ চোরকে সে চেনে। পাশের পাড়ার আমজাদ ভাই। বিখ্যাত চোর হিসেবে আমজাদ ভাইয়ের বদনাম আছে পাড়াজুড়ে।
রকি দেখতে পাচ্ছে আমজাদ ভাই বিশাল এক বস্তায় ঘরের মালামাল ভরছে। চিৎকার দিতে গিয়ে রকির মনে হলো চিৎকার দেয়া ঠিক হবে না। আমজাদ ভাই যদি চুরি করা মালামাল বস্তায় ভরার সময় তার টেবিলের সবগুলো বই বস্তায় ভরে নিয়ে যায়, তবে সে বাঁচবে এবং পরীক্ষা দেয়ার দায় থেকে রক্ষা পাবে। বই পুস্তক চুরি হয়েছে, এই অজুহাত দেখাতে পারবে।
আমজাদ ভাই ঘরের দামি দামি জিনিসগুলো বস্তায় ভরছে দেখে রকি মনে মনে বলেÑ ‘দয়া করে আমার বইগুলো বস্তায় ভরুন।’ কিন্তু বইয়ের দিকে আমজাদ ভাইয়ের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
দরজা খোলা দেখা যাচ্ছে। বাবা বোধ হয় আজ ভুল করে দরজা আটকাতে ভুলে গেছেন আর এই সুযোগে আমজাদ ভাই অপারেশন চালাচ্ছে। ঘরের দামী জিনিসগুলো বস্তায় ভরে আমজাদ ভাই যখন সেই বস্তা কাঁধে নিয়ে বের হবে, এমন সময়ে রকি নিচু গলায় বলল, ‘আমজাদ ভাই, কাউকে কিচ্ছু বলবো না। আপনার পায়ে পড়ি, আমার বইগুলো নিয়ে যান।’ কেউ ঘটনা টের পেয়েছে, এটা অনুভব করে আমজাদ ভাই যখন দ্রুত প্রস্থান করতে যাবে, রকি তখন মশারি উল্টিয়ে আমজাদ ভাইয়ের সামনে এসে বাধা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আমি সব দেখেছি ভাই, কাউকে কিছু বলব না। আপনি আমার বইগুলো নিয়ে যান।’ বলেই রকি টেবিল থেকে তার সমস্ত বই খাতা এনে জোর করে আমজাদ ভাইয়ের ব্যাগে ভরিয়ে দিয়ে বলল, ‘যান, এবার চলে যান।’ আমজাদ ভাই ঘটনার আগা-মাথা বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইল। নিচু গলায় রকি বলল, ‘আহা যান না, দ্রুত যান।’
আমজাদ ভাই বেকুবের মাতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর যেতে যেতে নিচু গলায় বলল, ‘এই ঘটনা কেউ জানলে তোকে কেটে কেটে টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।’ রকি বলল, ‘ কেউ জানবে না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। যান তো!’ আমজাদ ভাই বিশাল বস্তা কাঁধে নিয়ে নখ টিপে টিপে চলে গেল। রকি মনে মনে বলল, ‘যাক বই চোরে নিয়ে গেছে, এবার আমি পরীক্ষার পড়া থেকে মুক্ত। ধন্যবাদ আমজাদ ভাই।’ হ