এটা কোনো দোষ হতে পারে না
- মুহাম্মদ কামাল হোসেন
- ০৯ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
লাইজুকে পেঁয়াজু অফার করা নিশ্চয়ই কোনো দোষের কিছু নয়। না, এটা অন্তত আর যা-ই হোক কোনো দোষের কিছু হতে পারে না। ভদ্রতা ও সৌজন্যতার খাতিরে এটা যে-কাউকে অফার করা যেতেই পারে। কিন্তু তবু দোষ হলো এবং বেচারা বন্ধু শিহাবের নামের পাশে একটা টাটকা ডিমেরিটস পয়েন্টও যুক্ত হলো। ইদানীং বেশ ভালোই জমে উঠেছে আমাদের আড্ডা, মৌজমাস্তি ও রঙতামাশা। আমরা কয়েক বন্ধু জড়ো হলেই আর রে নেই, দ্রুত চার মাথা একত্র করে ফেলি। যদিও কয়েক দিন থেকে চার মাথার সাথে আরো একটি মাথা জোগাড় হয়েছে। শিহাব এসে যোগ দিয়েছে আমাদের মাঝে। অবশ্য হঠাৎ হঠাৎ ওর কী জানি হয়, কাউকে কিছু না বলে অদ্ভুতভাবে টুপ করে ডুব দেয়ার বাতিক রয়েছে তার। আবার মাস কয়েক পরে আমাদের মাঝে হঠাৎ এসে উদয় হয়। এটা ঠিক যে, পারিবারিকভাবে ওকে নানা ধরনের ঝামেলা ও অন্তহীন সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। খুব মেধাবী ছেলে শিহাব। চাকরিটা হবে হচ্ছে করেও কেন জানি হচ্ছে না। বিয়েটাও ঝুলে আছে। তবু সব ধরনের সমস্যা ও গ্লানিকে আড়াল করে অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী শিহাব সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে যায়। সময়মতো আড্ডায় এসে যোগ দেয়। আমাদের আড্ডা শুরু হওয়ার পর কানাকানি, ঘুসুর ঘুসুর, ফুসুর ফুসুর চলতেই থাকে। ননস্টপ কথার ফুলঝুরি! যদিও কয়েক দিন থেকে ল করেছি, শিহাব একটু অন্যমনস্ক। মজার বিষয় হচ্ছে, আড্ডার বিষয়বস্তুতে কোনো নির্দিষ্টতা নেই। ওই একটা হলেই হলো। রাজনীতি হোক বা সমাজনীতি কিংবা অন্য যেকোনো বিষয়। বিষয়বস্তু খুব একটা ফ্যাক্টর না। একবার শুরু হলে আর শেষ হওয়ার জো নেই। আড্ডার স্থান-কাল ও পাত্রেরও কোনো বালাই নেই। এক মাথা দিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হলে ক্রমশ ডালপালা মেলে বিস্তৃত হয়ে কয়েক শ’ মাথায় গিয়ে শেষ হয়। অধিকাংশ সময়ই আলোচনা অসমাপ্ত রেখে আমাদেরকে বাক্সপেঁটরা গুটিয়ে চলে যেতে হয়। কলেজের সামনে রাস্তার বাম পাশে খুপরির মতো ছোট্ট দোকান ঘরটাতেই আজকাল আড্ডাটা দারুণ জমে ওঠে। পাশেই রয়েছে আমার প্রাচীরঘেরা সুমসাম বাসা। যদিও প্রথম দিকে আড্ডার আসরটা আমার বাসাতেই বসত। কিন্তু আমার সুন্দরী রূপসী বউয়ের জোরালো আপত্তির মুখে বাসাতে এখন আর আমাদের খুব একটা বসা হয় না। তার সোজাসাপ্টা বক্তব্য, ‘ওসব খেজুরে আলাপ আমার বাসার ত্রিসীমানার মধ্যে চলবে না। করতে হলে বাইরে গিয়ে করো। নচেত সব ক’টারে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব!’
বাপরে বাপ! ফোঁস করে ওঠা আহত বাঘিনী যেন! দেখুন কাণ্ড? অবশ্য তার জন্য আমার বন্ধু শিহাব অনেকাংশে দায়ী। পেজগিটা বাধে মূলত তাকে নিয়েই। সত্যি কথা বলতে, শিহাবের কারণে লিজার কাছে আমার অবস্থাও রীতিমতো কেরোসিন! কোনো উচ্চবাচ্য করতে পারি না। লিজা আমার বউয়ের ডাকনাম। তা ছাড়া আমার সুন্দরী বউটা আবার এসব টিপিক্যাল আড্ডাবাজি বা গসিপ একদম সহ্য করতে পারে না। ও বরাবরি কোলাহলমুক্ত পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। এ নিয়ে ওর টেম্পারেচার সবসময় একটু হট থাকে। যা হোক, সে বিষয়ে পরে আসছি। দোকানঘরটা খুব একটা খারাপ না। এখানকার গরম গরম পেঁয়াজুর সাথে পেঁয়াজকুচি খেতে দারুণ মজা! আমি অবশ্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময় থাকতে পছন্দ করি। বন্ধুদেরও ধারণা আমাকে ছাড়া নাকি কোনো আলোচনাই খুব একটা জমে না। তা ছাড়া বয়সেও আমি সামান্য একটু বড়। দিনশেষে প্রাপ্য সম্মান ও ভালোবাসাটুকু দিতেও কেউ ভুল করে না। তাই দলবেঁধে সবাই আমার কাছে ছুটে আসে। সুতরাং সঙ্গত কারণে আমি একটু এদিকওদিক বা এসপারওসপার গেলেই আর রে নেই, সোজা আমাকে গরু খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। কেউ কেউ চিরুনি অভিযান চালিয়ে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করে।
প্রথম থেকেই আমার ছোট্ট শ্যালিকার প্রতি বন্ধু শিহাবের একটা বাড়তি দুর্বলতা বেশ লণীয়। যদিও বিষয়টি আমার চোখে পড়ার আগে আমার বউ লিজার তীক্ষè দৃষ্টিকে এড়াতে পারেনি। আগেই বলেছি, প্রথম প্রথম আমার বাসায় যখন আড্ডাবাজি চলত, তখন কোনো একদিন লাইজু আমাদের বাসায় বেড়াতে আসে। ব্যস তখনি শিহাবের চোখে পড়ে যায় লাইজু। আমি বরাবরি একটু গোবেচারা ও হাবলঙ টাইপের মানুষ। এ নিয়ে বন্ধুমহল থেকে শুরু করে লিজার কাছেও প্রতিনিয়ত ঢের কথা হজম করতে হয় আমাকে। লিজাই একদিন আগুনমুখো করে চেঁচিয়ে ছুটে আসে আমার কাছে।
‘অ্যাই, তুমি এখানে বসে বসে ঝিমোচ্ছ? আর ওই দিকে আমি পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে মরছি!’
‘কেন, কী হয়েছে বউ? কোনো সমস্যা? বাসায় চোর ডাকাত পড়েছে নাকি?’
‘আলবৎ পড়েছে, আরো বড় কিছু পড়েছে! সে খবর তুমি রাখো?’
‘বলো কী! কই কই..! লাঠি ও জিন্সের প্যান্টটা জলদি বের করে দাও’
‘জিন্সের প্যান্ট..! কেন?’
‘আরে আজকাল ওসব না পরলে চোর ডাকাত ভয় পায় নাকি?’
‘আশ্চর্য! এসব আবোলতাবোল কী বলছ তুমি? আচ্ছা কবে তোমার একটু বুদ্ধিশুদ্ধি ও হুঁশ-জ্ঞান হবে, শুনি?’
‘আহারে বাপু! আমি তো বেহুঁশ নই, দিব্যি হুঁশেই রয়েছি। কী বলতে চাও, ঝটপট বলে ফেলো না?’
‘তোমার পেয়ারে বন্ধু, শিহাব কী করেছে জানো?’
‘সে কি! শিহাব আবার কী করেছে?’
‘কলেজ থেকে ফেরার পথে লাইজুকে বলে, লাইজু সোনা পেঁয়াজু খাবা?’
‘পেঁয়াজু? বাহ! পেঁয়াজু তো দারুণ জিনিস! পুষ্টিকর!’
‘পুষ্টিকর না ছাই, কচু!’
‘ও তো খারাপ কিছু বলেনি, তুমি শুধু শুধু রাগ করছ কেন?’
‘দুনিয়ার তাবৎ খাবার থাকতে লাইজুকে পেঁয়াজু অফার করা হয় কেন, শুনি? এটা যে টিজ করা, সেটা বোঝো না!’
‘আশ্চর্য! লাইজুর জন্য এখন তো দেখছি সামান্য পেঁয়াজুর নামটাও কি পাল্টে ফেলতে হবে? লিজা তুমি কী যা-তা বলছো এসব?’
‘অ্যাই শোনো, তোমাকে একটা কথা সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছি। আমার বাসায় আজকের পর থেকে কোনো বন্ধুবান্ধবের টিকিটির চিহ্ন যেন না দেখি। খবরদার, সব ক’টাকে আমি ঝেঁটিয়ে বিদায় করব বলে দিলাম, এমনকি তোমাকেও বাসাছাড়া করব! আজ থেকে বাসায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলাম।’
কথা শেষ হতে-না-হতেই লিজা রাগে গজগজ করতে করতে অন্দরমহলের দিকে চলে যায়। বাপরে বাপ কী তেজ!
ব্যস এর পর থেকে বাসার বাইরে দোকানেই বদের আড্ডাবাজি চলতে থাকে। লিজার প্রচ্ছন্ন হুমকি শোনার পর আর কোনো প্রকার রিস্ক নেয়ার সাহস আমি অন্তত পাইনি। এভাবে বেশ চলতে লাগল। কিন্তু কিছু দিন পরে আবারো টাসকি খেলাম। ডুবে ডুবে যে ওরা জল খেতে খেতে এত দূর চলে গেছে, টেরি পাইনি। কখন শিহাব আর লাইজুর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলো, কখন প্রেমের রসায়ন হলোÑ কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। একদিন শিহাব আর লাইজু সরাসরি বাসায় এসে উপস্থিত! লিজা উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাবে অমনি দেখে শিহাবের পেছনে লাইজু ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি তো রীতিমতো থ! মনে মনে জাবর কাটছি, হায়রে কেসটা কী জানি হতে চলেছে! লিজা রাগতস্বরে প্রশ্ন ছুড়ে মারে, ‘কী রে লাইজু! তুই ওই বাঁদরটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
লাইজু দ্রুত গিয়ে লিজার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বলে, ‘আপু আমরা দু’জন দু’জনকে ভীষণ ভালোবাসি। আমাদের মা করো, প্লিজ?’
লিজা রীতিমতো রাগে ফেটে পড়ে। কী বলবে কী করবে বুঝে উঠতেও পারে না। মাথাটা কেমন জানি ঘুরতে থাকে। এরই মধ্যে শিহাবও এগিয়ে এসে লিজার সামনে দাঁড়ায়। হাতে একটা লম্বা খাম। বলে, ‘আপা, লাইজু চেয়েছিল পালিয়ে বিয়ে করতে। আমি মোটেও রাজি হইনি। আমি আমার বন্ধুর কথা ভেবেছি, আপনার মানসম্মানের কথা ভেবেছি। তা ছাড়া...’
‘তা ছাড়া কী?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
‘এটা খুলে পড়ো।’
শিহাব খামটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে।
আমি খাম খুলে পড়ে পুরো তাজ্জব বনে গেলাম! ‘সে কি রে! তোর সরকারি চাকরি হয়েছে!’
আমার বউ লিজা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। সমান অবাক হয় লাইজুও। শিহাব পুরো বিষয়টি প্রথম থেকে সবার কাছে গোপন রেখেছিল। এমনকি আমার কাছেও। আমি আস্তে আস্তে বিড়াল পায়ে লিজার দিকে এগিয়ে যাই। হাত ধরে ওকে বলি,
‘তুমি আর রাগ করে থেকো না লক্ষ্মীটি। ওদেরকে মা করে দাও। আজ থেকে নিশ্চিত শিহাবের পেছনে মেয়েদের লাইন লেগে যাবে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, সেদিন লাইজুকে পেঁয়াজুর অফারটা কতটা সঠিক ছিল? আমি কিন্তু তোমাকে আগেই বলেছিলাম, বিষয়টা খুবই সামান্য ও মামুলি। এটা কোনো দোষ হতে পারে না।’
‘অ্যাই তেলবাজ! তুমি থামবে? নাকি জোর করে থামাব?’
‘সে কি! এখনো তোমার রাগ পড়েনি?’
লিজা একগাল মিটিমিটি করে মুচকি হাসে। শিহাব আর লাইজুকে চোখের ইশারায় বলে, ‘অ্যাই বাঁদরের দল, ডুবে ডুবে অনেক জল খাওয়া হয়েছে। এসো বাসার ভেতরে এসো!’