টিভি
- জোবায়ের রাজু
- ০৫ জুলাই ২০১৮, ০০:০০
তীব্র কাশির শব্দ তুলে দাদাজান যখন সারাবাড়ি কাঁপিয়ে ফেলেন, দাদীমা তখন অনুনয় সুরে বলেন, ‘আপনার পায়ে পড়ি। ডাক্তারের কাছে যান।’
স্ত্রীর কথাকে পরোয়া না করে দাদাজান জানিয়ে দেন, ‘না, পারব না। ডাক্তার সুঁই দেবে।’
সুঁই! মানে ইঞ্জেকশন। এই ইঞ্জেকশনকেও দাদাজান এই বয়সে এত ভয় পান। অবশ্য দাদাজান একটু ভীতু প্রকৃতির। ঘরের চালে পাতা পড়ার শব্দ হলে দাদাজান মনে করেন ভূতে ঢিল ছুড়েছে। পুকুরে মাছে ডিগবাজি খেয়ে পানিতে মৃদু জোয়ার তুললে দাদাজান ভাবেন জলদৈত্য ডুব দিয়েছে। বাড়ির পোষা কুকুর টমি যখন রাত দুপুরে ঘেউ করে, দাদাজান ভাবেন ডাকাতেরা দলবল নিয়ে বাড়ি এসেছে। স্বামীর এসব টুকটাক ভুল আচরণ দেখে দাদীমা তো রেগে মেগে আগুন। রোজ রাতে সে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে, যখন পাশে শোয়া মানুষটির দম ফাটানো কাশের কান ফাটানো শব্দে দাদীমার ঘুমের অবনতি ঘটে। কিন্তু ইঞ্জেকশনের ভয়ে দাদাজানের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে অনীহা দেখে দাদীমা পারেন না স্বামীকে আস্ত গিলে খেতে। আমার বিশ্বাস দাদীমার গায়ে বল-শক্তি থাকলে তিনি স্বামীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে বলতেন, ‘এমন ওষুধ দেবেন, যাতে জীবনেও আর কাশ না ধরে আমার সোয়ামিরে।’
২.
আব্বা দাদাজানের জন্য গঞ্জের এক ফার্মেসি থেকে কাশের একটি সিরাপ এনেছেন। তাই দেখে দাদীমা আব্বার জন্য দুই হাত তুলে দোয়া করলেন।
টানা তিন দিন কাশের সিরাপ সেবন করার পরও দাদাজানের কাশি দমনের কোনো লক্ষণ না দেখে আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন দাদাজানকে ভালো ডাক্তার দেখাবেন। কিন্তু ওই যে, দাদাজানের ইঞ্জেকশন ভীতি, তাকে কোনোভাবেই বোঝানো যায় না। শেষে শিশুদের মতো অনেকক্ষণ বোঝানোর পর পাথর গলল। দাদাজান ডাক্তারমুখী হতে রাজি। তবে শর্ত একটাইÑ ইঞ্জেকশন দেয়া যাবে না।
ডাক্তার তপন রায় বর্মণ দাদাজানের বিরামহীন কাশি দেখে কফ পরীক্ষার নির্দেশ দিলেন। সে দায়িত্ব পালনে আব্বা দাদাজানকে নিয়ে গেলেন কফ পরীক্ষার ল্যাবে। কফ সংগ্রহ করে পরীক্ষক জানালেন আগামীকাল এসে রিপোর্ট নিয়ে যাওয়ার জন্য।
৩.
রিপোর্টের ফাইলপত্র নিয়ে আব্বা আজ বিকেলে বাড়ি ফিরলেন মলিন মুখে। জানা গেছে কফ পরীক্ষায় দাদাজানের জটিল রোগ ধরা পড়েছে। রোগের নাম টিউবারকিউলোসিস। অর্থাৎ টিবি। মানে যক্ষ্মা।
স্বামীর টিবি রোগ হয়েছে, এই শোকে দাদীমা হতাশ। শুধু দাদীমা নন, আব্বা, আম্মা, রোজী আপা, এমনকি আমাদের খাঁচার তোতাও চুপ হয়ে গেল। আব্বা সবাইকে সান্ত্বনার বাণী শোনোলেও তার কণ্ঠ নিস্তেজ। দাদীমা কাঁদো সুরে বললেন, ‘টিবি মানে যক্ষ্মা। যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই। তোদের দাদার কিছু হয়ে গেলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচব!’
সারাবাড়িতে এক ধরনের শোকের বন্যা প্রবাহিত থাকলেও আমার ছয় বছরের ছোটবোন মিম বেশ উৎফুল্ল। তাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে।
Ñকী রে, দাদাজানের টিবি রোগ শুনে তুই কষ্ট পাসনি?
Ñনা।
Ñকেন?
Ñঅসুখটা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
Ñবলিস কী?
Ñআমাকে যে আর কষ্ট করে পাশের বাড়িতে টিভি দেখতে যেতে হবে না।
Ñটিভি?
Ñহ্যাঁ। দাদার টিভি রোগ।
ঘটনা বুঝলাম। এই ছোট্ট খুকি টিবি রোগকে টিভি ভেবে বসে আছে। হাসি পেল আমার।