আর্জেন্টিনা, টিনা এবং আফসু ভাই
- ওহাব ওহী
- ২১ জুন ২০১৮, ০০:০০
বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আফসু ভাইয়ের বরাবরই সেই রকম আগ্রহ! এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। প্রথমেই তিনি যেটি করলেন, গত শুক্রবার কাউকে না বলেই আমাদের বাঁশঝাড় থেকে ইয়া লম্বা একটি বাঁশ কেটে ফেললেন। দৃষ্টিগোচর হলেই তাকে বললাম- ও মিয়া ভাই, বাঁশ কাটলেন যে!
আফসু ভাই বিস্তর একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন, পতাকা টানামু ভাই জান! আর্জেন্টিনার পতাকা!
আর্জেন্টিনার কথা বলাতে আমার মনটাও যেন একটু নরম হলো। বললাম- আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে! ভালো করে উঁচু গাছে লাগাইয়েন কিন্তু! যেন ঝাউচর গ্রাম থেকেও দেখা যায়! তবে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়, আমাদের পুকুর পাড়ের ওই বাঁশঝাড় সংলগ্ন উঁচু তালগাছটায় লাগালে!
পরে দেরি না করে বাঁশের অগ্রভাগে পতাকা বেঁধে, ভালো মতো লুঙ্গি কাছা দিয়ে আফসু ভাই দ্রুত তাল গাছে উঠতে শুরু করলেন। কিন্তু বিপত্তি বাধলো অন্যখানে! গাছের মাঝ অবস্থানে পৌঁছাতেই বাঁশের কঞ্চির আঘাতে আফসু ভাইয়ের লুঙ্গির পেছনের অংশ ছিঁড়ে তার পশ্চাৎদেশ বেরিয়ে এলো! এতে নিচে থাকা বাচ্চা পুলাপাইনের দল খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে একে অন্যের ওপর গড়াগড়ি করতে লাগল! ওদিকে আফসু ভাইয়ের এহেন অবস্থা তখন উভয় সঙ্কটে! না পারছেন উঠতে, না পারছেন নামতে! জরুরি ভিত্তিতে ওদিকে পতাকাটাও টাঙ্গানো দরকার! তাই আমি তাকে একা একাই নির্বাচনী স্টাইলে সাহস সঞ্চার করে এগিয়ে যেতে লাগলামÑ ‘আফসু ভাই আপনি এগিয়ে চলুন, আমরা আছি গাছের নিচে!’ ‘আফসু ভাইয়ের ভয় নাই, আমরা আছি ল ভাই!’ ‘আফসু ভাইয়ের মনোবল, হয়নি কখনো রসাতল’ ইত্যাদির সেøাগানে। অন্য দিকে শক্ত একটি গাছের ডাল নিয়ে ঢলাঢলিরত পোলাপাইনের উচ্চদৃষ্টিকে আমি নিম্নদৃষ্টিতে রূপান্তর করতে হিমশিম খেতে লাগলাম! সেই সাথে কড়া লিকারে ধমকের পর ধমক দিতে দিতে বলতে লাগলাম- খবরদার! আরেকবার যদি তোরা ওই ওপরের দিকে তাকিয়েছিস তো! খবর আছে!
কিন্তু খবরের কথা বললেই কি আর খবর লওয়া যায়! এরই মধ্যে দেখি কেউ কেউ আমাকে ফাঁকি দিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে, চোখ উল্টিয়ে আফসু ভাইয়ের ওই ইয়েটাকে সপ্তাশ্চর্যের বিস্ময় ভেবে দেখার কৌতূহল মেটাচ্ছে! অবশেষে বহু কষ্টকেশে আর ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে আফসু ভাই তার প্রিয় দলের পতাকাটি সঠিক জায়গায় প্রতিস্থাপন করে নিচে নেমে এলেন। আহা! আড়ালে নিয়ে আফসু ভাই তার দুই পায়ের রানের চিপায় যেই ধকল অবস্থা আমাকে দেখালেন তা আর আপনাদের সামনে বর্ণনা করার মতো নয়!
পাঠক। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। পতাকাটি আমাদেরই তালগাছে বাঁধতে বলার অন্যতম মূল কারণ টিনা! টিনা আমারই প্রেয়সী। আমার একমাত্র ভালোবাসার আধার! যবে থেকে তার সাথে আমার পিরিতি, সেই থেকেই টিনা নামটি আর্জেন্টিনায় সংযুক্ত থাকায় এই দলকেই আমি ভালোবেসে সাপোর্ট করে আসছি। টিনাদের বাড়িটি আমাদের পাশের গ্রামেই, একটি নদী পরেই। গত মঙ্গলবার ওর সাথে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমার তুমুল ঝগড়া হয়েছে। টিনা ব্রাজিল সাপোর্টার! আমি তাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলেছি- দেখে নিও টিনা, আমার আর্জেন্টিনার পতাকাটিই থাকবে আশপাশে টাঙানো পতাকার সব চেয়ে উপরে! এমনকি তোমার ব্রাজিল পতাকাটি থেকে তো অবশ্যই! তাতে সে তেলেবেগুনে জ্বলে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তেড়ে এসে বলতে লাগল, কী বললা? আমাদের ব্রাজিল হলো সর্বকালের সর্বসেরা দল! আমার পতাকাটিই থাকবে অত্র দুই-চার গ্রামে সব
চেয়ে ওপরে এবং আমরাই হলাম এইবারের বিশ্বকাপের একমাত্র দাবিদার! পরের দিন উচ্চতা নির্ণয়ে আমি নৌকায় চলে গেলাম মাঝ নদীতে! কারণ টিনা আর আমার বাড়ির মাঝ দূরত্ব হলো মাঝনদী! হ্যাঁ, আমার পতাকাটিই উচ্চে এগিয়ে! মনে মনে আফসু ভাইকে ধন্যবাদ জানালাম! ইশরে, কী সুন্দর করে হেলেদুলে আমার আর্জেন্টাইন পতাকাটি উড়ছে,নাচছে! যেই নাচ আমার প্রেয়সী টিনাও কোনো দিন কোনো কালে দেখাতে পারেনি!
দেরি না করে টিনাকে ফোন লাগাই। ওহে টিনা, দেখো দেখো ওই যে ওড়ে আমার পতাকা আর্জেন্টিনা! একদম হগগলের উপরে! তোমার উপরে তো অবশ্যই!
টিনা তাতে েেপ গিয়ে কট্ করে ফোনটি কেটে দেয়! উপায়ন্তর না দেখে আমি তখন একা একাই তার দেয়া বিষাদমাখা বিরহচিত্তে প্যারোডি গান গাইতে শুরু করলাম- ‘এই দলে আমি আর ঐ দলে তুমি, মাঝখানে নদী এই বয়ে চলে যায়!’
অন্য দিকে শুনতে পেলাম আফসু ভাইয়ের পারিবারিক জীবনেও নাকি দমকা হাওয়ার সাথে কঠিন ঝড়োবাতাস বইছে! আফসু ভাইয়ের সেই যে পশ্চাৎদেশ সম্পর্কীয় ঘটনাটি; সেটি নাকি পুরোগ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সেই সাথে এ নিয়ে পাড়া-মহল্লার সব চায়ের দোকানে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, মতবিরোধ ও মতবিনিময় সভা! এতে কারো কারো আলোচনা এতই রসালো হয় যে, এই রোজার দিনেও লুকিয়ে চা-বিস্কুট খাওয়ারত অনেক খাদকের নাকেমুখেই নাকি হাসতে হাসতে খাদ্য উঠে যায়! এই দুঃখে বউ তার মানইজ্জত আর লাজলজ্জার ভয়ে কয়েক দিন ধরে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না! গতকাল সারা রাত কান্নাকাটি করে তিনি আফসু ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করেছেন। হুমকি দিয়ে বলেছেন, এর পরও যদি আর কোনো দিন এ রকম আকাম কুকাম করো এই সংসারে লাথি মেরে আমি বাপের বাড়ি চলে যাব! কিন্তু আমাদের আফসু ভাই কারো হুমকি-ধমকির ধার ধারেন না! বরঞ্চ পরের দিনই আণ্ডাবাচ্চা সবাইকে নিয়ে একটি ফ্যানকাব গড়ে তুললেন। ‘আর্জেন্টাইন ফ্যান কাব! কাবের সদস্য হতে হলে শর্তপ্রযোজ্যে প্রত্যেক সদস্যকেই নিজ নিজ খরচে আর্জেন্টিনার জার্সি কেনা বাধ্যতামূলক! অন্য দিকে কাবঘর প্রতিষ্ঠার ল্েয, বসতবাড়ির বিশাল উঠানের এককোণে রান্নাঘরের বেড়ার টিন খুলে বিশাল চালায় তৈরি করে ফেললেন একটি একচালা ঘর। সেখানে ২১ ইঞ্চি টিভি বসানো হবে। সাথে থাকবে সংগৃহীত চাঁদায় প্রত্যেক খেলায় গরম গরম আদা চা! আফসু ভাইয়ের এহেন বাড়াবাড়িতে ভাবী এবার সত্যি সত্যিই েেপ উঠলেন। বাজখাঁই গলায় বলতে লাগলেন, চালচুলোর মুরোদ নেই তার আবার কী শখ! তখনই স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন, আর নয় এই পোড়া সংসারে! কাল সকালেই তিনি চলে যাবেন বাপের বাড়ি!
ওদিকে সারা দিন কাজ করার ফলে পরের দিন আফসু ভাইয়ের ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হলো। কিন্তু একি! ঘরে কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন? ও মর্জিনা বিবি, কই গেলা? মর্জিনা বিবি ও মর্জিনা বিবি!
শেষে জানা গেল, বউ তার সত্যি সত্যিই এবার বাপের বাড়ি চলে গেছে। স্বহস্তে লিখিত নোটিশ টাঙিয়ে জানিয়ে গেছে, বিশ্বকাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে আর তার অকর্মা স্বামীর ঘরে ফিরবে না!
২.
চারদিকে হইচই; আনন্দ মিছিল! আর্জেন্টিনা দল বিশ্বকাপ জিতে গেছে! সেই মিছিলে আমি, আফসু ভাইসহ শত শত আর্জেন্টাইন সমর্থক টিনাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। ঢোলঢাকুর পিটিয়ে, হর্ষধ্বনিতে মেতে উঠেছে সবাই! সবাই নাচছে, গাইছে! যে যার মতো রঙ ছিটিয়ে একজন আরেকজনকে ভূত বানিয়ে দিচ্ছে! এরই মধ্যে আমি ল করি, বিষণœবদনে টিনা আমাদের মিছিলের দিকেই তাকিয়ে!
পরে আমার কিম্ভূতকিমাকার চেহারাটা চিনতে পেরে সেও দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল আর সেই সাথে হাত উঁচিয়ে ফাইয়িং কিস ছুড়ে মারতে লাগল! আমিও কার্পণ্য না করে সমানে তার প্রতিউত্তর দিতে লাগলাম! আমার এই অবস্থা দেখে হঠাৎ আফসু ভাইয়ের আনন্দঘন মুখটি যেন কেমন নি®প্রভ হয়ে গেল। পরে আমার নেতৃত্বে বিশাল রঙিলা মিছিলটি এগিয়ে চলল আফসু ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির দিকে। বাদ্যবাজনার শব্দ পেয়ে ল করি ভাবীও রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন! দেরি না করে আমরা তাকে বাহারি চুমকি মাখিয়ে, উপর্যুপরি লাল-নীল রঙে গোসল করিয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচত নাচতে অবশেষে স্বামীর গৃহে প্রত্যাবর্তন করে নিয়ে এলাম!