গেদু চাচার ঈদ শপিং
- মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
- ০৭ জুন ২০১৮, ০০:০০
বউয়ের জন্য যে বাজার করা হয়েছে তাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে তার দু’হাত, দু’কাধ ভরে গিয়েছে। আরো কিছু কেনা মানে বোঝা বাড়ানো। তাই গেদু চাচা চাচীকে রবী ঠাকুরের একটি কবিতার ক’টি লাইন শুনিয়ে দিলেন, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’
ঠোঁট দু’টি পরাজিত করে মুহূর্তেই দুই পাটি দাঁত বের হয়ে এলো। কিছুতেই ঠোঁট দু’টিকে এক করতে পারছেন না গেদু চাচা। তিনি এখন এতটাই খুশি। খুশি হবেন-ই না বা কেন? গেদু চাচার একমাত্র ছেলে পল্টুু এই মাত্র ফোন করে বলেছে, ‘বাবা, আগামীকালই মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসো। ঢাকা থেকে এবার ঈদের শপিং করে দেবো।’
গেদু চাচা মুখে কোজআপ মার্কা হাসি নিয়ে চাচীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। চাচী তো হতবাক। ‘একি! তোমার ডান চোয়ালের তিন তিনটা দাঁত পোকায় খেয়ে ফেলেছে অথচ আমাকে একটিবারও বললে না?’
‘খাইছে রে, শেষতক বউয়ের কাছে দাঁত নিয়ে অপমান হতে হলো।’ গেদু চাচার স্ফীত ঠোঁট দু’টি এবার টপ করে এক হয়ে গেল। রাত পোহালেই গেদু চাচা ঢাকার উদ্দেশে জীবনে প্রথমবারের ফুরুৎ দেবেন। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। এবার তিনি লাল-নীল বাতি দেখবেনই। আনন্দে তার ঘুম আসছে না। তিনি ডানে-বামে হাত পা ছুড়ছেন। হঠাৎ লাথিতে চাচীর কাঁচা ঘুম ভেঙে ফেলায় তিনি গেদু চাচাকে ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ‘ব্যাঙের মতো হাত পা ছুড়ছ ক্যারে? এই মধ্যরাতে তোমাকে আবার মৃগী রোগে ধরল নাকি?’
গেদু চাচা ঝিম মেরে গেলেন। তিনি জানেন, বউকে রাগালে তাকে খাটের নিচে রাত্রি যাপন করতে হবে।
সকাল হতে না হতেই গেদু চাচা শপিংয়ে রওনা দিলেন। শপিংমলে ঢোকার পথে দরজায় তিনি ঠাস করে ধাক্কা খেলেন; কিন্তু বুঝতে পারলেন না কোথায় তিনি ধাক্কাটা খেলেন। দারোয়ান এসে তাড়াতাড়ি দরজা খোলে দিয়ে বলল, ‘কাহা, এইডা অইলো গ্লাসের দরজা। দেইখ্যা ঢুকবেন না? আরেকটু অইলেই কোনো দুর্ঘটনা ঘইট্যা যাইত।’
গেদু চাচা লজ্জা পেলেন, তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেনÑ শুনেছি ঢাকায় টাকা উড়ে, অথচ এতবড় শপিংয়ের দরজায় গ্লাস আটকানো। আরে বাবা, মেহগনি, নিম কাঠ কেনার টাকা না থাকলে অন্তত রেইনট্রি কাঠ দিয়ে হলেও একখান দরজা বানাও। চোর, ডাকাত পরলে একজন দারোয়ান সামলাতে পারবে? বিড়াল দিয়ে যদি হালচাষ করা যেত তাহলে মানুষ গরু কিনতো? মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে গেদু চাচার চোখ আটকে গেল একটি ডল দেখে। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে মনে মনে বললেনÑ দেখছনি, কি সুন্দর চেহারা সুরত! ঝলমলে শাড়ি পরা, কত আদবের সাথে সবাইকে কুর্নিশ করছে। শহুরে মহিলা বলে কথা। এই মহিলার তুলনায় আমার বউ তো রাস্তার ফকিন্নির মতো। কেন যে বাবা আমাকে শহরে বিয়ে করাল না। গেদু চাচার মাথা হ্যাং মারছে দেখে চাচী তাকে পেছন থেকে চিমটি দিলেন। তিনি ডলের মোহ নিয়েই সামনে অগ্রসর হলেন। বউয়ের জন্য একখান শাড়ি পছন্দ করলেন। দোকানদার শাড়ির দাম ২০ হাজার টাকা চাওয়াতে গেদু চাচা এদিক-সেদিক তাকালেন। দাঁত কিটমিট করলেন। বউকে অন্যত্র ডেকে নিয়ে বললেন, ‘দেখ তো, এখানে কোনো বাঁশ আছে নাকি?’
চাচী আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বাঁশ দিয়ে কী করবে?’
তিনি বললেন, ‘কী করমু মানে? দোকানদারকে বাঁশ দিমু। আমাদের গফাকুঁড়ির মোড়ে এই শাড়ির দাম চাইত মাত্র পাঁচশত টাকা আর বেটা কিনা চায় ২০ হাজার টাকা!’
চাচী বললেন, ‘মাথা গরম না করে সামনে চলো।’
খানিক যাওয়ার পর চাচী আবার বললেন, ‘আমার জন্য অনেক কিছুই কিনা হলো, এবার চলো তোমাকে একখান রুমাল কিনে দেই।’
বউয়ের জন্য যে বাজার করা হয়েছে তাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে তার দু’হাত, দু’কাধ ভরে গিয়েছে। আরো কিছু কেনা মানে বোঝা বাড়ানো। তাই গেদু চাচা চাচীকে রবী ঠাকুরের একটি কবিতার ক’টি লাইন শুনিয়ে দিলেন, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’
মার্কেট থেকে বের হয়ে দেখলেন, হঠাৎ বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটু সমান পানি জমে গেছে। রাস্তার পানির স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটতে খুব মজাই লাগছে গেদু চাচার। তিনি যেন একটি নদীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন যার পানি হাঁটু সমান। মজা করে হাঁটতে গিয়ে তিনি ম্যানহুলের ফাঁক গলে নিচে পড়ে গেলেন। কিছু বোঝার আগেই তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন বিশাল এক ড্রেনের মধ্যে। এত টাকার শপিংয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তিনি দু’হাতে শপিং ব্যাগ জাপটে ধরে ভাসতে লাগলেন। ইতোমধ্যে কয়েক ঢোক পানি তার পেটে চলে গেছে। তিনি এবার জীবনের আশা জিইয়ে রাখতে দামি শপিংয়ের আশা ত্যাগ করলেন। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি শেষবারের মতো সজোরে চিৎকার করলেন, ‘ওরে পন্টুর মারে... আমারে বাঁচা...।’
কিন্তু না! কারো কোনো শব্দ তিনি শুনতে পেলেন না। অত্যধিক ভয়ে প্রাকৃতিক কাজটিও তিনি সেরে ফেললেন। জীবনের অন্তিম লগ্নে তার মনে পড়ে গেল রবী ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানের কয়েকটি কথাÑ দিনগুলি মোর সোনার খাচায় রইলো না...।
এ দিকে গেদু চাচার গোঙানির শব্দে চাচীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘাড় উঁচিয়ে গেদু চাচাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেন, ‘এই, তুমি গলাকাটা মুরগির মতো এমন দড়ফড় করছ ক্যারে?’
গেদু চাচা চোখ মেলে তাকালেন। তিনি এতক্ষণে বুঝে গেছেন, কিছুক্ষণ আগে যা দেখেছেন তার পুরোটাই মিথ্যাÑ স্বপ্ন। সত্যি শুধু একটিই, তা হলো ভয়ে প্রাকৃতিক কাজটি তিনি ড্রেনে সারেননি, সেরেছেন বিছানায়। বিষয়টি ধরতে চাচীর বেশিক্ষণ সময় লাগল না। তিনি আহত বাঘিনির মতো চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘একি! বিছানা তো পুরোটাই ভেজা। তাহলে কী তুমি...? ছি, এই বুড়ো বয়সেও ...!’
গেদু চাচা টুঁ শব্দটিও করছেন না। শুধু মনে মনে বললেন, বিড়াল কি আর কম সহজে গাছে ওঠে। তিনি তাৎক্ষণিক ঢাকায় শপিং করতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করলেন।