আমার মেয়ে টিনা করে আর্জেন্টিনা
- মুহাম্মদ কামাল হোসেন
- ৩১ মে ২০১৮, ০০:০০
সদ্য অফিস থেকে কপাল গুণে পাওয়া ৭৫ হাজার টাকার দামি মোবাইলখানা হাত-বেহাত হতে মাত্র ৭৫ সেকেন্ডও স্থায়ী হয়নি। আমার মেয়ে টিনা ইতোমধ্যে সেটি শাঁ করে বগলদাবা করে নিয়েছে। বিনিময়ে আমার কপালে জুটেছে মাত্র ১২০০ টাকার পুরনো মডেলের নোকিয়া মোবাইল ফোন সেট! টিনার সাফ কথাÑ ‘বাবা, তুমি এসব মোবাইলের জটিল ফাংশন-টাংশন বুঝবা না!’
দেখুন কাণ্ড, আমি নাকি বুঝব না! নতুন মোবাইল হাতে নিয়ে টিনাও লাপাত্তা। আমি এই রুমে তো টিনা ওই রুমে। রাত-দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে ৭৫,০০০ টাকার মোবাইল ফোন নিয়েই মেয়েটা ব্যতিব্যস্ত। ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্ট্রাগ্রাম কিছুই বাদ যায় না। মেয়েও আমার মাশাআল্লাহ একখান, সবখানে সমান দ। ফেসবুক টুইটারে ঘন ঘন পোস্ট দিচ্ছে, ‘আমি মিস টিনা করি আর্জেন্টিনা।’
সারাণ আর্জেন্টিনা-মেসি বলে বলে মুখে ফেনা তোলার জোগাড়। এদিকে ঘড়ির কাঁটায় রাত ৯টা ছুঁই ছুঁই। এমনিতে কাজের চাপে আমার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তার ওপর অফিসের জরুরি এক ফাইল নিয়ে বাসায় ব্যস্ত আছি। সময়মতো ফাইলখানা ছেড়ে দিতে হবে। নয়তো জমাকৃত ফাইলের স্তূপে আটকা পড়ে নিজের গোটা অস্তিত্বটাই ‘হ্যাপিশ’ হয়ে যাবে। বুঝুন ঠ্যালা, হ্যাপিশ হলে অফিসে যাওয়ার সম্ভাবনাটাও খুব একটা থাকে না। ল্যাঠা চুকে যায়। কাজের চাপের সাথে সাথে ঝক্কিঝামেলা থেকেও কিছুদিনের জন্য আপাতত রে পাওয়া যায়। তাছাড়া এমনিতেই ইদানীং টুকটাক বিষয়গুলোর প্রতি সামান্য নজর দেয়ার মওকাটুকুও খুঁজে পাই না। সময়টা যে কই যায়... ভেবেই কুল সারা। এরই মধ্যে হঠাৎ করে আমার মেয়ে টিনা কোত্থেকে এসে হাজির। কিছুটা চুপচাপ ও গুরুগম্ভীর। ঝড়ের পূর্বাভাস টের পাচ্ছি। সাথে এসেছে বাসার কাজের মেয়ে চুমকিও। চুমকির গায়ে শোভা পাচ্ছে ব্রাজিলের নতুন একখানা হলুদ জার্সি। নাহ্ এই বাসায় কারো পে ব্রাজিল সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই। চুমকিকে পাশের বাসার কেউ একজন জার্সিটা গিফট করেছে। রুমে এসে মেয়েটা মিটিমিটি করে হাসছে। চোখেমুখে দুষ্টুমীর ছটা। ইদানীং বাসার কাজের মেয়েগুলোও এককটা বদের হাড্ডি। সারাণ সেলেব্রিটিদের মতো ভাবসাব নিয়ে হাঁটাচলা করে। যেন এইমাত্র সিনেমার শুটিং সেরে এসেছে। কাজকর্ম শিকেয় তুলে দিনের অধিকাংশ সময় সাজুগুজু ও রূপচর্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রিমোট হাতে টিভি চ্যানেলগুলোর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়ায়। স্টার জলসা, স্টার প্লাস থেকে শুরু করে কালারস বাংলা ও জি-বাংলা কোনোটাই টেপাটেপির তালিকা থেকে বাদ যায় না। ইদানীং বিশ্বকাপ উন্মাদনা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন উৎপাত ও উন্মাদনা। চতুর্দিকে মহামারীর মতো একটাই কোরাস ধ্বনি ফুটবল ফুটবল বিশ্বকাপ ফুটবল। সাদা আকাশি জার্সির পাশাপাশি হলুদ রঙ্গা জার্সিতে পুরো দেশ যেন সর্ষেতে। হলুদ জার্সিতো নয়, যেন রীতিমতো মারাত্মক জন্ডিসে আক্রান্ত একেকজন মৃগী রোগী। তথাকথিত সাম্বা নৃত্যের নামে হলুদ মৃগী রোগীতে ছেয়ে গেছে গোটা দেশ। ব্রাজিল-আর্জেটিনা নামে বিভক্ত হয়ে গেছে পুরো জনপদ। অসময়ে দুইজনকে দেখে আমি কিছুটা অবাক হই।
‘কিরে টিনা মা চুপ করে আছিস কেন, কিছু বলবি?’
‘হু’
‘মোবাইল তো হাতে নিয়ে নিয়েছিস। আবার কী?'
‘এই নাও, তোমার মোবাইল আমার লাগবে না। সারাণ মোবাইল মোবাইল খোঁজাখুঁজি আর ভাল্লাগে না!’
‘সে কী রে! আমি আবার কবে মোবাইল চাইলাম!’
‘চাওনি তো কী? তাহলে, আমার আর্জেন্টিনার জার্সি ও পতাকাগুলো গেল কই?’
এতণে আমার হুঁশ ফিরে আসে। বুঝতে পারি টিনার রেগে যাওয়ার আসল কারণ। আসলে আমি কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম, টিনাকে আর্জেন্টিনার জার্সি ও পতাকা কিনে দেয়ার প্রতিশ্রুতির কথা। নিজের ভুলো মনার জন্য দাঁতে দাঁত কাটি।
‘ওহহো সেই কথা! চল মা এুণি তোকে সব কিনে দিবো। ঝটপট রেডি হয়ে নে।’
‘বাবা, সত্যি বলছো?’
এই বলে খুশির ছোটে মেয়েটি নেচে ওঠে। ঘরের মেঝ থেকে ইঞ্চি দেড়েক শূন্যে লাফিয়ে ওঠে।
‘হুমম সত্যি বলছি। এুণি কিনে দিবো, চল।’
এরই মধ্যে আমার স্ত্রী রূপা এসে যুক্ত হয়। গর্মাগর্মি ও কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করে।
‘তুমি মেয়েটাকে লাই দিয়ে দিয়ে যেভাবে মাথায় চড়িয়েছ। একদিন এর খেসারত দিতে হবে এই আমি বলে রাখলাম। মনে রেখ।’
‘আহহা,এমন করে বলছো কেন? আমাদের একটাইতো মেয়ে।’
‘একটাইতো মেয়ে!! তাহলে মাথায় তুলে ধেই ধেই করে নাচো। তুমি আজকালকার যুগের মেয়েগুলোকে চিনো? সামান্য আদর পেলে বাদর হয়ে মাথায় চড়ে বসে।’
‘ধুর রাখো তো।’
কথা আর না বাড়িয়ে রূপা চলে যায়। মাত্র দু’মিনিটের মাথায় টিনা আর চুমকি সেজেগুঁজে পরিপাটি হয়ে চলে আসে। বাসার ড্রাইভারকে আগেই বলে রেখেছিলাম গাড়ি নিয়ে রেডি থাকতে। অল্প কয়েক মিনিটের মাথায় আমরা শহরের একটি বড় বিপণিবিতানের সামনে এসে উপস্থিত হই।
টিনার খর্চার লিস্টে ইতোমধ্যে আরো নতুন নতুন পণ্য যুক্ত হয়েছে। আমার রীতিমতো গলদঘর্ম অবস্থা। পকেটের অবস্থাও বড্ড নাজুক। না পারি সইতে, না পারি কইতে। এরই মধ্যে অলরেডি হাজার পাঁচেক টাকা জলের মতো খসে গেছে। পকেটের অবস্থা বারোটা বেজে একটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। একডজন সাদা-আকাশি রঙের আর্জেন্টিনার জার্সি কেনা হয়ে গেছে। রীতিমতো একটা একাদশ মাঠে নামিয়ে দেয়ার অপো মাত্র। আমার জন্য ও রূপার জন্যও জার্সি কেনা হয়েছে। এই তালিকা থেকে বাদ পড়েনি বাসার কেউই। খেলা যত দিন চলবে, তত দিন বাসায় আমাদের এগুলো বাধ্যতামূলক পড়ে থাকতে হবে। টিনার কড়া হুঁশিয়ারি। পতাকাও মোটমাট কেনা হয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট হাফডজন! শুধু তা-ই নয়, যে ফুটবল নিয়ে এত উত্তেজনার পারদ, সেই ফুটবলও কেনা হয়েছে মোট তিনটি। একমাত্র মেয়ের বাবা হওয়ার স্বাদ বোধহয় একেই বলে!! মেয়ের উচ্চাবিলাসী শখ পূরণের জন্য আমাকে শেষ পর্যস্ত ‘মফিজ’ হতে হলো। ঘণ্টা দেড়েক পরে বিপণিবিতান থেকে যখন বেরিয়ে পড়ি ততণে আমার বিধ্বস্ত অবস্থা! পকেটে রাখা ক্রেডিট কার্ডের অবস্থাও প্রায় দফারফা!! ওইদিকে আমার মেয়ে টিনাতো মনের আনন্দে আত্মহারা। হইহুল্লোড় রঙ্গ মাস্তিতে মশগুল। ঘনঘন সেলফি তুলছে আর ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছে। পারে না পুরো আকাশটা মাথায় তুলে ধেই ধেই করে নাচে। খুশিতে কতণ পরপর আমার গলাও জড়িয়ে ধরছে। ‘বাবা, তুমি খুব লক্ষ্মী বাবা। আমার খুব ভালো বাবা।’ হায়রে কপাল! একেই বলে,কারো সর্বনাশ কারো পৌষ মাস!!