২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ঝুঁকিতে ২১ হাওর : কাঁচা-আধাপাকা ধান নিয়ে দুশ্চিন্তায়

সবুজ ধানে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। কিন্তু আগাম বন্যায় তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে - নয়া দিগন্ত

সুনামগঞ্জের কয়েক দিনের বৃষ্টিতে উজানের পানির স্রোতে ২১টি হাওর ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। আর কাঁচা-আধাপাকা ধান নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে কৃষক।

জানা গেছে, পাহাড়ি ঢলের পানি পার্শ্ববর্তী নয়াহাল, খাউজ্জাউরি, গলগলিয়া, ফানা, কাউয়ার খালে নামার খবর পাওয়া গেছে। রোববার সকাল ৭টার দিকে টাঙ্গুয়া হাওর ওয়াচ টাওয়ার সংলগ্ন বর্ধিত গুরমার হাওর বাঁধে ফাটল দেখা দিয়ে হাওরে পানি প্রবেশ করছে। জামালগঞ্জের গজারিয়া স্লুই গেইটর একাংশ ভেঙ্গে উপজেলার সর্ববৃহৎ বোরো ফসলী ধানের ভাণ্ডার পাকনা হাওরে পানি প্রবেশ করছে। অপরদিকে মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের আইনা কলমা, সালদিঘা হাওর দিয়ে পানি ছুঁই-ছুঁই। এ কারণে দুই মধ্যনগর ও তাহেরপুর উপজেলার ছোট-বড় ২১ হাওরের প্রায় ছয় হাজার হেক্টর বোরো জমি সম্পূর্ণ ঝুঁকিতে রয়েছে।

শনিবার বিকেল থেকেই পানির প্রবাহ কিছুটা শুরু হলেও রোববার সকালে তা কিছু বৃদ্ধি পেতে থাকে । এমন খবর পেয়ে সিলেট বিভাগের পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মোঃ জহিরুল ইসলাম, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুনাসিন্দু বাবুল ও তাহেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান কবীর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষক সমাজসহ হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলোতে অবস্থান করে ফসল রক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে জামালগঞ্জের সর্ববৃহৎ বোরো ধানের ভাণ্ডার খ্যাত পাকনা হাওরের বৌগলা খালির ক্লোজারে ধ্স নামলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিৎ দেব, পিআইসি ও স্থানীয় কৃষকরা বাঁধ মেরামতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেনারবাঁক ইউনিয়নের গজারিয়া স্লুইচ গেইটের নিচে প্রবল পানির চাপে একাংশ ভেঙ্গে পাকনা হাওরে প্রবশে করছিল। পরে এলাকাবাসীর সার্বিক প্রচ্ছেষ্টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পানি প্রবেশ বেশির ভাগই বন্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। হালির হাওরের হিজলা-সংলগ্ন কুড় ও গুনিয়ার কারার পার্শ্ববর্তী তে নতুন ফাটল তৈরীর খবর পাওয়া গেছে। শনির হাওরে ঝালু খালি ও নান্টু খালি বাঁধের নিচে সুরঙ্গপথে নিচ দিয়ে পানি চুঁয়ে যাচ্ছে।

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন, এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জামালগঞ্জের হাওরের অবস্থান এখন পর্যন্ত মোটামুটি ভালো রয়েছে। তবে পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে এবং পানি বৃদ্ধি পেলে বাঁধ নিয়ে শঙ্কা আরো বেড়ে যেতে পারে।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রায়হান কবীর বলেন, পাটলাই নদীর পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় অবস্থা এখন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ার-সংলগ্ন বাঁধে মাটি ও বাঁশের চাটাই দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানির উচ্চতা রোববার (১৭ এপ্রিল) দুপুর ১২টায় ছিল পাঁচ দশমিক ৮৭ মিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীর পানি বেড়েছে ৪০ সেন্টিমিটার। এ ছাড়া জেলার সীমান্তবর্তী যাদুকাটায় এ সময়ে পানি বেড়েছে ৭১ সেন্টিমিটার, পাটলাই নদে ৪৩ সেন্টিমিটার।

সুনামগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৩ মিলিমিটার। সিলেট অঞ্চলের দুই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কায় সিলেট, সুনামগঞ্জ জেলায় আকস্মিক বন্যার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। শনিবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হাওর অঞ্চলের নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সুনামগঞ্জের সুরমা নদী ও যাদুকাটা নদীর পানি পরশু দুপুর পর্যন্ত সমতলে ছিল। কিন্তু বন্যা পূর্বাভাসের ঘোষণার পর সুরমা নদী ও সুনামগঞ্জের ধনু নদী ও বৌলাই নদী কিছু স্থানে বিপৎসীমা অতিক্রম করে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু স্থানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। ফলে সুরমা নদী সুনামগঞ্জ জেলায় বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে। ধনু-বাৌলাই নদী নেত্রকোনা জেলার কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। পানির ঢল দ্বিতীয় দফা বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওরের বোরো ফসল নিয়ে কৃষকরা চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন। এখন ধান কিছু পেকে যাওয়ার কারণে কৃষকরা হাওরে চলে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোর কাজে শ্রমিকও মিলছে না। ফলে পাউবোর অনেক বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ চরম ঝুঁকিতে। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা কৃষকদের।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, জেলায় ৪১ হাজার ৫ শ' হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। তবে এখনো এক লাখ ৮১ হাজার ৮২৮ হেক্টর জমির ধান কাটা বাকি আছে। রোববার থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই ৯০ শতাংশ ধান কাটা শেষের আশা করছেন। পাকা ধান দ্রুত কেটে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। বন্যার ঝুঁকির মধ্যে থাকা বোরো ধান ৮০ শতাংশ পাকলে কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। এই অবস্থায় জেলার ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৫টি কৃষক পরিবারের দুশ্চিন্তা যে পিছু ছাড়ছে না। জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৫০৮ হেক্টর জমিতে এবার বোরো আবাদ হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। জেলার ১৩৭টি হাওরসহ কৃষির সাথে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৫টি পরিবার জড়িত। হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারাও বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৭২৩ টি প্রকল্পের মাধ্যমে হাওরের ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার করেছে। এক সপ্তাহ ধরে পাহাড়ি ঢলের চাপে অস্থায়ী বেড়িবাঁধগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবারও বৃষ্টিপাত হলে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম সুনামগঞ্জের হাওর ডুবির কারণ দেখতে এসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সুনামগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সব কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করেছেন।

এদিকে, শনিবার দুপুরে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক হাওরের কৃষকদের সাথে মতবিনিময়কালে কৃষকদের উৎকণ্ঠার বিষয়ে বলেন, যেভাবে পানি বাড়ছে, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের মতো হাওরগুলোর ফসল তলিয়ে যেতে পারে। তাই দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দেন তিনি। বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে এমন আশঙ্কায় সুনামগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের কৃষকরা কাঁচা-আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement