নয়া দিগন্তের বড় বিসর্জন শহীদ সাংবাদিক তুরাব
- এমজেএইচ জামিল, সিলেট
- ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩:২৩
২০২৪ ইতিহাসের সেরা অর্জন-বিসর্জনের একটি বছর পার করল বাংলাদেশ। এই অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বড় বিসর্জন হয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্তের। স্বৈরাচার পতন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে অকালে ঝরে পড়েছেন নয়া দিগন্ত নামক বাগানের তুরাব নামের সম্ভাবনাময় একটি গোলাপ। বেদনাবিধুর ২০২৪ সালে সিলেটের সাংবাদিকতা অঙ্গন হারিয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান এটিএম তুরাবকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর দিকে সিলেটে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সাংবাদিক এটিএম তুরাব। শহীদদের কাতারে যেমন তুরাব রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন শিশু, কিশোর, আবালবৃদ্ধবনিতাসহ নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। জুলাই আন্দোলনে শাহাদাতবরণ করেছেন সিলেট বিভাগের ৩১ ছাত্র-জনতা।
শহীদ সাংবাদিক তুরাব :
১৯ জুলাই বাদ জুমা নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় ছাত্র-জনতার উপর নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে মিছিল বের করে বিএনপি। তখন ন্যুনতম কোনো উত্তেজনা ছিল না। নিত্যদিনের মতো সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিকগণ। পাশেই ছিল পুলিশের সশস্ত্র অবস্থান। হঠাৎ অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তা এসএমপির তৎকালীন সহকারী কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরের মারমুখী আচরণে বদলে যায় পরিস্থিতি। উত্তপ্ত হয়ে উঠে কোর্ট পয়েন্ট এলাকা। ওই পুলিশের কিলিং মিশনের টার্গেটে পড়ে যান সাংবাদিক এটিএম তুরাব। পুলিশের ছুঁড়া ৯৮টি ছররা গুলিবিদ্ধ হয় তুরাবের শরীরে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে জরুরি ভিত্তিতে সোবহানীঘাটস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই আইসিইউ-তে থাকা অবস্থায় সাংবাদিক তুরাব সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন।
তুরাবের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা: শামসুল ইসলাম বলেন, তুরাবের শরীরে ৯৮টি ছররা গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায়ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
মাত্র তিন মাস আগে লন্ডনি মেয়ে বিয়ে করেছিলেন সাংবাদিক এটিএম তুরাব। লন্ডন যাওয়ার সব প্রক্রিয়া এগিয়েও রেখেছিলেন। হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে তার লন্ডন পাড়ি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই গুলিতে মারা যান তিনি। এমন ঘটনায় হতবাক তার পরিবার। শোক কাটাতে পারছেন না। হানিমুনের প্রতীক্ষায় ছিলেন নবদম্পতি। লন্ডনে থাকা সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী তানিয়া ইসলাম বিয়ের তিন মাসের মধ্যে হয়ে গেলেন বিধবা। কাঁদছেন তিনিও। কারণ তখন দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় স্বামীর লাশ ও শেষ বিদায়ের দৃশ্য দেখতে পারেননি তিনি।
সাংবাদিক তুরাব হত্যার ৫ মাস পেরিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তুরাব হত্যা মামলায় এসএমপির তৎকালীন এডিসি দস্তগীর ও পুলিশ কনস্টেবল উজ্জল সিংহ কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু এসএমপির তৎকালীন ডিসি আজবাহার আলীসহ এজাহারভুক্ত অধিকাংশ আসামি এখনো বাইরে থাকায় ন্যায় বিচার নিয়ে পরিবার ও সহকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে সংশয়। যদিও পুলিশ প্রশাসন থেকে তুরাবের ন্যায় বিচারের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন আইজিপি বাহারুল আলমসহ সিলেটের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ।
জুলাই বিপ্লবে সিলেটের ৩১ শহীদের তালিকা
বিগত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ও জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকায় সিলেট বিভাগের ৩১ জন শহীদের নাম প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেলের ওয়েবসাইটে তাদের নাম সংযুক্ত করা হয়।
এর মধ্যে সিলেট জেলার ১৩, হবিগঞ্জের ১৫ ও সুনামগঞ্জের ৩ জন রয়েছেন।
সিলেট জেলার শহীদরা হলেন- সানি আহমেদ, মো: নাজমুল ইসলাম, হোস উদ্দিন, মিনহাজ আহমদ, মো: পাবেল আহমদ কামরুল, জয় আহমেদ, তারেক আহমদ, তাজ উদ্দিন, আবু তাহের মো: তুরাব (সাংবাদিক), সুহেল আহমেদ, মো: মোস্তাক আহমেদ, ওয়াসিম ও মঈনুল ইসলাম।
সুনামগঞ্জ জেলার শহীদরা হলেন- মো: আয়াতউল্ল্যাহ, হৃদয় মিয়া ও সোহাগ মিয়া।
হবিগঞ্জ জেলার শহীদরা হলেন- হোসাইন মিয়া, মো: আশরাফুল আলম, মো: মোজাক্কির মিয়া, শেখ নয়ন হোসাইন, মো: তোফাজ্জল হোসাইন, মো: সাদিকুর রহমান, আকিনুর রহমান, সোহেল আকঞ্জী, আজমত আলী, শেখ মো: শফিকুল ইসলাম, মামুন আহমদ রাফসান, মুনাঈল আহমদ ইমরান, রিপন চন্দ্র শীল, করিমুল ইসলাম ও মো: আনাস মিয়া।
ছাত্র-জনতার এ আন্দোলন দেশের ইতিহাসে এক অমর অধ্যায় হয়ে থাকবে। ২০২৪ সাল শেষ হলেও, এই ঘটনার রেশ চিরকাল ধরে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। শহীদ পরিবারের স্বজনরা আমৃত্যু খুঁজে বেড়াবে তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে।