১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩০, ১৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

সাংবাদিক তুরাব হত্যার ৩ মাস, গ্রেফতার নেই কেউ

সাংবাদিক তুরাব হত্যার ৩ মাস, গ্রেফতার নেই কেউ - ছবি : নয়া দিগন্ত

সিলেটে প্রকাশ্য দিবালোকেত পুলিশের গুলীতে নিহত সাংবাদিক এ টি এম তুরাব নিহতের তিন মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে আজ। কিন্তু এখনো গ্রেফতার নেই কেউ, এমনকি নির্বিচারে গুলীবর্ষণকারী পুলিশ এখনো বহাল তবিয়তে।

মামলার তদন্তভার পিবিআইর কাছে হস্থান্তর করা হলেও তদন্ত কর্মকর্তার রহস্যমূলক আচরণে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, বিগত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই বাদ জুমআ নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় মিছিল বের করে বিএনপি। তখন ন্যূনতম কোনো উত্তেজনা ছিল না। নিত্যদিনের মতো সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিকগণ। পাশেই ছিল পুলিশের সশস্ত্র অবস্থান। হঠাৎই অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তা এসএমপির সহকারী কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরের মারমুখী আচরণে বদলে যায় পরিস্থিতি। উত্তপ্ত হয়ে উঠে কোর্ট পয়েন্ট এলাকা। ওই পুলিশের কিলিং মিশনের টার্গেটে পড়ে যান সাংবাদিক এ টি এম তুরাব।

দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান এ টি এম তুরাব সেদিন সড়কের রেলিংয়ে এক হাত দিয়ে ধরে অন্য হাতে মোবাইল ক্যামেরায় দেহে প্রেস লেখা জ্যাকেট (ভেস্ট) ও হেলমেট পড়ে বিএনপির মিছিল ও পুলিশের অবস্থানের মাঝখানে ভিডিও ধারণ করছিলেন।

এমন সময় হঠাৎ ‘বিগড়ে’ যান এসএমপির ভয়ঙ্কর এডিসি দস্তগীর। কনস্টেবলের হাত থেকে একটি বন্দুক নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়া শুরু করলেন। তার গুলির নিশানা ছিল সাংবাদিক তুরাব। তখন দস্তগীরের দেখাদেখি অন্য পুলিশ সদস্যরাও বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে। পুলিশের ছুঁড়া ৯৮টি ছররা গুলি বিদ্ধ হয় তুরাবের শরীরে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেন তার সহকর্মীরা। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে জরুরিভিত্তিতে সোবহানীঘাট ইবনে সিনা হাসপাতালে আনা হয়। সেখানেই আইসিইউ-তে থাকা অবস্থায় সাংবাদিক তুরাব সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন।

তুরাবের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম বলেন, তুরাবের শরীরে ৯৮টি ছররা গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায়ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।

শনিবার (১৯ অক্টোবর) তুরাব হত্যাকাণ্ডের তিন মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে।

সিলেটের সকল মহলের প্রিয় সম্ভাবনাময় সাংবাদিক তুরাব নিহতের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো গ্রেফতার হয়নি কোনো খুনী, এমনকি তুরাব হত্যার সাথে জড়িত তৎকালিন এডিসি দস্তগীর ও উপকমিশনার আজবাহার আলীকে এখনো বরখাস্ত করা হয়নি। অথচ ৫ আগস্ট পরবর্তী বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছে ছাত্র-জনতার মনোনীত অন্তর্বর্তীকালিন সরকার। তিন মাসেও তুরাবের কোনো খুনীকে গ্রেফতার না করতে পারায় ক্ষুব্ধ সিলেটের নাগরিক ও সাংবাদিক সমাজ। বিক্ষুব্ধ তুরাবের পরিবার।

জানা গেছে, পুলিশের গুলিতে সাংবাদিক তুরাব নিহতের ঘটনায় গত ২৪ জুলাই পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে নথিভুক্ত করে। জিডির ব্যাপারে তৎকালিন কোতোয়ালি থানার ওসি মঈন উদ্দিন শিপন বলেছিলেন, ‘কার এবং কোনো দিক থেকে আসা গুলি বিদ্ধ হয়ে তুরাব মারা গেছেন, এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আগেই একটি মামলা করা হয়েছে। সেটির তদন্ত চলছে। পরিবারের পক্ষ থেকে করা অভিযোগটি আমরা রেখেছি এবং জিডি হিসেবে রেকর্ড করেছি। পরিবারের লিখিত অভিযোগ ও পুলিশের মামলাকে সমন্বয় করে তদন্ত এগোচ্ছে। এরপর থেকেই অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায় তুরাব হত্যা মামলা।’

৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১৯ আগস্ট সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আব্দুল মোমেনের আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের ভাই আবুল হাসান মো: আজরফ (জাবুর)। মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (ক্রাইম, উত্তর) মো: সাদেক দস্তগীর কাউছার, উপকমিশনার (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি আজবাহার আলী শেখসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া মামলায় আরো ২০০ থেকে ২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।

এদিকে, আদালতে মামলা দায়েরের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মামলার কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। গ্রেফতার করা হয়নি কোন আসামিকে। মামলার অন্যতম আসামি এসএমপির কোতোয়ালী থানার তৎকালিন ওসি মঈন উদ্দিন শিপনকে ২৩ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুর নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছিল বিজিবি। গ্রেফতারের পর মাধবপুর থানায় হস্তান্তরের পর পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। তাকে গ্রেফতারে উপরের কোনো নির্দেশনা না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান হবিগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।

এদিকে চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। একইসাথে পিবিআই হেড কোয়ার্টার থেকে মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করতে এসএমপির কোতোয়ালী থানাকে নির্দেশ দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ৬ অক্টোবর মামলার নথিপত্র পিবিআই সিলেটের পুলিশ পরিদর্শক মুরসালিনকে বুঝিয়ে দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার এসআই শাওন।

এরপর ৯ অক্টোবর বুধবার বিকেলে নগরীর বন্দরবাজার সংলগ্ন শহীদ সাংবাদিক তুরাব চত্বর (কোর্ট পয়েন্ট) এলাকায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে তদন্তের কার্যক্রম শুরু করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ মুরছালিন। এ সময় মামলার বাদি তুরাবের আবুল আহসান মো: আজরফ (জাবুর) ছাড়াও সিলেটে কর্মরত বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তুরাবের শরীরে গুলি লাগার স্থান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদেরকে তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করার আশ্বাস প্রদান করেন পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা মো: মুরসালিন।

কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা মুরসালিন সগোত্রীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের রক্ষা করতে কাজ করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন তুরাবের সহকর্মী সাংবাদিক ও পরিবারের সদস্যগণ। তারা বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাকে সকল ভিডিও ফুটেজ দেয়া হয়েছে এমনকি সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সাংবাদিকবৃন্দ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে তুরাবের হাতে থাকা মোবাইল ফোন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দেয়া হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের তিন মাসেও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সাংবাদিক এ টি এম তুরাবের ভাই আবুল আহসান মো: আজরফ (জাবুর)।

তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার ভাই হত্যার তিন মাস সময় পার হয়েছে। মামলা এফআইআর হওয়ার পর আরো দুই মাস চলে গেছে এরপরও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় আমরা বিস্মিত। এর মাধ্যমে পুলিশের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আমার ভাইয়ের হত্যার সাথে তো সব পুলিশ জড়িত নয়। তাহলে আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন?

তিনি বলেন, আগে কোতোয়ালী থানার কাছে ছিল। এখন পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আমাদের কাছে যা চেয়েছেন আমরা সব দিয়েছি। এরপরও পিবিআইয়ের বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখাতে পারেননি। এতে আমরা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে শঙ্কিত।

পিবিআই সিলেটের ইন্সপেক্টর মুরসালিন শুক্রবার রাতে দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি তদন্তভার গ্রহণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের স্বাক্ষ্য নিয়েছি। এব্যাপারে প্রাপ্ত সকল বিষয় জানানোর জন্য আমি ঢাকা গিয়েছিলাম। পিবিআই হেডকোয়ার্টারকে সব বিষয়ে অবগত করে এসেছি। আমার কাছে প্রাপ্ত ভিডিও ফুটেজে গোলাম কাউসার দস্তগীর একজন পুলিশের কাছ থেকে বন্দুক নিচ্ছেন সেই দৃশ্যটা রয়েছে। কিন্তু তিনি যে সাংবাদিক তুরাবকে সরাসরি গুলী করছেন এমন ফুটেজ পাইনি। এরপরও আমি বিভিন্ন উৎস থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করছি।

তিনি বলেন, আমাদের ওপর ভরসা রাখতে হবে। পুলিশ হলেই ছাড় দেয়া হবে সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। কারণ রায়হান হত্যা মামলায় পিবিআই পুলিশের বিরুদ্ধে সত্য রিপোর্ট দিয়েছে। সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলায়ও সঠিক রিপোর্ট দিতে আমরা বদ্ধ পরিকর।

আসামিদের গ্রেফতারের ব্যাপারে তিনি বলেন, সাধারণ আসামি এবং চাকরিরত সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করতে কিছু আইন রয়েছে। যার কারণে কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি মঈন উদ্দিন শিপনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে মামলার আসামিরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তারা আইন সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। তাই পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তাদেরকে গ্রেফতারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হবে। এজন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলেও জানান তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement