বাংলাদেশের উজানে ত্রিপুরার বন্যা পরিস্থিতি যেমন
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৩ আগস্ট ২০২৪, ২০:২৯
‘আমাদের বাড়িটা এলাকার সব থেকে উঁচু জায়গায়। সবাই তাই পড়শিরা আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বাড়িতেও যে পানি ঢুকে যাবে, এটা কেউ ভাবতেও পারিনি।’
বিবিসি বাংলার কাছে এভাবে ত্রিপুরার বন্যা পরিস্থিতির বর্ণনা করেন ত্রিপুরার উদয়পুর শহরের সাংবাদিক আয়ুব সরকার। তিন দিন ধরে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন তিনি।
শুক্রবার সকালে মোবাইল ফোনে ব্যাটারি দিয়ে চার্জ দিয়ে চালু করার পরে বিবিসি বাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।
সাম্প্রতিক বন্যায় সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেসব এলাকা, তার মধ্যে অন্যতম গোমতী জেলা। তারই জেলা সদর শহর উদয়পুর।
বন্যায় পুরো রাজ্যে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন দুজন।
তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত লাগাতার ৩৮ ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে এখানে। সেই পানি তো ছিলই। তারপরে ডম্বুর ড্যামের পানি ঢুকতে শুরু করে। আবার জেলার কিছু অংশে মিজোরামের দিক থেকেও পানি চলে এসেছিল।’
‘সব মিলিয়ে যে অবস্থা তা ভয়াবহ। মাত্র দুঘণ্টার মধ্যে আমাদের ঘরে চার ফুট পানি জমে গিয়েছিল। রাত্রিবেলা বাধ্য হয়েই সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়।’
‘নানা সময়ে আমিই এগিয়ে যেতাম মানুষজনকে রেসকিউ করতে, এবার আমি নিজেই ভিকটিম,’ বলেন তিনি।
ত্রিপুরায় সবথেকে ভয়াবহ বন্যা তারা দেখেছেন ১৯৮৩ সালে। তবে এবছরের বন্যা তাকে ছাড়িয়ে গেছে। ১০ বছর পরে ১৯৯৩ সালেও বন্যা হয়েছিল।
‘কোথাও শুধু বাড়ির টিনের ছাদ দেখা যাচ্ছে, কারো বাড়ির শুধু দোতলাটা দেখা যাচ্ছে – মানে একতলা পুরো ডুবে গেছে,’ জানালেন আয়ুব সরকার।
চারদিকে শুধুই পানি
গোমতী জেলারই আরেকটি এলাকা মহারাণী। সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিক মোছলেম মিঞা শুক্রবার দুপুরে যা দেখতে পাচ্ছেন, তারই বর্ণনা দিচ্ছিলেন বিবিসিকে।
‘চারদিকে শুধুই পানি, মাঝে মাঝে কিছু মানুষের ঘরবাড়ি আর গাছপালা দেখা যায়। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মহারাণী এলাকার প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িতেই বুক সমান পানি এখন, কারো বাড়িতে ১০ হাত পর্যন্ত পানি দাঁড়িয়ে আছে। গত তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই, পানীয় জল নেই। কোথাও কোনো গাড়ি চলার উপায় নেই,’ বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস, তার ৯৫ ভাগ মানুষই এখন হয় আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন। অনেকে আবার টিলা এলাকার বাড়ি বা অফিস-কাছারিগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।’
‘তারা কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, কেউ জানেন না। অনেকে চেষ্টা করছেন যে নৌকা বা ভেলায় চেপে নিজের বাড়ির দিকে যাওয়ার, যাতে একবার চোখের দেখা দেখে আসতে পারেন।’
তিনি জানান, ওই এলাকা এক তো গোমতী নদীর তীরে, লাগাতার বৃষ্টির কারণে সেই পানি পাড় উপচিয়ে এলাকা ভাসিয়ে দিয়েছে। এর সাথে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের ডম্বুর বাঁধের পানি ঢুকে এলাকা আরো ডুবিয়েছে।
নিজে সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দুদিনের পরে তার পক্ষে পেশাগত কাজ করা আর সম্ভব হয়নি।
‘কোনোমতে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছি। তারপরে নৌকায় করে বহু মানুষকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। এর মধ্যে আর পেশার দিকে নজর দিতে পারিনি,’ বলেন মোছলেম মিঞা।
পানি নামতে শুরু করেছে
শুক্রবার সকাল থেকে নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় ত্রিপুরার অনেক এলাকা থেকেই পানি নেমে যেতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
তবে গোমতী আর খোয়াই নদী দুটির পানির স্তর এখনো বিপৎসীমার উপর দিয়েই বইছে।
সাংবাদিক আয়ুব সরকার বলেন, ‘এখানে সকাল থেকে জল নেমে যাচ্ছে। কিন্তু গোমতী নদীর ধারে সোনামুড়া শহরের দিকে রাত থেকে জল বাড়ছে বলে খবর পেয়েছি। সেখানে বৃহস্পতিবার রাতেও কথা বলতে পেরেছিলাম, কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।’
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা আজ শুক্রবার হেলিকপ্টারে চেপে গোমতী আর দক্ষিণ জেলায় গিয়েছিলেন।
বিভিন্ন ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেয়া পানিবন্দী মানুষের সাথে কথা বলেন তিনি।
আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস
রাজ্যের অনেক এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করলেও ভারতীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান দফতর ত্রিপুরার চারটি জেলায় আগামী তিন দিন অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল সকাল থেকে।
তবে দুপুরে নতুন উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে সতর্কতার মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে তারা। এখন বলা হচ্ছে, দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার দুটি এলাকায় আগামী দুদিন ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও রাজ্যের অন্য কিছু এলাকায় শুধুই বজ্রসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছে তারা।
পুরো রাজ্যে আগামী দুদিনের জন্য হলুদ সতর্কবার্তা রয়েছে শুক্রবার দুপুর থেকে। তবে রোববার দক্ষিণ জেলার কিছু এলাকায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সেদিন ওই অঞ্চলে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি