ভারতে হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা : এখনো ধোঁয়াশায় তদন্তকারীরা

কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের পর কেটে গেছে দিন দশেক। কিন্তু এখনো ধোঁয়াশা অকুস্থল ঘিরে।

হাসপাতালের সেমিনার রুমেই কুকর্ম করেছিল দুষ্কৃতিকারী? নাকি অন্য কোথাও খুন করে এনে রাখা হয়েছিল সেমিনার রুমে? তদন্তকারী সংস্থার বদল হলেও এই তথ্য এখনো অস্পষ্ট।

৯ আগস্ট হাসপাতালে সেমিনার রুমে চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার হয়। সেই লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখন ভাইরাল। এতেই স্পষ্ট হয়েছে, ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে কর্তব্যরত চিকিৎসককে। কিন্তু কোথায় ঘটেছিল এই ঘটনা?

কোথায় ঘটেছিল অপরাধ?
সেমিনার রুমের পোডিয়ামে উদ্ধার হয়েছিল চিকিৎসকের লাশ। সমাজমাধ্যমের সৌজন্যে সেই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। এই ছবি ঘিরেই প্রশ্ন উঠছে অনেক। যেভাবে দেহ সেমিনার রুমে পড়েছিল, তাতে সন্দেহ তীব্র হয়েছে, বিশ্রাম নিতে ওই জায়গায় কেন শুয়েছিলেন তরুণী?

হাসপাতালের যে চতুর্থ তলে সেমিনার রুম, সেই একই তলে চিকিৎসকদের বিশ্রামের বিকল্প জায়গা রয়েছে বলে সূত্রের খবর। এখানে বিশ্রাম নেন চিকিৎসকরা। তাহলে কেন সেমিনার রুমে ঘুমাতে গেলেন তরুণী?

সংবাদে প্রকাশ, পোডিয়ামের উপরে থাকা এক্সরে লুকিং বক্সের ধার ঘেঁষে পড়েছিল লাশ। তার নিচে পাতা নীল শয্যা। পাশে উঁচু কাঠের বেঞ্চ। এই দুয়ের মধ্যে পড়েছিলেন তরুণী। উপরের অংশের পোশাক ছেঁড়া। নিম্নাঙ্গে পোশাক নেই। পা দুদিকে ছড়ানো। লাল কম্বল ফেলা ছিল লাশের উপর।

একের পর এক প্রশ্ন
ওই দৃশ্য থেকেই একাধিক প্রশ্ন উঠে আসছে। সেমিনার রুমেই অন্য পরিষ্কার জায়গা ছিল যেখানে বিছানা করা যেত বলে সূত্রের দাবি। কিন্তু চিকিৎসক কেন ধুলোভরা পোডিয়ামে শয্যা পাতলেন?

দুই, যে জায়গায় লাশ মিলেছে সেটি দেয়ালের ধার ঘেঁষে। এমন জায়গা যেখানে পাশ ফিরে শোয়া মুশকিল। কেন সেখানে শুলেন তরুণী?

তিন, লাশ যে শয্যার উপর ছিল তার নিচ দিয়ে গিয়েছে বিদ্যুতের তার। সুইচ বোর্ডের সাথে সেই তার জোড়া। বোর্ড ছিল লাশের কাছাকাছি। পোডিয়ামে শোয়া মনস্থির করলে বিদ্যুতের তারের উপর কেন শুতে যাবেন তিনি?

চার, এই তলের একটি ঘরে পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। সেখানে শৌচালয় কি ব্যবহারযোগ্য ছিল? যদি তা না-ও হয়, তাহলে কি সেই ঘরে দুষ্কর্ম ঘটিয়ে লাশ এনে রাখা হয়েছে সেমিনার রুমে?

তরুণী চিকিৎসকের মা অকুস্থল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'সেমিনার রুমের কাছের একটি ঘরে ভাঙাচোরা শুরু হয়েছিল। কেন আমার মেয়ের মৃত্যুর পর এটা করা হলো? ওকে ওখানে ধর্ষণ ও খুন করে কি লাশ সেমিনার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?'

জুনিয়র ডাক্তারের বয়ান
লাশ উদ্ধারের পর সেদিন রাতে ওই তলে যারা ছিলেন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এক জুনিয়র ডাক্তারের বয়ান প্রকাশ্যে আসে। তা নিয়েও জোরালো হচ্ছে সন্দেহ। সূত্রের খবর, ওই চিকিৎসক দাবি করেন, তিনি সেমিনার রুমে গিয়ে দেখেন, তরুণী সহকর্মী কপালের উপর হাত দেখে ঘুমোচ্ছেন। সেমিনার রুমের প্রবেশপথ থেকে পোডিয়ামের দূরত্ব এতটাই যে ঢুকেই কাউকে ঘুমন্ত অবস্থায় চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন উঠেছে, পোডিয়ামের কাছে না এসে জুনিয়র ডাক্তার কিভাবে দেখলেন যে তরুণী ঘুমোচ্ছেন? লাশ যে অবস্থায় মিলেছে তাতে কাউকে ঘুমন্ত মনে করা কি সম্ভব? দুই, বেঞ্চের জন্য তরুণীর দেহ যদি আড়ালে পড়ে থাকে, তাহলে কি ওই বেঞ্চ ইচ্ছা করেই ওই জায়গায় রাখা হয়েছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সিবিআই। তিন, ধর্ষণ ও খুনের পর যদি হাত কপালের উপর রেখে দেয়া হয়, তাহলে পা ছড়ানো বা পোশাক অগোছালো কিভাবে রেখে গেল দুষ্কৃতিকারী?

মিসিং লিঙ্ক
লাশ উদ্ধারের দিন পুলিশ সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করে। সূত্রের খবর, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধরা হয়েছিল তাকে। ভোর ৪টা নাগাদ সঞ্জয় সেমিনার রুমে ঢোকে। আধঘণ্টা পর বেরিয়ে যায়।

প্রশ্ন উঠছে, যদি লাশ সেমিনার রুমের বাইরে থেকে আনা হয়ে থাকে, তা সিসিটিভি ফুটেছে কি দেখা যায়নি? দুই, সেমিনার রুমে প্রবেশের অন্য কোনো দরজা বা জায়গা রয়েছে যা সিসিটিভির আওতার বাইরে? তিন, সঞ্জয়ের সাথে আরো কেউ এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকলে কোনো সন্দেহভাজনকে এখনো কেন তদন্তকারীরা গ্রেফতার করতে পারলেন না?

বিচারের পথে বাধা
সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলামের মতে, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'মা-বাবাকে তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হচ্ছে, লাশ দেখতে দেয়া হচ্ছে না কেন? তখন কিছু কি পরিবর্তন করা হচ্ছে! ময়নাতদন্তের পর তাদের হাতে লাশ না দিয়ে পুলিশ দাহ করার জন্য চাপ দেবে কেন?'

একাধিক ব্যক্তি অপরাধে জড়িত কি না, সেটাও বোঝা সম্ভব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায়। নজরুলের বক্তব্য, 'ময়নাতদন্তে শুনছি ঘন তরল পাওয়া গিয়েছে। যদি ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায়, একাধিক ব্যক্তির বীর্য রয়েছে, তাহলে বোঝা যাবে এটা কজনের কাজ। না পাওয়া গেলে বলা যাবে না একাধিক।'

ধর্ষণ ও খুনের বিচারের দাবিতে পুরো রাজ্য উত্তাল। অভিযোগ দ্রুত প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা কতটা? সাবেক পুলিশকর্তার মতে, 'এই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। এর রহস্যভেদ করতে হবে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে। সেই সূত্র ঠিকভাবে জোগাড় করা গেলে আলো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটা ঠিকমতো মিলেছে বলে আমি শুনিনি। অতএব ধোঁয়াশা রয়েছে।'

সূত্র : ডয়চে ভেলে