২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘রাতের রাস্তা দখল’ কতটা চাপে ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলোকে

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারকে ধর্ষন ও হত্যার ঘটনায় দ্রুত বিচার চেয়ে শুক্রবার পথে নেমেছিল একাধিক রাজনৈতিক দল - ছবি - বিবিসি

কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দোষীদের ফাঁসি চেয়ে শুক্রবার মিছিল করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। আবার ওই ঘটনায় তার পদত্যাগ চেয়ে মিছিল করেছে বিজেপি।

মিছিল, পাল্টা-মিছিল একইসাথে সব চলেছে শুক্রবার। হঠাৎ করে কেন একইসাথে এতগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেমে পড়ল ক্ষমতাসীন-বিরোধী সব দলগুলোই?

বুধ আর বৃহস্পতিবারের মাঝ রাতে যে লাখ লাখ নারী-পুরুষ রাস্তা দখল করে নিয়েছিলেন, জনতার সেই স্বতঃ:স্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখেই কী রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তায় নামতে বাধ্য হলো?

এমনটাই মনে করছেন একাধিক বিশ্লেষক।

তারা বলছেন, ওই রাতের রাস্তা দখল সবগুলো রাজনৈতিক দলকেই একটা বার্তা দিয়েছে যে নারী নিরাপত্তার ব্যবস্থা বা দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থার দাবি নিয়ে দলগুলো যদি শুধু রাজনীতিই করে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ পথে তো নামবেই।

আর সেই রাতের ‘জনসমুদ্র’ দেখে শুক্রবার থেকে রাজনৈতিক দলগুলোও রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক দলগুলো যখন রাস্তায় নেমেছে শুক্রবার, তার মধ্যেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজসহ রাজ্যের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়ার ডাক্তাররা কর্মবিরতি চালাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে রেসিডেন্ট ডাক্তাররাও কাজ করছেন না।

ভারতে চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন শনিবার সকাল থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য ধর্মঘট ডেকেছে।

কলকাতায় সব দলই রাস্তায়
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী গত সোমবার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে তার সরকার ঘটনায় ধৃতের দ্রুত বিচার চায় এবং তারা ফাঁসির দাবি জানাবে আদালতে।

পরের দিনই অবশ্য কলকাতা হাইকোর্ট কলকাতা পুলিশের তদন্তের ওপরে ভরসা না রেখে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোকে ওই চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়।

এরই পরে বুধবার রাত থেকে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামতে শুরু করেন। দু’টি স্লোগান ছিল তাদের মুখে, ‘বিচার চাই’ আর ‘রাতের রাস্তা দখল করো’।

মুখ্যমন্ত্রী আগেই বিচার এবং ফাঁসির দাবি তুলে থাকলেও ওই রাতের রাস্তা দখল কর্মসূচির পরে, বৃহস্পতিবার তার দল চার দিনের এক কর্মসূচি ঘোষণা করে।

সেই অনুযায়ীই শুক্রবার তৃণমূল কংগ্রেসের সহকর্মীদের নিয়ে ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন মমতা ব্যানার্জী।

মিছিলের শেষে তিনি বলেন, ‘ডিউটিতে যারা থাকেন, প্রতি ঘণ্টায় রোগী কেমন রয়েছেন, দেখতে হয়। ডাক্তারদেরও অনেক কষ্ট করে কাজ করতে হয়। পুলিশের মতো। এটা নিয়ে রাজনীতি করতে নামলেন বলে আমাদের নামতে হলো।’

‘রাতের রাস্তা দখল’ করার মধ্যেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে যে ভাঙচুর চলে, সেটিকে ‘রাম-বাম’, অর্থাৎ বিজেপি এবং বামেদের কাজ বলে তিনি আবারও মন্তব্য করেছেন শুক্রবার।

আবার শুক্রবার সকাল থেকে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিরুদ্ধে ১২ ঘণ্টার বনধ ডেকেছিল এসইউসিআই দলটি। তাদের ক্যাডাররা অনেক জায়গায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছেন।

রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আবার শুক্রবার কলকাতায় ধর্না-অবস্থান, জেলায় জেলায় রাস্তা অবরোধ আর দুপুরে দুই ঘণ্টার জন্য ‘সামাজিক কর্মবিরতি’র ডাক দিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশ্যে এক মশাল মিছিলও করার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে।

তবে মিছিল শুরুর আগেই পুলিশ বিজেপি নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ায় সেই মিছিল আর হয়নি।

এর আগে কলকাতার শ্যামবাজারে বিজেপির ধর্না অবস্থান মঞ্চ পুলিশ ভেঙে দিয়েছিল। সেখান থেকেও বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অন্যদিকে বামদলগুলোও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বলেছে, ‘দফা এক, দাবি এক, মমতা ব্যানার্জীর পদত্যাগ’।

এর আগের বহুল আলোচিত গণধর্ষণ ও হত্যার মামলাগুলোতে মমতা ব্যানার্জী ‘ছোট ঘটনা’, ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র মতো আর কী কী মন্তব্য করেছিলেন, সেগুলোও তুলে ধরছে বামদলগুলো।

কেন এতদিন পরে রাস্তায় দলগুলো?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্যের কথায়, ‘সাধারণ মানুষ একটা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে ইনাফ ইজ ইনাফ, তোমরা যদি নারী নিরাপত্তার ইস্যুতে শুধুই রাজনীতিই করে যাও, তাহলে আমাদের ব্যবস্থা আমরাই করে নেয়ার ক্ষমতা রাখি।’

কলকাতার একজন পেশাজীবি ও সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় নারী সুজাতা ঘোষ বলছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো শুক্রবার পথে নামছে, কেউ ফাঁসি চাইছেন, কেউ মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইতে তার বাড়ির দিকে মিছিল করছেন।

‘অথচ বুধবারের আগে, অর্থাৎ ওই মাঝরাতের জনসমুদ্র দেখার আগে কিন্তু এইসব রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো আমরা দেখতে পাইনি। মাঝরাতের ওই লাখো মানুষের ভিড় দেখে এখন দলগুলোর মনে হচ্ছে স্বতঃ:স্ফূর্তভাবে মানুষ যখন নেমে গেছে, আমরা যদি এখন না নামি তাহলে দলীয় সমর্থকরা প্রশ্ন তুলবে, তাই এখন তারা মাঠে নেমেছে,’ বলছিলেন সুজাতা ঘোষ।

তার কথায়, ‘একটা পাবলিক পার্সেপশান তৈরি হয়েছে আরজি করের ঘটনায় যে শুধু কি একজনই এই ঘটনায় জড়িত? না কি আরো কেউ আছে? তাদের কী আড়াল করা হচ্ছে?’

‘এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ওই রাতের রাস্তা দখলে নেমে মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে যে রাজনৈতিক দল বা সরকারের ওপরে আর তারা ভরসা করতে পারছে না।’

সাধারণ মানুষের এই ধারণা নিয়ে শুক্রবার কলকাতার পুলিশ কমিশনার ভিনিত গোয়েল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বহু ধরণের গুজব ছড়ানো হচ্ছে আরজি করের ঘটনা নিয়ে। তারা আরো দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন ইত্যাদি যা সব বলা হচ্ছে, বিষয়টা পুরোটাই তারা তদন্ত করে দেখছিলেন অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে। আদালতের নির্দেশে এখন যখন সিবিআই তদন্ত করছে, তারাও খতিয়ে দেখতে পারে যে পুলিশ যখন তদন্ত করছিল তখন কোনও খামতি ছিল কী না।

গোয়েল আরো বলেন, বুধ-বৃহস্পতিবার রাতে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে যে ভাঙচুর হয়, সেই ঘটনায় এখনো পর্যন্ত তারা ২৫ জনকে গ্রেফতার করেছে।

ফেসবুকে সেই রাতের ভাঙচুরের ছবি দিয়ে হামলাকারীদের মুখ গোল করে চিহ্নিত করে কলকাতা পুলিশ সাধারণ মানুষের কাছে আর্জি জানাচ্ছে চিহ্নিত ব্যক্তিদের পরিচয় জানতে। সেই অনুযায়ীই গ্রেফতারি চলছে।

বিরোধী দলের প্রতি ভরসা নেই?
‘রাতের রাস্তা দখল’ করতে লাখ লাখ মানুষ যেভাবে নেমেছিলেন, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কলামিস্ট শুভাশিস মৈত্রর মনে হয়েছে যে সাধারণ মানুষের অনেক কিছু বলার আছে, যা তারা এতদিন বলতে পারছিলেন না।

‘বোঝা যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জীর প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনেক কিছু সম্ভবত বলতে চাইছেন সাধারণ মানুষ, তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরেও তারা খুব একটা ভরসা করছেন না নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে। তাই নিজেরাই রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন সেই রাতে,’ বলছিলেন তিনি।

তার কথায়, “ওটা একটা অভূতপূর্ব প্রতিবাদ হয়েছিল। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরে অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে এই ‘রাস্তা দখল’ কতটা প্রভাব ফেলবে বা আদৌ ফেলবে কী না অথবা দলগুলো কী শিক্ষা নেবে, সেটা বলার সময় এখনও আসেনি।“

নারী আন্দোলনের কর্মী অধ্যাপিক শাশ্বতী ঘোষ বলছিলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার ফাঁসির দাবিতে মিছিল করছেন, তবে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা তো তার হাতে, তার পুলিশের হাতেই ছিল। ব্যবস্থা তো তিনিই করতে পারতেন।’

‘এখন রাতের রাস্তা দখল কর্মসূচির পরে সব দলই সাধারণ মানুষের সেই আন্দোলনটাকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। সেদিন অবশ্য অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিই দলীয় পরিচয় ছাড়া যোগ দিয়েছিলেন।’

‘তবে ওই বিপুল জনসমাগম দেখে, তাদের এখন মনে হচ্ছে যে আমরা দলীয়ভাবে কিছু করব না? পথে না নামলে তো কর্মীরা আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলবে। শুক্রবার তারা সাধারণ মানুষের চাপে পড়ে মিছিল করতে বাধ্য হচ্ছেন,’ বলছিলেন শাশ্বতী ঘোষ।

ওদিকে ‘রাতের রাস্তা দখল’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে অদলীয় ব্যক্তিরা কাজ করেছেন, তারাও ভবিষ্যত পরিকল্পনা শুরু করেছেন।

এখনো পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা না করা হলেও বেশ কিছু সম্ভাবনা নিয়ে তারা ভাবনা-চিন্তা ও আলোচনা করছেন নিজেদের মধ্যেই।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement