২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভারতের হাসপাতালগুলো রাতের বেলায় কতটা নিরাপদ

- ছবি : সংগৃহীত

ভারতের কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক তরুণী চিকিৎসককে হাসপাতালের ভেতরেই ধর্ষণ করে হত্যা করার ঘটনার প্রতিবাদ বুধবার আরো বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের অন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন চলছিল।

বুধবার পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বহির্বিভাগে রোগী দেখা বন্ধ করেছেন।

অন্য দিকে বুধবার রাতে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ডাক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এক শ’রও বেশি জমায়েত হতে চলেছে, জমায়েত হবে রাজধানী দিল্লির বাঙালি পাড়া বলে পরিচিত চিত্তরঞ্জন পার্কেও।

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসককে তার কর্মস্থলেই ধর্ষণ করে হত্যা করার ঘটনায় আন্দোলনকারীরা বিচার যেমন চাইছেন, তেমনই হাসপাতালগুলোতে কাজ করেন যে সব নার্স ও নারী চিকিৎসকরা, তাদের ভাবাচ্ছে হাসপাতালে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিও।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেটের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ভারতে স্বাস্থ্য-কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ১৫৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

রাতের হাসপাতালগুলোতে কেমন থাকে নিরাপত্তাব্যবস্থা? স্বাস্থ্য-কর্মীরা কতটা নিরাপদ?

সেই খোঁজ নিয়েছেন ভারতের চারটি বড় শহরের বিবিসির সংবাদদাতারা।

কলকাতা
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের যে ভবনটির চারতলায় গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় কর্তব্যরত এক নারী চিকিৎসককে, সেই জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল এক জুনিয়র ডাক্তার সুস্মিতা চক্রবর্তির সাথে।

তিনি বলছিলেন যে ওই ঘটনার আগে তারা নিশ্চিন্তে কাজ করতেন, ভাবতেন হাসপাতালটাই তাদের দ্বিতীয় বাড়ি। তবে একটা ঘটনা সম্পূর্ণ বদলিয়ে দিয়েছে তার ভাবনা।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না কোনো মেয়ে আর এখানে সেফ ফিল করে। প্রত্যেকটা কোনাতে যেতে ভয় করছে আমাদের হসপিটালে।’

নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে ‘নাইট ডিউটি’ কতটা দুর্ভাবনার, তা সম্প্রতি এক নারী চিকিৎসক নম্রতা মিত্র লিখেছিলেন তার ফেসবুক ওয়ালে। তিনি আরজি কর মেডিক্যাল কলেজেরই ছাত্রী ছিলেন।

পেশায় প্যাথলজিস্ট ডা. মিত্র জানান, রাতের ডিউটি থাকলে তিনি বাবাকে সাথে করে নিয়ে যেতেন। অনেকে তা নিয়ে হাসাহাসিও করত।

তিনি লেখেন, ‘অন কল ডিউটির সময় বাবাকে সাথে নিয়ে যেতাম। সবাই হাসত। কিন্তু একটা লম্বা, অন্ধকার করিডোরের শেষে একটা ঘরে ঘুমোতে হতো। একটা লোহার গেট বন্ধ থাকত, যাতে কোনো রোগী এলে শুধু নার্সরাই সেটা খুলতে পারতেন।’

তিনি বলেন, ‘আমি স্বীকার করতে লজ্জা পাই না যে আমি ভয় পেয়েছিলাম। যদি ওয়ার্ডের কেউ একজন ওয়ার্ড বয় বা এমনকি একজন রোগীও যদি কিছু করার চেষ্টা করে? আমার বাবা একজন ডাক্তার ছিলেন বলে আমি সুযোগ নিয়েছি, কিন্তু সবার সেই সুযোগ নেই।’

সদ্য পাশ করে ডাক্তারির স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের শরণ্যা রায়।

তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ওয়ার্ডের পাশে অন কল রুম আছে। মেয়েদের বা ছেলেদের আলাদা রুম নেই। আমরা ইন্টার্নরা আর হাউস-স্টাফরা ভাগাভাগি করে থাকতাম। ছেলে হোক বা মেয়ে- ওই ঘরেই থাকতে হতো। ছেলেরা যারা থাকত, তারা আমারই সহপাঠী। তবে বিশ্রাম নেয়ার দরকার পড়লে একজন বিশ্রাম নিতাম, অন্যজন রোগী দেখত। পাশে অ্যাটাচড ওয়াশরুমও ছিল।’

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের যে চিকিৎসক ধর্ষণের শিকার ও খুন হয়েছেন, তিনি রাতের ডিউটি করার ফাঁকে একটু বিশ্রামই নিচ্ছিলেন, যে সময়ে তার ওপরে এই নৃশংস আক্রমণ হয়।

শরণ্যা রায় বলেন, ‘কলেজে পড়ার সময়ে নিরাপত্তা নিয়ে অতটা মাথাও ঘামাইনি। নিরাপত্তারক্ষী আর জরুরি বিভাগের সামনে পুলিশ দেখতাম। সিসি ক্যামেরাও ছিল, কিন্তু কতগুলো ছিল বা সেগুলো কাজ করে কি না, কেউ নজর রাখে কিনা- এসব নিয়ে ভাবিনি। এখন এই ঘটনার পরে সেসব ভাবতে গিয়ে দেখছি যে ব্যবস্থা খাতায় কলমে তো অনেক কিছুই আছে, তবে সেসবের সুপারভিশন হয় কিনা তা তো জানি না!’

আবার কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়ার ডাক্তার মধুপর্ণা নন্দী বলেন, তার কলেজে নারী চিকিৎসকদের জন্য আলাদা বিশ্রামের ঘর বা বাথরুম- কিছুই নেই।

তার কথায়, ‘রোগী বা নার্সদের বাথরুম ব্যবহার করতে হয়। দীর্ঘক্ষণ কাজ করার পরে যদি একটু বিশ্রাম নেয়ার দরকার হয়, তাহলে রোগীদের ফাঁকা বিছানায় শুতে হয়।’

দিল্লি
রাজধানী দিল্লিতে তিনটি বড় সরকারি হাসপাতাল। তারই একটি লোকনায়ক হাসপাতাল। প্রবেশ পথে একটা মেটাল ডিটেক্টর আছে, তবে তা কাজ করে না দেখা গেল।

বিবিসির সংবাদদাতা উমাঙ্গ পোদ্দার যখন ওই হাসপাতালে ঢুকছিলেন, কেউ তার তল্লাশি নেয়নি। স্ত্রীরোগ বিভাগের রক্ষী অবশ্য জানতে চেয়েছিলেন কেন তিনি সেখানে গেছেন, তারপরে আর কোনো প্রশ্ন করা হয়নি।

এক সিনিয়র ডাক্তার বলেন, ‘যে কেউ অবাধে যাতায়াত করতে পারে। সিসিটিভি আরো লাগানো দরকার, আর যেগুলো আছে, সেগুলোতে কেউ নজরও দেয় না।’

আবার জিবি পন্থ হাসপাতালে কর্মরত এক নার্স বলেন, ‘আমাদের আরো ভালো নিরাপত্তা দরকার। বাউন্সার রাখা যেতে পারে যাতে রোগীদের সাথে আসা ব্যক্তিদের উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহার থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষা করা যায়।’

চেন্নাই
ওমানদুরার সরকারি মেডিক্যাল কলেজটি চেন্নাইয়ের একেবারে কেন্দ্রস্থলে। রাত সাড়ে ৯টায় ওই হাসপাতালে যখন নিজের গাড়ি পার্ক করেন বিবিসির সংবাদদাতা শারদা ভি, একজন গার্ড এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

বিবিসির সংবাদদাতা দেখেন যে ‘অ্যাডমিশন ব্লক’-এর বাইরে আবছা আলোয় সিঁড়িতে বসে আছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা। জরুরি বিভাগে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই পুলিশ সদস্য।

নাইট শিফটে কর্মরত ইন্টার্ন অবর্ণা বলেন, কলকাতার ঘটনা নারী স্বাস্থ্য-কর্মীদের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি করেছে। হাসপাতাল প্রশাসন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে বৈঠক করেছে।

নির্দেশ দেয়া হয়েছ, ইন্টার্নদের স্টাফ-রুম ব্যবহার করতে হবে, ঘরে তালা দিয়ে রাখতে হবে।

জরুরি বার্তা দিতে পুলিশের অ্যাপ ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

চিকিৎসকদের নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেয়া অবর্ণা বলেন, ‘ওয়ার্ডগুলোতে ইন্টারকম সুবিধা ও ইমার্জেন্সি বাটন থাকলে তা সহায়তা করবে।’

রাজ্যের শীর্ষ হাসপাতাল ওমানদুরার মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতালে কর্মরত এক স্টাফ নার্স অভিযোগ করেন, রাতের ডিউটির মধ্যে বিশ্রাম নেয়ার মতো জায়গা নেই সেখানে। রাতের ডিউটিতে কাজ করতে হলে একটা চেয়ার আর একটা লম্বা ডেস্ক ব্যবহার করতে হয়।

মুম্বাই
সোমবার বেশি রাতে মুম্বাইয়ের জেজে হাসপাতালে যখন প্রবেশ করছিলেন বিবিসি সংবাদদাতা দীপালি জগতাপ, মূল প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তারক্ষীদের উপস্থিতি তার নজরে এসেছে। তারা হাসপাতাল ক্যাম্পাসে যেতে পারলেও অনুমতি ছাড়া মেডিক্যাল ওয়ার্ডে যেতে পারেননি।

তবে কয়েকজন নারী চিকিৎসক ও নার্স জানান, রাতের শিফটে কাজ করার সময় তারা নিরাপদ বোধ করেন না।

রেসিডেন্ট ডাক্তার অদিতি কানাডে বলেন, ‘প্রশাসনের উচিত মেডিক্যাল ওয়ার্ডে এবং ক্যাম্পাসের বাইরে নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা বাড়ানো। হাসপাতাল ক্যাম্পাসটি বেশ বড় এবং অনেক এলাকায় আলো নেই। এমন পরিস্থিতিতে রাতে হোস্টেল থেকে মেডিক্যালের ওয়ার্ডে যেতে ভয় লাগে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কোনো রুম বা করিডোরে সিসি ক্যামেরা নেই। সব জায়গায় দরকার এগুলো। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে নারী চিকিৎসকদের জন্য একটা আলাদা ঘর করা দরকার, কিন্তু সেটা তো নেই!’

এক কর্তব্যরত নার্স হেমলতা গজবে জানান, ‘রোগীদের আত্মীয়স্বজনরা উত্তেজিত হয়ে অনেক সময়েই গালাগালি করেন, কেউ নেশা করে থাকেন আবার কেউ রাজনৈতিক চাপ দেয়ার চেষ্টা করেন। এসব সময়ে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকেই পাওয়া যায় না।’

নিরাপত্তার জন্য যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুরো ভারতের হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে, বিক্ষোভ হচ্ছে।

এরই মধ্যে জাতীয় মেডিক্যাল কমিশন মঙ্গলবার একটি নির্দেশিকা জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, নিরাপদ কর্মস্থল গড়ার জন্য প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজকে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ওই নীতিমালায় শিক্ষক, ছাত্র এবং রেসিডেন্ট ডাক্তারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। বহির্বিভাগ, ওয়ার্ড, হস্টেল এবং সব উন্মুক্ত জায়গায় যেন সন্ধ্যার পর থেকে যথেষ্ট আলো থাকে, সিসিটিভির নজরদারি যাতে চলে।

ছাত্রছাত্রীদের ওপরে যেকোনো সহিংস ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে পুলিশকে খবর দিতে হবে। জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনকে সেই তথ্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে।

আবার আসামের শিলচরের মেডিক্যাল কলেজ নারীদের জন্য অন্যরকম পরামর্শ দিয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, নারী চিকিৎসক, ছাত্রী এবং অন্য কর্মীদের সেইসব জায়গা এড়িয়ে চলা উচিত, যেগুলো কিছুটা নির্জন বা যেখানে পর্যাপ্ত আলো নেই। একা চলাফেরা করা এড়িয়ে চলতে হবে নারী চিকিৎসক ও ছাত্রীদের। খুব দরকার না পড়লে রাতে হোস্টেল থেকে না বের হওয়া ভালো। অচেনা মানুষজনকে এড়িয়ে চলা উচিত।

শিলচর মেডিক্যাল কলেজের এই পরামর্শ নিয়ে বুধবার সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক চলছে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
৭ উইকেট তুলে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চেপে ধরেছে বাংলাদেশ লাখ টাকার প্রলোভনে শাহবাগে এত লোক কিভাবে এলো? কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েদির মৃত্যু হিজবুল্লাহ কমান্ড সেন্টারে ইসরাইলি হামলা রাজশাহীতে প্রথম আলো পত্রিকায় আগুন ও সাইনবোর্ড ভাঙচুর রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে : পররাষ্ট্র সচিব আড়াইহাজারে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, আহত ১৬ শ্রম সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতিতে মার্কিন প্রতিনিধিদলের প্রশংসা আইপিএলে রেকর্ড গড়লেন ১৩ বছর বয়সী বৈভব সিলেটে ট্রাক ও বাসচাপায় নিহত ২ মানিকগঞ্জে প্রলোভন দেখিয়ে শাহাবাগে লোক নেয়ার মূলহোতা দবিরসহ আটক ৫

সকল