ইভটিজিং করে চাকরি হারানো পুলিশ কনস্টেবল যেভাবে হয়ে উঠলেন ‘ভোলে বাবা’
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ জুলাই ২০২৪, ২০:৫৬
সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যদের দ্রুত পায়ে বাস থেকে নেমে আসা, জুতো-চপ্পলের স্তূপ, টিভি সাংবাদিকদের সরাসরি রিপোর্টিং আর এসবের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের খুঁজতে থাকা মানুষের ভিড়। মঙ্গলবার গভীর রাতে এরকমই ছিল হাথরস জেলার সিকান্দ্রারাউ হাসপাতালের দৃশ্য।
তবে মঙ্গলবার দিনের বেলা এক ধর্মীয় জমায়েতে পদপিষ্ট হয়ে এখনো পর্যন্ত ১২২ জনের মৃত্যুর পেছনের কাহিনী শুধু ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে যে ওই ধর্মীয় জমায়েত, যেগুলিকে ‘সৎসঙ্গ’ বলা হয়ে থাকে, সেটির আয়োজকরা অনুমতি নিয়েছিলেন ৮০ হাজার মানুষের জমায়েতের। প্রকৃতপক্ষে এর কয়েক গুণ বেশি মানুষ মঙ্গলবার জড়ো হয়েছিলেন‘ভোলে বাবা’ নামে পরিচিত ওই স্বঘোষিত ধর্ম প্রচারকের সভায়।
আবার এই ‘ভোলে বাবা’ কীভাবে ইভটিজিংয়ের দায়ে পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে, জেল খেটে বেরিয়ে ধর্মগুরু হয়ে উঠলেন, সেটিও যেন এক সিনেমার গল্প।
এখন ওই স্বঘোষিত ধর্ম প্রচারকের খোঁজে তার কয়েকটি আশ্রমে তল্লাশি চালাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।
তবে বুধবার যে এফআইআর দায়ের হয়েছে, সেখানে ওই ধর্ম প্রচারকের নাম নেই বলে জানিয়েছেন সংবাদদাতারা।
ছিলেন পুলিশ, জেল থেকে বেরিয়ে হলেন ‘বাবা’
উত্তর প্রদেশ পুলিশ জানিয়েছে ‘ভোলে বাবা’ নামে পরিচিত নারায়ণ সাকার হরির আসল নাম সুরজ পাল জাটভ।
কাসগঞ্জ জেলার বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা সুরজ পাল উত্তর প্রদেশ পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। চাকরি জীবনের গোড়ার দিকে বেশ কয়েক বছর পুলিশের স্থানীয় গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন তিনি। প্রায় ১৮টি থানা এলাকায় কাজ করেছেন তিনি।
প্রায় ২৮ বছর আগে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ দায়ের হয় তার বিরুদ্ধে। প্রথমে সাসপেন্ড করা হয়েছিল সুরজ পালকে, পরে বরখাস্ত হন তিনি।
ইটাওয়া জেলার সিনিয়র পুলিশ সুপার সঞ্জয় কুমার জানিয়েছেন, ওই ইভটিজিংয়ের ঘটনায় বেশ লম্বা সময় জেলে ছিলেন সুরজ পাল জাটভ। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে ‘বাবা’র রূপ ধরেন তিনি।
বরখাস্ত হওয়ার পরে সুরজ পাল জাটভ আদালতে গিয়েছিলেন নিজের চাকরি ফিরে পেতে। আদালত চাকরি ফিরিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু ২০০২ সালে আগ্রা জেলায় কর্মরত অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসর নেন সুরজ পাল।
এরপর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। কিছুদিন পরে তিনি দাবি করতে থাকেন যে সরাসরি ঈশ্বরের সাথে কথা হয় তার। ওই সময় থেকেই নিজেকে‘ভোলে বাবা’ হিসাবে তুলে ধরতে থাকেন সুরজ পাল।
ভক্তের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে ওঠে
কয়েক বছরের মধ্যেই ‘ভোলে বাবা’র ভক্ত সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ওঠে। এই ভক্তকুলই তার হয়ে বড় বড় ধর্মীয় জমায়েতের আয়োজন করতে থাকে। ওইসব জমায়েতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করেন।
সিনিয়র পুলিশ সুপার সঞ্জয় কুমার বলেন, ৭৫ বছর বয়সী সুরজ পাল ওরফে ‘ভোলে বাবা’রা তিন ভাই। ইনিই সবার বড়।
নিজের ধর্মীয় জমায়েত বা ‘সৎসঙ্গ’ এ ভোলে বাবা একাধিকবার দাবি করেছেন, সরকারি চাকরি থেকে তাকে যে কে এদিকে টেনে আনল, তা তিনি নিজেও জানেন না।
এ ধরনের স্বঘোষিত ধর্মগুরুদের বেশিরভাগকেই দেখা যায় ভক্তদের কাছ থেকে বিপুল ধনসম্পত্তি ‘দান’ হিসেবে গ্রহণ করেন।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে এই ‘ভোলে বাবা' ওরফে নারায়ণ সাকার ভক্তদের কাছ থেকে কোনো দান, দক্ষিণা ইত্যাদি গ্রহণ করেন না। যদিও বেশ কয়েকটি আশ্রম তৈরি করেছে তার চ্যারিটেবল ট্রাস্ট।
অন্য হিন্দু ধর্ম গুরুদের মতো গেরুয়া বসন পরেন না ভোলে বাবা। সবসময়েই তার পরিধানে থাকে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি বা জামা-প্যান্ট অথবা স্যুট।
ভোলে বাবার সৎসঙ্গে যারা আসেন, তাদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির এবং অনগ্রসর জাতির মানুষ।
স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, ভোলে বাবা গত কয়েক বছরে হাথরাসে বহুবার সৎসঙ্গ করেছেন এবং প্রতিবারই আগেরবারের থেকে বেশি ভিড় হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিক বি এন শর্মা বলেন,‘বাবার সৎসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে ঢুকতে দেয়া হয় না, ভিডিও করাও নিষিদ্ধ। তার নিরাপত্তায় সৎসঙ্গীদের একটি বড় দল থাকে যারা তাকে ঘিরে রাখেন। তাই ভোলে বাবার কাছাকাছি পৌঁছানো বেশ কঠিন।’
বিপুল সংখ্যক ভক্ত থাকলেও সামাজিকমাধ্যমে‘ভোলে বাবা'র উপস্থিতি খুব একটা বেশি দেখা যায় না। তার ভক্তদেরও সেরকম উপস্থিতি নেই সামাজিকমাধ্যমে।
বাস্তবে লাখ লাখ ভক্ত থাকলেও ফেসবুকে তার জমায়েতগুলোর ‘লাইভ’ প্রায় নেই বললেই চলে।
যেসব সৎসঙ্গ আয়োজন করেন তার ভক্তরা, সেগুলিতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকরাই।
জল, খাবার, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ সব কিছুরই দায়িত্ব থাকেন এই স্বেচ্ছাসেবকরাই।
তবে এর আগেও তার ‘সৎসঙ্গ’এ অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল।
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নেয়া রামনাথ সিং ইয়াদভ বলেন,‘আজ থেকে বছর তিনেক আগে ইটাওয়া জেলায় ভোলে বাবার এক জমায়েত চলেছিল প্রায় মাস খানেক ধরে। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণের সেখানেও হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে ভবিষ্যতে যেন এ রকম জমায়েতের অনুমতি না দেয়া হয়।’
‘বাবা’র পায়ের ধুলো নিতে হুড়োহুড়ি
মঙ্গলবারের ‘সৎসঙ্গ’-এ হাজির থাকা ভক্তরা জানাচ্ছেন জমায়েত শেষ হয়ে যাওয়ার পরে‘বাবা’র পায়ের ধুলো সংগ্রহ করতে গিয়েই হুড়োহুড়িটা শুরু হয়।
ঘটনাস্থল সিকান্দ্রারাউ শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ফুলরাই গ্রাম। জাতীয় মহাসড়ক ৩৪-এর ধার ঘেঁষে বিরাট এলাকা জুড়ে তাঁবু ফেলা হয়েছিল। এখন খুব দ্রুততার সাথে ওই তাঁবু খুলে ফেলা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন বেশিরভাগ মানুষ পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন মহাসড়কের পাশের জায়গাটিতেই।
ওই ধর্ম প্রচারক ‘ভোলে বাবা’র প্রস্থানের জন্য আলাদা পথ করা হয়েছিল। সৎসঙ্গ শেষ হতেই মহাসড়কের পাশে‘বাবা’র দর্শনের জন্য বহু নারী ভিড় করেছিলেন।
মঙ্গলবার বৃষ্টি হয়েছিল, তাই মাটি ভেজা ছিল। ‘ভোলে বাবা’র পায়ের ধুলো নেয়ার জন্য নিচে ঝুঁকেছিলেন অনেক ভক্ত। হুড়োহুড়িতে পা পিছলিয়ে ওখানেই পড়ে যান বহু মানুষ। একবার যারা পড়ে যান, তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি।
তবে কথিত ধর্মগুরু‘নারায়ণ সাকার বিশ্ব হরি' ভক্তদের জন্য না থেমে এগিয়ে যেতে থাকেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। যদিও ওই বা সৎসঙ্গের আয়োজকদের তরফ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
প্রিয়জনের খোঁজে
মঙ্গলবারের ঘটনার শুরু দুপুর আড়াইটা নাগাদ।
আহতদের তড়িঘড়ি করে সিকান্দ্রারাউ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছানো সাংবাদিকরা বলেছেন যে ট্রমা সেন্টারের সামনে লাশগুলি স্তূপ করে রাখা হয়েছিল।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে হাথরসে সাংবাদিকতা করা বি এন শর্মা বলেন, ‘আমি এখানে বিকেল ৪টায় পৌঁছাই। চারিদিকে লাশ পড়ে ছিল। একটা মেয়ে তখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছিল, কিন্তু চিকিৎসা না পেয়ে আমার সামনেই মারা যায় মেয়েটি।’
সিকান্দ্রারাউয়ের সব থেকে বড় হাসপাতাল এটি, কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনা সামাল দেয়ার জন্য ওই হাসপাতালটির পরিকাঠামো নেই।
একদিকে যখন লাশের স্তূপ দেখা গেছে, অন্যদিকে ঘটনার খবর পেয়ে নিকটাত্মীয়দের খোঁজে ওই হাসপাতালেই সন্ধ্যা থেকে পৌঁছাতে শুরু করেন বহু মানুষ।
মথুরার বাসিন্দা এবং গুরুগ্রামে কলের মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করা বিপুল তার মাকে খুঁজতে কয়েকজন বন্ধুর সাথে ভাড়া করা ট্যাক্সিতে রাত ১১টা নাগাদ সিকন্দ্রারাউ পৌঁছান।
হাথরাসের জেলা হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন বিপুল। তবে প্রায় ৩০টি লাশের মধ্যেও নিজের মাকে খুঁজে পাননি তিনি।
সেখান থেকে রাত ২টা নাগাদ আলিগড়ের জেএন মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছন তিনি। সেখানেও মাকে পাননি বিপুল।
তিনি বলেন,‘আমার মা সোমবতী প্রায় এক দশক ধরে বাবার সৎসঙ্গের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাবার প্রতি তার গভীর বিশ্বাস ছিল। মায়ের সাথে থাকা অন্য কয়েকজন নারী আমাকে জানান যে মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তখনই গুরুগ্রাম থেকে রওনা হই।’
আরো অনেক জেলা থেকে আসা মানুষরা হাসপাতালগুলোতে ঘুরছিলেন প্রিয়জনকে খুঁজে পেতে।
কাসগঞ্জ জেলা থেকে আসা শিবম কুমারের মাও নিখোঁজ। যতক্ষণে তারা হাসপাতালে পৌঁছান, তার আগেই লাশগুলি অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মায়ের আধার কার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি।
আলিগড়ের বাসিন্দা বান্টির কাছে হাসপাতালের বাইরের একটি ভিডিও ছিল, যেখানে তার মা মহরি দেবীসহ বেশ কয়েকজন নারীর লাশ মাটিতে শোয়ানো ছিল। গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিও দেখে মাকে শনাক্ত করেন বান্টি।
তবে তার লাশ যে কোথায় আছে, তা এখনো জানেন না তিনি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা