০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জিলহজ ১৪৪৫
`

প্রতিশ্রুতি-ছাড় ছাড়াই তালেবান-জাতিসঙ্ঘ আলোচনা শেষ

কাতারের দোহায়া আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের জাবিউল্লাহ মুজাহিদ (মাঝে ডানে) রাশিয়ার দূত জামির কাবুলভের সাথে কথা বলেন - ছবি : সংগৃহীত

আফগানিস্তানের সাথে সম্পৃক্ততার উপায় সন্ধানের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে তৃতীয় দফা আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে। তবে তালেবান কোনো রকম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়নি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো ধরণের ছাড়ও পায়নি।

কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং আফগানিস্তান বিষয়ে প্রায় দুই ডজন রাষ্ট্রের দূত তালেবান কর্মকর্তাদের সাথে কাতারের দোহায় দু’দিনব্যাপী এই বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের সভাপতি রাজনৈতিক ও শান্তি প্রতিষ্ঠাবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রোজম্যারি ডি কার্লো সংবাদদাতাদের জানান যে এই আলোচনা ছিল 'গঠনমুলক' এবং 'প্রযোজনীয়'।

ডি কার্লো বলেন, 'এই প্রথম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ এবং (আফগানিস্তানের) ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের এমন বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। এই আলোচনা ছিল খোলামেলা এবং, আমার বিশ্বাস, প্রয়োজনীয়।'

এক বছর আগে এই 'দোহা প্রক্রিয়া'র সূচনা করেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ।

এই সর্বসাম্প্রতিক দফার আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা এই যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে রাজি হলেও, তালেবান নারী শিক্ষা ও জনজীবনে তাদের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেয়া পর্যন্ত ডিকার্লো কাবুলের ক্ষমতাসীন শাসকদের স্বীকৃতি দেয়ার কথা নাকচ করে দিয়েছেন।

নিজ নিজ দেশের সিদ্ধান্ত

জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তা বলেন, 'আফগানিস্তান যদি তার জনসংখ্যার অর্ধেকের অবদান ও সম্ভাবনা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখে তা হলে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরে আসতে পারবে না কিংবা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে উন্নত করতে পারবে না।' তিনি আরো বলেন যে তালেবানের শাসনের বিষয়ে এই আন্তর্জাতিক সংঠনের কোন নির্দেশনা নয়, নির্ভর করছে নিজ নিজ দেশের সিদ্ধান্তের উপর।

আফগানিস্তানে যদিও প্রায় ১৬টি রাষ্ট্রের দূতাবাস রয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না কারণ এ সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় এবং সে দেশে নারী ও শিশুদের অধিকারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।

নারীর অধিকার আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও ডিকার্লো বলেন, আলোচনার সবটুকু জুড়েই অংশগ্রহণকারীরা এই বিষয়টা উত্থাপন করেন এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক সরকারের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেন। দু’দিনব্যাপী এই আলোচনায় বেসরকারি ব্যবসা ক্ষেত্র এবং মাদকবিরোধী অভিযানে তালেবানের অর্জন বহাল রাখতে সাহায্য করার উপর আলোকপাত করা হয়।

আলোচনার পর তালেবানের প্রতিনিধিদলের প্রধান জাবিউল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ বলেন, 'আফগানিস্তারে বার্তাটি অংশগ্রহণকারী সকল দেশের কাছে পৌঁছেছে।' তিনি বলেন, তার দেশ চায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

পটভূমি সম্পর্কে পশ্চিমের একজন কূটনীতিক ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, আফগান প্রতিনিধিদলের সদস্যরা 'খুবই দক্ষ' এবং তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান অত্যন্ত 'আকর্ষণীয়।'

এক্স-এ আগের এক পোস্টে তালেবানের এই প্রধান মুখপাত্র মুজাহিদ সাফল্য দাবি করেন। পোস্টে বলা হয়, 'এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।'

শতাধিক তালেবান সদস্য আর্থিক নিষেধাজ্ঞাসহ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকলেও আফগানিস্তানে ব্যাংকগুলো নিষেধাজ্ঞামুক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং আর্থিক লেনদেনের প্রধান ব্যবস্থা সুইফট (SWIFT) থেকে বিচ্ছিন্ন। কারণ পশ্চিমের ব্যাংকগুলো আফগান ব্যাংকগুলোর সাথে কাজ করতে এবং তারা যে খ্যাতি ও আর্থিক ঝুঁকিগুলোর সমুখীন, সেখানে নিজেদের প্রকাশ করতে আশঙ্কা বোধ করছে।

এই আলোচনায় একান্তভাবে পাশ্চাত্যের এক কূটনীতিক বলে,ন কোনো দেশ কোনো নতুন নীতি চালু করেনি।

২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালেবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক তহবিলের ৯৫০ কোটি ডলার আটকে দিয়েছে। ২০২২ সালে বাইডেন প্রশাসন ওই অর্থের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার সুইটজারল্যান্ডভিত্তিক একটি ট্রাস্ট হিসেবে নিয়ে আসেন। ওই হিসেবের নাম, 'ফান্ড ফর দ্য আফগান পিপল' যেটির তত্ত্বাবধান করে একটি ট্রাস্ট। অবশিষ্ট অর্থ আটকে রাখা হয়েছে। চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরান ওই তহবিল অবমুক্ত করার বিষয়টি সমর্থন করে।

‘এটি বুঝতে পারার বিষয়’

সোমবার দিনের শেষে মুজাহিদ বলেন, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এমন কিছু মনে করে তালেবান আসেনি।

তালেবান ও পশ্চিমের মধ্যে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়া সম্পর্কে ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, 'অগ্রগতি এটাই যে প্রত্যেকটি দেশ আফগানিস্তানকে সাহায্য করতে চায়।'

এই বৈশ্বিক বৈঠকে তালেবানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আফগান নাগরিক সমাজের সক্রিয়বাদীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জাতিসঙ্ঘ অধিকার কর্মীদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

ডিকার্লো বলেন, '[আলোচনার] এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার ব্যাপারে আমাদের অনুমোদন রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষকে এবং বিশেষ দূতদের সরাসরি আলোচনায় একত্রে বসানো। দুর্ভাগ্যবশত ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ এই আলোচনায় আফগান নাগরিক সমাজের সঙ্গে বসবে না।'

ভবিষ্যতে তালেবানকে আলোচনার টেবিলে আনতে এই বিশ্বসংগঠন কী ধরণের ছাড় দিতে রাজি হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিকার্লো বলেন, ক্ষমতাসীন শাসকরা কী শর্ত আরোপ করতে চান সে ব্যাপারে তিনি কোনো পূর্বাভাস করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, 'এ নিয়ে আমি কোনো আঁচ-অনুমান করতে পারবো না।আমি এটুকুই কেবল বলতে পারি যে তারা আজ এসেছিল। তারা অত্যন্ত সম্পৃক্ত ছিল।'

অন্তত তিনজন প্রখ্যাত আফগান নারী দোহার এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার জাতিসঙ্ঘের আমন্ত্রণ মঙ্গলবার প্রত্যাখ্যান করেন।

ডিকার্লো বলেন, 'আমি তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানাই। আমরা এখন যে প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রয়েছি সেটি এখন দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এটা খুব সহজে এগিয়ে নেয়ার মতো নয়। আর আমরা যতটা সম্ভব ভালো করার চেষ্টা করবো। আমরা সবাইকে খুষিশ করতে পারবো না।'

তালোবান আরও আলোচনার জন্য ফিরে আসবে কিনা এরকম প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, এটা নির্ভর করছে আলোচনার টেবিলে কে এবং কী রয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমরা প্রতিটি বৈঠকককে আলাদা করে বিবেচনা করবো। আমরা আলোচ্যসূচি এবং এর লক্ষ্য খতিয়ে দেখবো।'

আফগানিস্তান সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বাধীন আলোচনার আগামী পর্বের তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা


আরো সংবাদ



premium cement