যেভাবে বিজেপিকে হটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বড় জয় মমতায়
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৫ জুন ২০২৪, ২২:০৪
লোকসভা নির্বাচনে কোন দল আর প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, সেই তথ্যের পাশাপাশি মোট ভোটের কত অংশ কোন দল পেয়েছে, সেই তথ্যও জানিয়েছে ভারতের নির্বাচন কমিশন।
ওই তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস দল পুরো রাজ্যে ৪৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আর বিজেপি পেয়েছে ৩৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ ভোট। আর বহু দূরের তৃতীয় হিসাবে কংগ্রেস-সিপিআইএম যৌথভাবে পেয়েছে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট।
গত লোকসভা নির্বাচনের (২০১৯ সাল) তুলনায় তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট মাত্র দুই শতাংশ বেশি বেড়েছে। কিন্তু তাদের আসন সংখ্যা বেড়েছে ১৯ শতাংশ।
আবার বিজেপির ভোটও ২০১৯ সালের তুলনায় সামান্যই কমেছে (এক দশমিক আট শতাংশ), কিন্তু তাদের আসন সংখ্যা কমে গেছে ১৬ দশমিক সাত শতাংশ।
সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়ে দেখা যাক কিভাবে তৃণমূল কংগ্রেস এতগুলো আসন বাড়াতে সক্ষম হলো।
কিভাবে এত বেশি আসন পেল তৃণমূল কংগ্রেস?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণের দুটি দিক আছে। একটি যদি হয় তৃণমূল কিভাবে আসন সংখ্যা বাড়াতে পারল আর দ্বিতীয়টি হলো বিজেপি কেন খারাপ ফলাফল করল?
প্রথম দিকটি খতিয়ে দেখে বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ইত্যাদির মতো যেসব সামাজিক প্রকল্পগুলো চালায়- যেগুলোর মাধ্যমে সরাসরি অর্থ পৌঁছায় ভোটারদের হাতে। বিশেষত নারীদের হাতে, সেই ব্যবস্থায় যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে, তা সুনিশ্চিত করতে চেয়েছেন ভোটাররা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবাদ পোর্টাল ‘দ্য ওয়াল’-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক অমল সরকার বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রায় ১১টি এরকম প্রকল্প আছে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষকে সহায়তা করে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের নাম খুব আলোচিত হচ্ছে মঙ্গলবার থেকে, কিন্তু এই প্রকল্প চালুর অনেক আগে থেকেই কিন্তু কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, খাদ্য সাথী, সবুজ সাথীর মতো প্রকল্প আছে। আবার পরিবারে কেউ মারা গেলে তার সৎকারের জন্য অর্থ সহায়তার প্রকল্পও আছে।’
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের এইসব প্রকল্পগুলো থেকে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলো কিন্তু ধরাছোঁয়া যায়, এগুলো কোনো স্লোগান নয়। এর মধ্যে অনেক প্রকল্পই নারীদের জন্য। তাদের কাছে ওই মাসে হাজার টাকা হাতে পাওয়া কিন্তু বড় ব্যাপার, এটা মাথায় রাখতে হবে।’
মমতা ব্যানার্জির দলকে আগের বারের থেকে বেশি আসন পেতে তাই এ ধরনের প্রকল্পগুলো যে বেশ সহায়তা করেছে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক পোস্ট দেয়া বহু সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বিজেপি এবং বামপন্থীদের সমর্থক, এমন অনেককেই দেখা যাচ্ছে মঙ্গলবার রাত থেকেই এমন কথা লিখতে যে ‘শিক্ষার থেকে ভিক্ষার পাত্রই বড় হলো’, অর্থাৎ সামাজিক প্রকল্পে যে আর্থিক সুবিধা পান মানুষ, সেগুলোকে ভিক্ষার পাত্র বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
নারীদের বিপুল সমর্থন মমতার প্রতি
গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে দেখা গেছে যে পশ্চিমবঙ্গের নারী ভোটারদের একটা বড় অংশ মমতা ব্যানার্জিকেই সমর্থন করছেন।
এই নির্বাচনে নারীরা তৃণমূল কংগ্রেসকে কী পরিমাণে ভোট দিয়েছেন, সেই হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলেন, ‘অনেক আসনেই দেখা গেছে যে নারী ভোটাররাই বুথে বেশি সংখ্যায় এসেছেন ভোট দিতে। এর একটা কারণ যে অনেক পরিযায়ী শ্রমিক হয়তো এবার ভোট দিতে আসতে পারেননি। তাই কিছু ক্ষেত্রে নারী ভোটারদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি নথিভুক্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু সামাজিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে একজন নারীও যে সরকার গঠনে ভূমিকা পালন করতে পারছেন, এই ভাবনাটা পশ্চিমবঙ্গের নারীদের মধ্যে দৃঢ় হয়েছে। এর একটা কারণ কিন্তু সেই মমতা ব্যানার্জির সরকারের নানা সামাজিক প্রকল্প, যাতে নারীরা উপকৃত হচ্ছেন।’
তৃণমূল কংগ্রেস তাদের প্রচারে এটা বারবারে বলেছে যে বিজেপি যদি সরকারে আসে তাহলে এ ধরনের প্রকল্পগুলি বন্ধ করে দেবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য বলেন, ‘সাধারণ মানুষ স্থিতাবস্থা চান। তারা দেখলেন, যদি বিজেপি সরকারে আসে, হোক না তা কেন্দ্রীয় সরকার, যদি তখন এই ধরনের সামাজিক প্রকল্পগুলি বন্ধ করে দেয়, তাহলে তো সমস্যায় তারাই পড়বেন।’
তিনি বলেন, ‘আবার বিজেপি নেতারা বলছিলেন গতবারের থেকে সামান্য বেশি আসন পেলেও তারা রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে ফেলে দেবেন। এই হুমকিতে মানুষ কিছুটা হলেও আতঙ্কিত হয়েছেন।’
কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার স্লোগান
বামফ্রন্টের আমলে বহু বছর কলকাতা শহরের দেয়ালে লেখা হতো, ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র কথা, ‘মাশুল সমীকরণ’-এর বিরুদ্ধে স্লোগান উঠত তাদের মিটিং-মিছিল থেকে।
কয়েক বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস প্রচার চালাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় সরকার বহু উন্নয়ন মূলক প্রকল্পের অর্থ আটকিয়ে রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি বলব তৃণমূল কংগ্রেস বামপন্থীদের যথার্থ ছাত্র হয়ে উঠেছে। একটা সময়ে বামপন্থীরা দিল্লির বঞ্চনা নিয়ে যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসও সেই পথে হাঁটছে। বছর দুয়েক ধরে কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সরব হয়েছে যে ১০০ দিনের প্রকল্পসহ বহু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ, যা পশ্চিমবঙ্গের পাওনা, তা আটকিয়ে রাখা হয়েছে।’
বিশ্লেষক অমল সরকার বলেন, ‘আবার এই নির্বাচনের চার-পাঁচ মাস আগে থেকেই গোটা রাজ্যে বিরাট বিরাট হোর্ডিং দেয়া হয়েছে বাংলা-বিরোধীদের বিসর্জন স্লোগান দিয়ে। অর্থাৎ রাজ্যের সাধারণ মানুষের প্রতি বঞ্চনার ইস্যুটাকে তারা তুলে ধরেছে খুব ভালো ভাবে।’
‘মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প’ যা চলতি ভাষায় ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, সেই অর্থ বেশ কয়েক বছর ধরে আসছে না, এই অভিযোগ বারবারে করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এ নিয়ে দিল্লিতে বৈঠক, ধর্না- সবই হয়েছে।
আবার গ্রামাঞ্চলে যারা এই প্রকল্পে যুক্ত তারা নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছেন- কাজ করেও তারা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না।
বিজেপির বিরুদ্ধে এই প্রচারটি তৃণমূল কংগ্রেসকে নির্বাচনি সাফল্য এনে দিতে অনেকটা সহায়তা করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিজেপির বিরুদ্ধে কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই
ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এটাও উঠে আসছে যে তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া অ-বিজেপি কোনো দলই দাগ কাটতে পারেনি, আগের বেশ কয়েকটি নির্বাচনের মতোই।
বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র তাই বলছিলেন, ‘যারা বিজেপিকে হারাতে হবে বলে মনে করেছেন, তারা অন্য কোনো দিকে নজর না দিয়ে সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেসকেই যে ভোট দিয়েছেন, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। কংগ্রেস-সিপিএম যৌথভাবে মোট ভোটের মাত্র ১১ শতাংশেরও কম পেয়েছে। এটা অবশ্য সারাদেশেরই একটা ফিচার, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে।’
আবার তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধীরা তাদের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ইস্যু তুলেছিল, উদাহরণ দেয়া হচ্ছিল যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের অনেকেই দুর্নীতির অভিযোগে জেলে আটক রয়েছেন।
অথচ একটা সময়ে মমতা ব্যানার্জিকে তার দল ‘সততার প্রতীক’ বলে তুলে ধরত। একাধিক নেতা-মন্ত্রীর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ সামনে আসার পর থেকে সেটা অবশ্য আর করা হয় না।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই দুর্নীতির ইস্যুগুলোও খুব একটা কাজ করেনি।
বিশ্লেষক অমল সরকার বলেন, ‘দুর্নীতি এমন একটা ইস্যু, যেটা শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের মনেই দাগ কাটে। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে এটা কোনো ইস্যুই নয়। এই সব দুর্নীতির প্রভাব তো সরাসরি তাদের ওপরে সেভাবে পড়েই না।’
বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি
দ্বিতীয় দফার ভোটের পর থেকেই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি শুরু করে। তার আগে নিজেদের ১০ বছরের কাজের খতিয়ান দিচ্ছিল তারা।
কিন্তু সেটা কতটা কাজ করছে ভোটে, তা নিয়ে কিছুটা আশঙ্কা তৈরি হয় বিজেপি নেতাদের মনে। তাই মোদি নিজেই ধর্মীয় মেরুকরণের বিষয়গুলো সামনে আনতে থাকেন।
যেমন কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দু নারীদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে, হিন্দুদের ধনসম্পত্তি ছিনিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে ইত্যাদি।
যখনই এই মেরুকরণ শুরু করলেন তারা, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটার, যার হয়তো একটা সময়ে ভাবছিলেন কংগ্রেস-বাম জোটকে ভোট দেয়ার কথা, তারা সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে বিজেপিকে আটকাতে হলে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত মমতা ব্যানার্জির দলকেই ভোট দেয়া দরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আশিস বিশ্বাস বলেন, ‘এদিক থেকে বিজেপির প্রচারে বুমেরাং হয়েছে। তারা ভেবেছিল ধর্মীয় মেরুকরণ করে ফলাফল ভালো করবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হয়েছে বিপরীত। এটা তাদের প্রচারাভিযানে একটা বড় ভুল ছিল।’
তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে বাম-কংগ্রেস জোট কিন্তু একনিষ্ঠভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল। তাদের অনেক নতুন, তরুণ মুখ জনপ্রিয়ও হয়েছেন ভোট প্রচারে। কিন্তু তাদের ভোটও মোটামুটিভাবে একই আছে গতবারের তুলনায়। কিছু ক্ষেত্রে কমছেও।’
তিনি বিজেপির ভুল প্রচার নীতির যে বিষয়টি উল্লেখ করছিলেন, তারই ব্যাখ্যা দিলেন আরেক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য।
তার কথায়, ‘বিজেপি এ রাজ্যের প্রচারটাকে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে অ্যান্টি ইনকামবেন্সির প্রচারে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটাতো রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন নয়। এটা নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ বছরের কাজের পরীক্ষা ছিল। তাই তাদের প্রচার পরিকল্পনার গোড়ায় গলদ ছিল।’
এছাড়াও বিজেপির নিচু তলায় প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ, দলে অন্তর্দ্বন্দ্বও কাজ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি