মমতার সেনাপতি অভিষেকের বাজিমাত
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৪ জুন ২০২৪, ১৮:৪২, আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১৯:২৭
অভিষেক ব্যানার্জি যা বলেছিলেন, হুবহু সেটাই মিলল। সমীক্ষা যখন দেখাচ্ছিল, বাংলায় তৃণমূলের ‘ভরাডুবি’ হতে চলেছে, তখন দলের প্রার্থী, জেলা সভাপতিদের নিয়ে বৈঠক করে তিনিই বলেছিলেন, ‘চোয়াল শক্ত’ রাখতে। তৃণমূল কমবেশি ৩০টা আসন জিতবে। নিজের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেয়ার পাশাপাশিই তিনি সম্মুখসমরে পাঁচ গোল দিলেন শুভেন্দু অধিকারীকে। ‘সেনাপতি’ থেকে হয়ে উঠেছেন ‘ক্যাপ্টেন’।
মঙ্গলবার লোকসভার নির্বাচনে যে ফলাফল হলো বাংলায়, তাতে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে আরো একবার দলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সেনাপতি অভিষেক ব্যানার্জির নেতৃত্ব। প্রতিষ্ঠিত হলো সামগ্রিকভাবে বাংলার রাজনীতিতেও। দেখা গেল কৌশল, সংগঠন, প্রচার, অভিমুখ নির্ধারিত করা- সব ক্ষেত্রেই বিজেপিকে কয়েক যোজন পেছনে ফেলে দিলেন অভিষেক। সে অর্থে তিনিই এই ভোটের আসল ‘হিরো’।
ভোটের প্রচার পর্বে অভিষেকের বক্তৃতায় নির্দিষ্ট ‘অভিমুখ’ ছিল। যে অভিমুখ কখনো ঘুরে যায়নি। দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহেরা বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে যা যা বলেছিলেন, তার পাল্টা বলছেন মমতা ব্যানার্জি। অভিষেক সেভাবে মোদি-শাহদের জবাব দেয়ার পথে হাঁটেননি। তিনি শুধু তুলনামূলক রাজনৈতিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে আক্রমণ শানিয়েছিলেন বিজেপিকে। তার বক্তব্যের মূল উপজীব্য ছিল, মমতার সরকার কী কী দিচ্ছে বাংলার জনগণকে। বাংলার মানুষের কী কী ‘প্রাপ্য’ আটকে রেখেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। প্রাপ্য আদায়ের দাবি নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে আন্দোলন নিয়ে গিয়েছিলেন অভিষেক। তারপর রাজধানী ধর্না, অবস্থান-বিক্ষোভ, পুলিশি ধরপাকড় এবং শেষে কলকাতায় ফিরে রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসে পড়া, অন্য অভিষেককে দেখেছিল বাংলা।
মাঝে বেশ কয়েক মাস খানিকটা নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন অভিষেক। নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আবারো সংগঠনের কাজে ফিরতে শুরু করেন তৃণমূলের সেনাপতি।
প্রার্থী ঠিক করা, প্রচারের নকশা আঁকা, গোটা বাংলা ছুটে বেড়ানো- সবই করেছেন তিনি। অনেকের বক্তব্য, বিজেপির হয়ে অনেকটা একই রকম ভূমিকা নিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। যে কারণে দু’জনের তুলনা আরো বেশি করে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে প্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল। দু’জনেরই পরীক্ষা ছিল এই ভোট।
ভোটের ফল নিয়ে দু’জনের দাবি প্রায় এক ছিল। শুভেন্দু বলেছিলেন, সংখ্যা তিনি বলবেন না। তবে তৃণমূলের থেকে একটি হলেও বেশি আসন পাবে বিজেপি। অর্থাৎ, তৃণমূল যদি ২০টি পায়, তা হলে বিজেপি অন্তত ২১টি আসন পাবে। অন্য দিকে, ষষ্ঠ দফার ভোটের পরে অভিষেক বলেছিলেন, ‘আগের বার ২২টা পেয়েছিলাম। পৃথিবী রসাতলে গেলও ২৩টা এবার পাবই।’ দেখা গেল অভিষেক তার অনুমান বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন।
অভিষেক নিজেও বিপুল ভোটে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে জিততে চলেছেন। অভিষেকের নেতৃত্ব তথা তার জয়ের ব্যবধান নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা বালুরঘাটে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘ওর জয় বা ওদের দল নিয়ে আমি কিছু বলব না। ফল নিয়ে আমরা আমাদের দলে আলোচনা করব।’ গণনা চলাকালীন সংবাদমাধ্যমকে এই কথা বলেন সুকান্ত।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোট থেকেই অভিষেক সংগঠনে ‘বিশেষ’ ভূমিকা নেয়া শুরু করেছিলেন। যদিও তখন তার পাশে ছিলেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু এবার তিনি নেই। তবে পেশাদার সংস্থা আইপ্যাক এই ভোটে কাজ করেছে। প্রার্থী বাছাইয়ে এই সংস্থার সমীক্ষাও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, আরামবাগ, ঝাড়গ্রামের মতো আসনে চমকপ্রদ প্রার্থী দেয়া তৃণমূলের জন্য কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে, দিলীপ ঘোষকে বর্ধমান-দুর্গাপুরের মতো আসনে লড়তে পাঠানো বা অগ্নিমিত্রা পালকে মেদিনীপুরে পাঠানোর শুভেন্দু-কৌশল কাজে আসেনি।
সন্দেশখালি এবং শেখ শাহজওয়ান নিয়ে যখন গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়, তখন অভিষেকই সামনে থেকে দলের লাইন ঠিক করে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, সন্দেশখালির যে আখ্যান নিয়ে বিজেপি এবং তার সহযোগীরা ভোটের ময়দানে নেমেছিল, একটি ‘স্টিং ভিডিও’ তা পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারেও অভিষেকের তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে থেকেছে শুভেন্দুর আইটি সেলের থেকে।
সন্দেশখালির গোপন ক্যামেরা অভিযানের ‘ফুটেজ’ নিয়ে তৃণমূলের আইটি সেল যে প্রচার করেছিল, তাও ধারণা নির্মাণে কাজ করেছে। বসিরহাট তো বটেই, সন্দেশখালি বিধানসভা কেন্দ্রেও জিতেছে তৃণমূল।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, শাসকদলের বিরুদ্ধে বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ভোটের ফলে তার প্রভাব পড়েনি। ভোট শতাংশ বাড়িয়েছে জোড়াফুল শিবির। যা দলের গণভিত্তি কতটা মজবুত, তা বোঝার অন্যতম সূচক। লোকসভার নির্বাচনের ফল বঙ্গ রাজনীতিতে অভিষেকের সেনাপতিত্বকে ‘প্রতিষ্ঠা’ দিলো। প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যত।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা