২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভারতশাসিত কাশ্মিরে কেন পুলিশের ওপর হামলা করছে সেনাবাহিনী?

কাশ্মিরে কর্মরত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে আইনে - ছবি : বিবিসি

ভারতশাসিত কাশ্মিরে স্থানীয় পুলিশকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মারধর করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কুপওয়ারা থানায় সেনাবাহিনীর ১৩ জন সদস্যকে নিয়ে তিনজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জবরদস্তি ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিলেন।

থানায় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা আপত্তি জানালে সেনা সদস্যরা তাদের ওপর চড়াও হয়। তখন থানার ওসিসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন।

থানায় ঢুকে খুনের চেষ্টা, ডাকাতি, পোশাকধারী পুলিশ অফিসারদের মারধরসহ একাধিক মামলা রুজু করেছে পুলিশ।

এর আগে স্থানীয় পুলিশ এক সেনা কর্মকর্তার বাড়িতে অভিযান চালায়। সেই ঘটনারই কী বদলা নিতে সেনা সদস্যরা থানায় জোর করে ঢুকে পড়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন?

কুপওয়ারা নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে একটি জেলা এবং এই শহরের আশেপাশে অনেক সেনা ক্যাম্প রয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার সন্ধ্যায় সেনা সদস্যরা যখন সহিংসতা চালাচ্ছিলেন, তখনই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হয় এবং তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান।

থানা থেকে সেনা সদস্যরা চলে যাওয়ার আগে ওসির ফোন কেড়ে নেয় এবং থানার এক কর্মচারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। পরে অবশ্য ওই কর্মচারীকে ছেড়ে দেয়া হয়।

ওই সংঘর্ষের ব্যাপারে যে এফআইআর দায়ের হয়েছে, সে ব্যাপারে সেখানে মোতায়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৬ কোর কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পরে সেনাবাহিনী জানিয়েছে ‘সংঘর্ষের খবরটি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা’।

ভারতীয় সেনাবাহিনী এটাও বলেছে যে সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে কাজের ব্যাপারে কিছু বিরোধ দেখা দিয়েছিল, যা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সমাধান করা হয়েছে।

আগেও সংঘর্ষ হয়েছে
এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। গত ৩৫ বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং প্রতিবারই তদন্ত ঘোষণা করা হয় কিন্তু দোষীরা শাস্তি পায় না।

শ্রীনগরের বাসিন্দা আলি মুহাম্মদ ওয়াতালি ১৯৮০ সালে জম্মু ও কাশ্মির পুলিশের সিনিয়র সুপারিন্টেডেন্ট অফ পুলিশ বা এসএসপি ছিলেন। সে বছরের ২৬ জুলাই শ্রীনগরের লাল চকে তার ওপর লোহার রড় ও বন্দুকের বাট নিয়ে হামলা চালায় সেনা সদস্যরা।

আলি মুহাম্মদ ওয়াতালি বিবিসিকে বলেন, ‘সেনাবাহিনীর একটি গাড়ির সাথে একটি অটোরিকশার সংঘর্ষ হলে সেনাবাহিনীর চালক পালিয়ে যায়।’

‘এরপরে অটোচালকের মুখ বন্ধ রাখতে হট্টগোল শুরু করে সেনা সদস্যরা। খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। রাস্তার মাঝখানে সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল, তাতে কোনো চালক ছিল না। আমি পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছিলাম। এরই মধ্যে সাইকেল আরোহী এক শিশুকে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করে সেনা সদস্যরা।’

‘আমি বাধা দিলে সেনা সদস্যরা লোহার রড ও বন্দুক দিয়ে আমার মাথায় ও মুখে আঘাত করে। আমি সেখানে দীর্ঘক্ষণ মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়েছিলাম,’ বলেন আলি মুহাম্মদ ওয়াতালি।

তার মুখের হাড় এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে তিনি এখনো চিকিৎসা করাচ্ছেন।

তিনি আরো বলেন, শ্রীনগরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র লাল চকে সেদিন যত গাড়ি পার্ক করা ছিল, সবগুলোতে সেনা সদস্যরা ভাঙচুর চালায়, নির্বিচারে গুলি চালায় তারা। দুজন মারা গিয়েছিলেন সেদিন।

ঘটনার তদন্তের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেখ মুহম্মদ আবদুল্লাহ। ওই তদন্ত কমিটিতে সেনাবাহিনীর কোর কমান্ডার, হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।

আলি মুহাম্মদ ওয়াতালি বলেন, ‘পরে সেনাবাহিনী একটি বিবৃতি দিয়ে বলে যে আমি গণপিটুনিতে আহত হয়েছি। বিষয়টি সেখানেই থেমে যায়।’

ভারতশাসিত কাশ্মিরে ১৯৮০ সালে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয় এবং এর পরেই সেনাবাহিনী শ্রীনগরের হজরতবাল এলাকায় এক যুবককে মেরে ফেল এরকম দাবি করে যে তারা একজন সশস্ত্র চরমপন্থিকে হত্যা করেছে। কিন্তু রিয়াজ রসুল নামের ওই যুবক আসলে জম্মু ও কাশ্মির পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন।

ওই মৃত্যুর ফলে জম্মু ও কাশ্মির পুলিশে বিদ্রোহ হয়ে যায়। পোশাকধারী পুলিশ অফিসাররা তাদের অস্ত্র শূন্যে তুলে ধরে শ্রীনগরে একটি মিছিল বের করেছিলেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে ওই মিছিলটির ওপরে নজর রাখা হচ্ছিল।

বেশ কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা চলতে থাকে এবং অবশেষে সেনাবাহিনী পুলিশ কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করে বিক্ষুব্ধ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। পরে বেশ কয়েক ডজন পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

পুলিশ সূত্রে খবর, বেশ কয়েক বছর আগে কাশ্মিরের কোলগাম ও গান্দরবাল জেলাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।

অমরনাথ যাত্রা চলাকালীন ২০০২ সালে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সেনাবাহিনীর এক মেজর বেশ কয়েকজন সেনা অফিসারকে নিয়ে জোর করে যাত্রীদের শিবিরে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শিবিরে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পুলিশ বলেছিল যে সেনা সদস্যদের অস্ত্রগুলো বাইরে জমা রাখতে হবে। সে কথা না শুনে সেনা সদস্যরা পুলিশ কর্মীদের মারধর করে। অনেক পুলিশ অফিসার মার খেয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

সেনা ও পুলিশের মধ্যে কেন সংঘর্ষ হয়?
সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বাড়াবাড়ি নিয়ে অনেক বছর ধরে মামলা লড়ছেন এমন একজন সিনিয়র আইনজীবী বিবিসিকে বলেছেন, সেনাবাহিনীকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে আইনে, সেখানেই লুকিয়ে আছে পুলিশ আর সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের মূল কারণ।

তিনি বলেন, ‘কাশ্মিরে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট (আফস্পা) কার্যকর রয়েছে। এখানে নিযুক্ত প্রত্যেকটি সৈনিক জানে যে কেউ তার ক্ষতি করতে পারবে না। এ কারণেই কোনো কোনো সময় নিজেদের স্বার্থে তারা সাধারণ মানুষ বা পুলিশকেও টার্গেট করে। কারণ তারা জানে যে কোনো আদালত তাদের শাস্তি দিতে পারবে না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানকার পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো নিজেদের সরকারি কর্মচারী মনে করেন। তারা আইন সম্পর্কে সচেতন। ইউনিফর্ম পরা একজন ব্যক্তির গায়ে হাত তোলার অর্থ কী, সেটাও তারা জানেন। কিন্তু সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা গেছে যে তারা আইন সম্পর্কে সচেতন নন। আবার কোনো পরিস্থিতিতে এটাও দেখা যায় যে তাদের মধ্যে নিজেকে সেরা মনে করার একটা মানসিকতা রয়েছে।’

আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্যান্য বিশ্লেষকরা একমত যে কাশ্মিরে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্যার সমাধান না হলে দেশজুড়ে এর খারাপ প্রভাব পড়বে।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা তো দেখতে পাচ্ছেন যে ভারতের কোথাও সেনাবাহিনী ট্রেনে ছাত্রদের মারছে, কোথাও বাজারে মারামারি করছে আবার কখনো নিজের বাহিনীর অফিসারদের সাথেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। তাই সুষ্ঠু তদন্তের পর দোষীদের শাস্তি দেয়া আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

‘এসব ঘটনা পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়’
সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আহমেদ আলি ফায়াজের মতে, সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ কাশ্মিরিদের কাছে যত বড় সমস্যা, তার থেকেও অনেক বড় সমস্যা ভারত সরকারের জন্য।

তিনি বলেন, ‘জম্মু ও কাশ্মির পুলিশই দেশের একমাত্র বাহিনী যারা কয়েক দশক ধরে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করছে। যদি কোনো জায়গায় সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয় এবং বিষয়টি প্রমাণিত হয়, তাহলে দোষীদের শাস্তি হওয়াই উচিত কারণ এই ধরনের ঘটনা জম্মু ও কাশ্মির পুলিশের মনোবল কমিয়ে দেবে।’

কুপওয়ারার সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে আহমেদ আলি ফায়াজ বলেন, এরকম একটা ঘটনায় ভারত সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘দেখুন, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত থানা এবং সেখানকার ওসিও নিরাপদ নন। আমরা কিভাবে বলতে পারি যে সাধারণ মানুষ সুরক্ষিত থাকবেন এবং তাদের কোনো সমস্যা হবে না? এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ থানায় যাবে কী আশা নিয়ে?’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement