২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সংশোধিত আইনে নাগরিকত্ব পেলেন বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া ৮ জন

সংশোধিত আইনে নাগরিকত্ব পেলেন বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া ৮ জন - ছবি : বিবিসি

ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের আটজন ব্যক্তিকে নাগরকিত্ব দেয়া হয়েছে। এরা সবাই কোনো না কোনো সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন। যদিও ভারতের বিবিধ পরিচয়পত্র ছিল এদের কাছে, তবে তারা স্বীকার করছেন, যে সেসবই বেআইনি পথে পাওয়া। এখন তারা নির্ভয়ে বলতে পারবেন যে বাংলাদেশ থেকে এসে ভারতের নাগরিক হয়েছেন তারা।

সরকার আটজনকে নাগরিকত্ব দেয়ার তথ্য দিলেও এর আগে তারা বলেছিল যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কতজন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের আওতায় নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন, সেই তথ্য তাদের কাছে নেই।

নাগরিকত্ব আইনের সমালোচকরা অবশ্য বলছেন শেষ দফার ভোট গ্রহণের কদিন আগে নাগরিকত্ব দেয়া হলো রাজনৈতিক কারণে।

যাদের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের অনেকের এলাকাতেই শনিবার শেষ দফায় ভোটগ্রহণ হবে আর অন্তত দুটি লোকসভা আসন এলাকায় নাগরিকত্ব আইনটা বড় ইস্যু ছিল। সেখানকার মতুয়া ভোট রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি– উভয়ের কাছেই।

দেশব্যাপী প্রতিবাদের মধ্যেই ২০১৯ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হয়ে গেলেও তার ‘রুলস’ প্রণয়ন করা হয় এ বছরের গোড়ার দিকে, ভোট ঘোষণার সামান্য আগে। বিজেপির প্রতি সমালোচনা হচ্ছিল যে আইন চালু করেও কেন ‘রুলস’ জারি করতে পারছে না তারা।

এদিকে, এ ঘটনার পর বাংলাদেশ থাকা আসা মানুষ কতটা বিজেপিকে সমর্থন করবেন ভোটের যন্ত্রে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছিলেন বিশ্লেষকরা।

‘ভুয়ো নথি-পরিচয় দিতে বড় পীড়া হত’
সত্তোরোর্ধ এক ব্যক্তি দুদিন আগে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে নব্বইয়ের দশকে স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে চলে এসেছিলেন তিনি। সেদেশে স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করে ভালো চাকরি করতেন। তার সরাসরি সমস্যা না হলেও ধর্মীয় কারণে তার অনেক আত্মীয়-বন্ধুদের ওপরে নির্যাতন হচ্ছিল সেই সময়ে, এমনটাই দাবি করছিলেন নাম প্রকাশ না করতে যাওয়া ওই ব্যক্তি।

তিনি বিলেন, ‘বরিশালে বাড়ি ছিল আমার। হিন্দু হওয়ার কারণে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের ওপরে নির্যাতন হয়েছে। আমি বাধ্য হয়ে সেখানকার ভালো চাকরি ছেড়ে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এদেশে চলে আসি। এখানে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সবই করিয়েছিলাম। সবাই জানে যে এখানে কিছু অর্থের বিনিময়ে এসব পরিচয়পত্র যোগাড় করা কোনো সমস্যাই না। কিন্তু ভুয়ো নথি দিয়ে, স্নাতক হয়েও এখানে নিজেকে অশিক্ষিত বলে পরিচয় দিতে বড় পীড়া হতো।’

ওই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রায় ৩৬ বছর মানসিক যন্ত্রণা সয়েছি। এখন আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারব যে হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি এখানে, কিন্তু এখন আমি ভারতের নাগরিক। নাগরিকত্বের সার্টিফিকেটটা হাতে পেয়ে যেন মনে হচ্ছে গঙ্গাজলে স্নান করে নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছি।’

পরিবারের বাকিরাও আবেদন করবে
তারই মতো উচ্ছ্বসিত নদীয়ার বিকাশ মণ্ডলও। বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন ২০১২ সালে। ঝিনাইদহের বাসিন্দা মণ্ডলের সাথেও সরাসরি ধর্মীয় কারণে নির্যাতন হয়নি।

মণ্ডল জানান, ‘কিন্তু চারদিকে মুসলমানদের বসবাস, আমরা সেখানে সংখ্যালঘু। সবসময়ে মনে একটা ভয় কাজ করত। অনেক আত্মীয় আগেই চলে এসেছিলেন। আমি আসি ২০১২ সালে।’

তার পরিবারে নাগরিকত্বের জন্য তিনি একাই আবেদন করেছিলেন, মঞ্জুর হয়েছে তার আবেদন।

কিন্তু তারও তো আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সবই ছিল, তবুও কেন নতুন আইনে নাগরিকত্বের আবেদন করতে গেলেন?

মণ্ডল বলছিলেন, ‘ওইসব পরিচয়পত্রে তো লেখাই আছে যে নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় ওগুলো। তার ওপরে ওগুলো যে জোগাড় করা যায়, সেটা তো সবাই জানে। তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে অনলাইনে আবেদন করলে নাগরিকত্ব পাওয়া যায় কি না। আমারটা হয়ে গেল, এবার ধীরে ধীরে স্ত্রী সহ পরিবারের বাকিদের জন্যও নাগরিকত্বের আবেদন করব।’

‘বাংলাদেশি বলে হয়রানি করতে পারবে না’
নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে পাসপোর্ট করানোর অবশ্য কোনো প্রয়োজন কখনও হয়নি উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা তারক বিশ্বাস বা তার স্ত্রী শান্তিবালা বিশ্বাসের।

বিশ্বাস বলেন, ‘আমি দিন মজুর। পাসপোর্ট করিয়ে কী করব। তবে দেখতাম পরিচিত যারা পাসপোর্ট করাতে যেত, তাদের বাংলাদেশী বলে হয়রানি করা হতো। এখন আর কেউ সেভাবে বাংলাদেশি বলে হয়রানি করতে পারবে না।’

তবে বিশ্বাসের নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট এখনও হাতে আসেনি একটি নথি জমা না দিতে পারার কারণে। তাকে আবারও শুনানিতে ডাকা হয়েছে। তবে তার স্ত্রী শান্তিবালা বিশ্বাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট পেয়েছেন।

কেন বাংলাদেশের বাগেরহাট থেকে চলে এসেছিলেন ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে?

তিনি বলছিলেন, ‘আমি খেলাধুলো করতাম খুব। তা নিয়েই একবার মারামারি বাঁধে কিছু মুসলমান ছেলের সাথে। আমার বন্ধু, তারাও মুসলমান, ওরা আমাকে বলে যে তারক ভাই তোমাকে জানে মারার প্ল্যান করছে ওরা। আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারব না, তুমি পালিয়ে যাও। তখন আমার বয়স ১৪ কি ১৫। এদেশে চলে আসি মামার বাড়িতে। আমার দাদুভাই উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন, তার কাছেই আশ্রয় নিই।’

মাসখানেকেই নাগরিকত্ব
পশ্চিমবঙ্গের যে আটজনের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তাদের আবেদন বেশ দ্রুত মঞ্জুর করা হয়েছে বলে জানাচ্ছিলেন তারা।

মণ্ডল বলছিলেন, ‘আমি অনলাইনে আবেদন করেছিলাম এপ্রিলের ২৭ তারিখ। কৃষ্ণনগর মুখ্য ডাকঘরে আবেদনের শুনানি হয় ২৭ মে। আমি ইমেইলে সার্টিফিকেট পেয়েছি ২৯ তারিখ। দেখলাম আবেদনের পদ্ধতি খুবই সহজ। বাংলাদেশের একটা নথি দিয়েছিলাম, আদালতের একটা এফিডেফিট আর আমি যে হিন্দু, তার একটা প্রমাণপত্র জমা দিয়েছিলাম এক আশ্রম থেকে।’

ঘটনাচক্রে মণ্ডল যখন আবেদন করেছেন, সেই সময়েই এ সংবাদ প্রকাশিত হয় যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কতজন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী আবেদন করেছেন, সেই তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সমালোচক ও মতুয়া নেতা– লেখক সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বলছিলেন, ‘আমাদের একটা কথা মনে হচ্ছিল যে ভোটের আগে কিছু মানুষকে হয়তো নাগরিকত্ব দিয়ে দেয়া হবে। তারপরে দেখলাম যে ভোট তো শেষ হতে চলল, তবুও একজনকেই তো নাগরিকত্ব দেয়া হলো না! অবশেষে আমাদের সেই ভাবনাই সঠিক বলে প্রমাণিত হল আটজনকে নাগরিকত্ব দিয়ে সেটা আবার প্রচারে নিয়ে আসার মাধ্যমে। এত দ্রুত নাগরিকত্ব দিয়ে দেয়ার পিছনে ভোট-রাজনীতির অঙ্ক আছে বলেই মনে হচ্ছে। এটা যেন প্রমাণ করার চেষ্টা হলো যে নতুন আইনে আবেদন করলেই তাড়াতাড়ি নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়া যাবে।’

রাজনৈতিক অঙ্কেই নাগরিকত্ব?
বিজেপি নেতারা স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টাকে প্রচারের শেষ বেলায় সামনে নিয়ে এসেছেন।

তবে দলেরই এক রাজ্য নেতা নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলছিলেন, ‘আটজনকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে ঠিকই, হয়তো তাদের কাছে বাংলাদেশে বসবাস বা জন্মের কোনো নথি আছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসা বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে সেই নথি নেই। তারা কীভাবে অনলাইনে আবেদন করবেন সেসব নথি দিয়ে? সমস্যাটা তো সেখানেই।’

ওই নেতা বলেন, ‘নতুন আইনের রুলস জারি হওয়ার পরে আমরা বিষয়টা জানতে পারি। তখনই বোঝা যাচ্ছিল যে খুব কম সংখ্যক মানুষই এই আইনে আবেদন করার জন্য উপযুক্ত হবেন। দেখা যাক ভোট মিটলে যদি রুলস সংশোধন করানো যায়।’

সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের কথায়, ‘প্রায় দুই কোটি এমন মানুষ আছেন যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ভারতে। তাদের সকলেরই ভোটার কার্ড ইত্যাদি আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে হাতে গোনা কিছু মানুষ নিশ্চই আবেদন করবেন, নাগরিকত্ব পাবেনও। কিন্তু উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষের সমস্যার কী সমাধান তাতে হবে?’

বিজেপির ওই নেতা বলছিলেন শেষ বেলায় নাগরিকত্ব পাওয়ার উদাহরণগুলো তুলে ধরে কিছু হয়তো লাভ হবে তার দলের।

আর ওই শেষ বেলায়, অর্থাৎ শেষ দফায় শনিবার ভোটগ্রহণ হবে ওই সত্তোরোর্ধ ব্যক্তির এলাকাতেও। তিনি ভোট দিতে যাবেন অবশ্য পুরানো ভোটার কার্ড নিয়েই।

তিনি বলছিলেন, ‘অনেকেই তো আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে নতুন আইনে আবেদন করার সাথে সাথেই আগের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। কই আমার তো কিছু বাতিল হয়নি! আমি তো পুরানো ভোটার কার্ড দিয়েই শনিবার ভোট দেব।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ২৪ ঘণ্টায়ও মহাসড়ক ছাড়েনি ডিইপিজেডের লেনী ফ্যাশনের শ্রমিকরা বুধবার সকালে ঢাকার বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ চীন সীমান্তের কাছে গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল নিল মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা সুদানে গৃহযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা আগের হিসাবকে বহুগুনে ছাড়িয়ে গেছে, বলছে গবেষণা চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা : যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ২০ শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ নিহত আইনজীবীকে নিয়ে অপপ্রচার করছে ভারতীয় গণমাধ্যম : প্রেস উইং হিজবুল্লাহ-ইসরাইল অস্ত্র-বিরতি চুক্তি জয় দিয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ শুরু করতে চায় টাইগ্রেসরা সহজ জয়ে সিরিজে সমতা পাকিস্তানের

সকল