২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মোদির পর বিজেপির নেতৃত্বে কে, জল্পনা তুঙ্গে

মোদির পর বিজেপির নেতৃত্বে কে, জল্পনা তুঙ্গে - সংগৃহীত

উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনৌতে ওই রাজ্যের রাজসিক বিধানসভা ভবনের ঠিক উল্টোদিকেই রাজ্যে বিজেপির প্রধান দফতর। মানে বিজেপি অফিস থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তাটা পেরোলেই বিধানসভার প্রবেশপথ, যদিও এখনকার মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথ খুব কমই দলের কার্যালয়ে আসেন।

ভোটের মৌসুমে বিজেপি অফিসে যথারীতি ব্যস্ততা চরমে, পাশাপাশি মিডিয়ার কর্মীদের আপ্যায়নেও এলাহি আয়োজন। লখনৌর ‘তেহজিব’ বা সংস্কৃতিতে অতিথিপরায়ণতার খুব কদর, দলের কার্যালয়ে মেহমানদারিও একেবারে দেখবার মতো!

গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের জন্য অফিস প্রাঙ্গণের ভেতরেই বিশাল এয়ারকন্ডিশন্ড তাঁবু বসিয়ে তৈরি হয়েছে অস্থায়ী মিডিয়া সেন্টার, যেখানে বসে অন্তত শ’পাঁচেক সাংবাদিক একসাথে কাজ করতে পারবেন। চা-কফি-লস্যির জোগানও অবিরাম।

এর মধ্যেই হাসিমুখে ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা বাইরে থেকে আসা সাংবাদিকদের সাথে খোশগল্প করে যাচ্ছেন। তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে, রাজ্য রাজনীতির নানা জটিল অঙ্ক বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের মতো করে।

এই ‘অফ-দ্য-রেকর্ড’ আর খোলাখুলি আলোচনাতেও একটা প্রসঙ্গ থাকে, যেটার অবতারণা হলেই বিজেপি নেতারা স্পষ্টতই অস্বস্তিতে পড়ে যান। অতিথি সাংবাদিককে হাত জোড় করে অনুরোধ জানান, ‘ও সব কথা থাক না!’

এই প্রসঙ্গটা আর কিছুই না- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পর কে? সোজা কথায়, দলে তার ‘সাকসেসন প্ল্যান’টা কী?

লখনৌ বা এমন কী দিল্লিতেও বিজেপি নেতৃত্ব এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে বিব্রত বোধ করেন ঠিকই, কিন্তু এবারে ভরা নির্বাচনী মৌশুমেই ইস্যুটা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন আম আদমি পার্টির নেতা তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে ক’দিন আগে তার প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই কেজরিওয়াল মনে করিয়ে দিয়েছেন, আগামী বছরেই কিন্তু নরেন্দ্র মোদি পঁচাত্তরে পা রাখবেন- যেটা অলিখিতভাবে তার নিজেরই বেঁধে দেয়া রাজনৈতিক অবসরের বয়স।

কেজরিওয়াল তাই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আগামী বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তো মোদিজিকেও (তার নিজের করা নিয়ম অনুযায়ী) অবসরে যেতে হবে। তাহলে তার পর কে?’

মোদি সামনের বছর অবসরে গেলে মন্ত্রিসভায় অলিখিত দু’নম্বর অমিত শাহ-ই দায়িত্বে আসবেন, এমনও ইঙ্গিত করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। এমন কী তৃতীয়বার মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দু’মাসের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব থেকে যোগি আদিত্যনাথকে সরানো হবে বলেও মন্তব্য করেছেন।

বিজেপির অভ্যন্তরে ‘মোদির উত্তরাধিকারী বিতর্ক’কে উসকে দেয়াই যে তার উদ্দেশ্য ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেটা যে বেশ সফলও হয়েছে, তা বুঝা গেছে অমিত শাহ বা রাজনাথ সিংয়ের মতো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এর উত্তর দিতে বাধ্য হওয়ায়।

তারা দু’জনেই প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ পূর্ণ করবেন তার মাঝপথে অবসরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু এই অবকাশে বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক চর্চাও শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে- বিজেপির ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও।

পঁচাত্তর পূর্ণ হলে নরেন্দ্র মোদি অবসর নিন বা না নিন, দলে তার পরে কে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্বে আসবেন সেই প্রশ্নটা এর মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।

আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ তো গত সপ্তাহে তাদের একটি নিবন্ধে সোজাসুজি লিখেছে, ‘ভারতের ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে একটি নেতৃত্বের লড়াই দানা বাঁধছে।’

কিন্তু ঠিক কোন কোন নামগুলো নিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জল্পনা চলছে?

নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রত্যেকের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলোই বা কী?

একটা কথা অবশ্য লখনৌ প্রবলভাবে বিশ্বাস করে, নরেন্দ্র মোদির পর যিনিই বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে আসুন- তার একটা ‘উত্তরপ্রদেশ কানেকশন’ অবশ্যই থাকতে হবে। এবং এটা শুধু ওই রাজ্যের অধিকারবোধের দাবি নয়, রাজনৈতিক বাস্তবতাও!

ভারতের সব চেয়ে জনবহুল রাজ্যটি কেন আর কিভাবে মোদির উত্তরসূরী নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে পারে, এই প্রতিবেদন সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজেছে।

বিজেপিতে অবসরের ‘নিয়ম’?
নরেন্দ্র মোদির উত্তরাধিকার বিতর্কে ঢোকার আগে অবশ্য বোঝা দরকার, ‘পঁচাত্তরে অবসর’- বিজেপিতে তথাকথিত এই নিয়মটার নেপথ্যে ঠিক কী!

দেশের বহু শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, এমন কী কোনো কোনো বিজেপি নেতাও একান্ত আলোচনায় এ কথা মানেন যে নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে যখন প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসেন তখন লালকৃষ্ণ আডভানি বা মুরলিমনোহর জোশির মতো দলের প্রবীণ নেতাদের ক্ষমতার বাইরে রাখতেই এই নিয়মটার ‘আমদানি’ করা হয়েছিল।

২০১৪তে আডভানি ও জোশি দু’জনেই কিন্তু লোকসভা ভোটে জিতে এমপি হয়েছিলেন। দু’জনেই ততদিনে আশি পেরিয়ে গেছেন এবং এই নতুন নিয়মের চক্করে পড়ে তাদের কারওরই মোদি ক্যাবিনেটে ঠাঁই হয়নি।

মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিজেপিতে আডভানি-জোশিদের জায়গা করে দেয়া হয় ‘মার্গদর্শক মন্ডলী’ নামে একটি কমিটিতে- কিন্তু গত দশ বছরে বিজেপি নেতৃত্ব এই ‘মুর্শিদ’দের কাছে কখনো কোনো পথ দেখানোর পরামর্শ চাইতে গেছেন, এমন কোনো নজির নেই।

উত্তরপ্রদেশের প্রবীণ বিশ্লেষক ও ‘নিউজট্র্যাকে’র মুখ্য সম্পাদক যোগেশ মিশ্র বিজেপি দলটাকে স্টাডি করছেন আজ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে।

লখনৌতে নিজের দফতরে বসে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘পঁচাত্তরে অবসর নিতে হবে, এই কনসেপ্টটা ছিল আসলে আরএসএস নেতা রামলালের ব্রেইনচাইল্ড। সঙ্ঘের এই নেতা তখন বিজেপির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, আডভানি-জোশিকে সম্মানজনকভাবে বিদায় দিতেই তিনি এই নিয়মটা চালু করার বুদ্ধি দিয়েছিলেন।’

মন্ত্রিসভা ও সরকারে নরেন্দ্র মোদিকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিতেই যে এই নিয়মটার প্রস্তাবনা, তা ছিল বলাই বাহুল্য।

‘ক্যাবিনেটে যদি আডভানি বা জোশির মতো দিকপালরাও থাকেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে ছাড়াও ক্ষমতার ছোট ছোট বৃত্ত বা পাওয়ার সেন্টার তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকবে- যেটা নরেন্দ্র মোদি শিবির মোটেই চায়নি’, বলছিলেন যোগেশ মিশ্র।

লালকৃষ্ণ আডভানি ও মুরলি মনোহর জোশিকে এভাবে রাস্তা দেখিয়ে দেয়া গেলেও অবসরের এই ‘নিয়ম’ কিন্তু কখনোই বিজেপির নিজস্ব সংবিধানে ঠাঁই পাননি। অমিত শাহ নিজেও দিনকয়েক আগে দাবি করেছেন, ‘এরকম কোনো নিয়ম আমাদের দলে নেই!’

তবে এই রীতিটা যে সবার জন্য প্রযোজ্য- তা দেখানোর জন্য মোদির প্রথম ক্যাবিনেটে ঠাঁই পাওয়া কলরাজ মিশ্র বা নাজমা হেপতুল্লাকেও কিন্তু পঁচাত্তর পেরোনোর পরই মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।

আর এখন পঁচাত্তরে অবসরের প্রসঙ্গ উঠলেই বিজেপি নেতারা নরেন্দ্র মোদির অক্লান্ত পরিশ্রম করার ক্ষমতাকে দেখিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছেন, ‘মোদিজিকে দেখে কি আপনাদের মনে হচ্ছে ওনার অবসরের যাওয়ার বয়স হয়েছে?’

এই চুয়াত্তর ছুঁই-ছুঁই বয়সে, মারাত্মক গরমে ও সারা দেশ ঘুরে রোজ তিনি যেভাবে চার-পাঁচটা করে জনসভা বা রোড শো করছেন এবং ক্লান্তির কোনো ছাপই দেখা যাচ্ছে না- তাতে দলের একটা অংশ বলতে শুরু করেছে যে উনি ‘আরো অন্তত দশটা বছর’ অনায়াসে টেনে দিতে পারবেন।

কিভাবে নেতা নির্বাচন করে বিজেপি?
তবে আজ না-হোক কাল, নরেন্দ্র মোদিকেও এক দিন রাজনৈতিকভাবে অবসরে যেতে হবে এটাই বাস্তবতা।

সে ক্ষেত্রে বিজেপিতে তার উত্তরসূরি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা কিভাবে সম্পন্ন হতে পারে, সেটাও বোঝা দরকার। কারণ বিজেপি মোটামুটিভাবে একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হিসেবে পরিচিত, এতদিন ধরে দলের গঠনতন্ত্রেও তারা একটা রীতিরেওয়াজ অনুসরণ করে এসেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাবেক সভাপতি তথাগত রায় যেমন বলছিলেন, ‘আমাদের দলে নেতা নির্বাচন হয় ‘কনসেনসাস’ বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এখানে ভোটাভুটি করার কোনো নজির নেই।’

‘তবে সেই সাথে বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক যারা, সেই আরএসএস বা সঙ্ঘেরও একটা বড় ভূমিকা থাকে। নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সঙ্ঘের মতামত খুবই গুরুত্ব পায়’, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তথাগত রায়।

তবে বিজেপিতে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি বা প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন, তাকেই যে দল প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হিসেবে দেখে তা কিন্তু নয়। বরং চিরকাল তার উল্টোটাই হয়ে এসেছে।

বিজেপির নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রথমবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তার প্রায় এক যুগ আগেই তিনি দলের সভাপতি পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন।

বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের মোট সোয়া ছ’বছরে কুশাভাউ ঠাকরে, বঙ্গারু লক্ষ্মণ, জনা কৃষ্ণমূর্তি বা ভেঙ্কাইয়া নাইডুর মতো দ্বিতীয় সারির নেতারাই বেশিটা সময় দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

আবার ২০১৩ সালে বিজেপি যখন নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে তাদের প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে, তখন দলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজনাথ সিং। বস্তুত রাজনাথ সিং-ই মোদির নাম প্রস্তাব করেছিলেন, প্রবীণ নেতা আডভানির দাবিকে উপেক্ষা করেই।

তথাগত রায় বলছিলেন, ‘আমাদের দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড হলো সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সংস্থা। তারাই কোনো নামে প্রথমে সম্মতি দেয় এবং সেখানে সঙ্ঘের নেতৃত্ব প্রকাশ্যে না-এলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় খুব ঘনিষ্ঠভাবেই যুক্ত থাকেন।’

‘পার্লামেন্টারি বোর্ড সবুজ সংকেত দিলে তা এরপর যায় দলের ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ বা জাতীয় কর্মসমিতিতে।’

‘নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রে কর্মসমিতির এই বৈঠকটা বসেছিল গোয়াতে। আমি নিজেও তখন কর্মসমিতির সদস্য, স্পষ্ট মনে আছে কিভাবে তার নামে সিলমোহর দেয়া হয়েছিল। এরপর দলের ন্যাশনাল কাউন্সিলে পাস করিয়ে নিলেই নামটা চূড়ান্ত হয়’, বিবিসিকে বলছিলেন রায়।

তবে ভারতের বহু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, দল ও দেশের নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এবং যেরকম ‘কাল্ট ফিগারে’ পরিণত হয়েছেন, তাতে নিজের উত্তরসূরি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি হয়তো দল বা সঙ্ঘের মতামতের চেয়েও নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকেই বেশি প্রাধান্য দেবেন।

শেষ পর্যন্ত তখন যা-ই ঘটুক, এই মুহূর্তে সেই নেতৃত্বের দৌড়ে কারা এগিয়ে আছেন সেটাও এই ফাঁকে দেখে নেয়া যাক।

২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে জেতার পর দল যখন মুখ্যমন্ত্রী পদে যোগি আদিত্যনাথকে বেছে নেয়, কেউ ধারণাও করতে পারেনি রাজ্যে তাকেই সরকার চালানোর দায়িত্ব দেয়া হবে। বস্তুত আদিত্যনাথ ওই নির্বাচনে নিজে লড়েনওনি।

পরের সাত বছরে বিতর্কিত এই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী নেতা এবং হিন্দুদের গোরক্ষনাথ মঠের মহন্ত (প্রধান) উত্তরপ্রদেশে বিজেপির এক নম্বর মুখ হিসেবেই শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি, ২০২২র নির্বাচনেও বিজেপিকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো গরিষ্ঠতা এনে দিয়েছেন- যা ওই রাজ্যের রাজনীতিতে খুবই বিরল।

‘দিল্লি মে মোদি, লখনৌ মে যোগি’ বিজেপির খুব জনপ্রিয় একটি স্লোগানেও পরিণত হয়েছে- বিজেপির কথিত ‘ডাবল ইঞ্জিনে’র (অর্থাৎ কেন্দ্রে ও রাজ্যে যখন একই দলের সরকার) আদর্শ মডেল হিসেবেও তুলে ধরা হচ্ছে উত্তরপ্রদেশকে।

বলা হতে থাকে, মোদি-যোগির এই ‘অসাধারণ জুটি’ই বিজেপির সাফল্যের সেরা রেসিপি। এবারের ভোটেও রাজ্যে সব ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টারে মোদির ঠিক পরেই দেখা যাচ্ছে যোগির ছবি, যদিও একটু ছোট সাইজে।

গত দু’তিন বছর ধরে যোগীর সমর্থকরা ইতিউতি এ কথাও বলতে শুরু করেছেন, ‘মোদিজির পর দলের হাল ধরার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি অবশ্যই যোগিজি!’

বস্তুত প্রশাসনে এক ধরনের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও একই সাথে তীব্র মুসলিম-বিরোধী পথ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বিজেপির ‘কোর ভোটব্যাঙ্কে’র কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বাড়াতে পেরেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের বাড়িঘর বা দোকান ভেঙেছে যোগির বুলডোজার, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজ্যের প্রায় সব বুচারহাউসও (কসাইখানা) তিনি বন্ধ করে ছেড়েছেন।

তার আমলেই হেফাজতে রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে আতিক আহমেদ বা মুখতার আনসারির মতো মাফিয়া ডনদের। আর এই সব পদক্ষেপের প্রায় সবই নেয়া হয়েছে বেছে বেছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে।

তবে তা-ই বলে মোদির উত্তরসূরী হিসেবেও তিনি নিজের নাম পাকা করে ফেলেছেন, এটা বিজেপিতেই অনেকে মানেন না।

লখনৌতে দলের এক প্রথম সারির নেতা নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বলছিলেন, ‘আসলে দুটো জিনিস যোগিজির বিপক্ষে যাবে। এক, তিনি কখনোই পুরোপুরি বিজেপির লোক নন। ওনার নিজস্ব হিন্দুত্ববাদী নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ আলাদা- যার সাথে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।’

‘আর দু’নম্বর হলো যোগিজি আজ পর্যন্ত কোনোদিন আরএসএসের কোনো শাখায় যাননি, খাকি হাফপ্যান্টও পরেননি (একদা যা ছিল সঙ্ঘের ইউনিফর্ম)। সঙ্ঘের হাত মাথায় না-থাকলে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে যাওয়া বোধহয় আজও অসম্ভব।’

১৯৯৮ সালে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে যোগি আদিত্যনাথ যখন প্রথম বিজেপির এমপি হয়েছিলেন, তখনো তাকে দেখতাম কখনো বিজেপির সাংবাদিক সম্মেলনের আশপাশেও যেতেন না। ১১ নম্বর অশোকা রোডে দলের তখনকার সদর দফতরের ছায়াও মাড়াননি কোনো কালে।

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত গোটা রাজ্যে ‘হিন্দু যুবা সেনা’ নামে নিজস্ব সংগঠনও চালাতেন তিনি, যার সাথে ভিএইচপি বা বজরং দলেরও কোনো সংস্রব ছিল না।

বিজেপির এমপি বা মুখ্যমন্ত্রী হয়েও এই যে একটা সমান্তরাল সংগঠন বা নেটওয়ার্ক পরিচালনার ইতিহাস- এটা দলের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার পথে আদিত্যনাথের জন্য বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে।

দিল্লির বর্ষীয়ান সাংবাদিক মাধবন নারায়ণন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘অরবিন্দ কেজরিওয়াল যখন যোগীকে হঠিয়ে দেয়া হবে বলে পূর্বাভাস করলেন, দেখবেন বিজেপির পক্ষ থেকে কেউ কিন্তু সেটা খণ্ডন করার জন্য এগিয়ে আসেননি!’

‘অমিত শাহ মোদির অবসরের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন, কিন্তু যোগিকে নিয়ে একটা শব্দও বললেন না!’

ফলে ধারণা করা যেতেই পারে, প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হিসেবে যোগি আদিত্যনাথের নাম কখনো উঠে এলে তিনি হয়তো দল ও সঙ্ঘ থেকেই বিরোধিতার মুখ পড়বেন।

অমিত শাহ
গত ১৬ মে ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘তিনি লোকজনকে ভয় দেখাতে ভালবাসেন : যেভাবে মোদির ডান হাত, অমিত শাহ, ভারতকে চালান!’

ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত চল্লিশ বছর ধরে অমিত শাহ নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর, উপদেষ্টা এবং এক কথায় সব কাজের কাজী! আর এই মুহূর্তে তিনি ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও।

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪তে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই বিজেপির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন অমিত শাহ। দ্বিতীয় মেয়াদে মোদি তাকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্যাবিনেটে অঘোষিত দু’নম্বর ব্যক্তি করে নিয়ে আসেন।

অমিত শাহকে অনেকেই নরেন্দ্র মোদির ‘অল্টার ইগো’ বা বিকল্প সত্ত্বা বলেও বর্ণনা করেছেন।

নরেন্দ্র মোদির সম্বন্ধে একটা কথা চালু আছে, তার ডান হাত কী করছে সেটা বাঁ হাতও না কি জানতে পারে না। বিজেপির একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী একবার আমায় বলেছিলেন, ‘বাঁ হাত না-জানতে পারে, কিন্তু অমিতভাই অবশ্যই জানবেন!’

উত্তরসূরী বাছাই করার প্রশ্ন এলে নরেন্দ্র মোদির মতামতই যদি প্রাধান্য পায়, তাহলে তিনি শেষ পর্যন্ত অমিত শাহকেই বেছে নেবেন এমন একটা ধারণাও বিজেপির অন্দরে বেশ চালু আছে।

অমিত শাহ নিজে আরএসএসেরও বেশ ঘনিষ্ঠ। খুব ছোটবেলা থেকে গুজরাটে বাড়ির কাছে আরএসএস শাখায় তার যাতায়াত, সঙ্ঘের প্রচারক হিসেবেও তিনি বহুদিন কাজ করেছেন।

ফলে তার নাম নিয়ে সঙ্ঘেরও হয়তো বিশেষ আপত্তি থাকবে না, এমনটাই অভিমত বহু পর্যবেক্ষকের। তবে তার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে উঠতে পারে তার কাজের ধরনধারণ বা ‘ম্যান ম্যানেজমেন্টে’র পদ্ধতি- এই থিওরিও কিন্তু বেশ চালু।

যোগেশ মিশ্র যেমন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা ক্যাবিনেটে দু’নম্বর, সে সব ঠিক আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে সেই নেতার কিন্তু বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও একটা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা থাকা দরকার, যেটা অমিত শাহর একেবারেই নেই।’

অমিত শাহকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ‘ছায়া’ বলে বর্ণনা করে তিনি আরো যোগ করেন, ‘আমার ধারণা আসল লোকটি এক দিন সরে গেলে ছায়াটাও কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরে যাবে।’

এটা ঠিকই, অমিত শাহর সাথে ভারতের বিরোধী দলগুলোর সম্পর্ক আসলে শুধু খারাপ নয়, অত্যন্ত খারাপ।

সোহরাবউদ্দিন শেখ এনকাউন্টার মামলায় একদা জেল খাটা অমিত শাহই এখন সিবিআই বা ইডি পাঠিয়ে দেশের বিরোধী নেতাদের প্রতিনিয়ত হেনস্থা করে থাকেন, বিরোধী শিবিরে এই ধারণাও বেশ বদ্ধমূল।

তবে বিরোধী শিবির কী ভাবল, সেটা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী মোদি কোনো দিন কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। উত্তরসূরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তিনি তা করতে যাবেন সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই- আর এখানেই সম্ভবত অমিত শাহর অ্যাডভান্টেজ।

তা ছাড়া মোদির প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষাতেও তিনি বরাবর সসম্মানে উত্তীর্ণ। গত চল্লিশ বছর ধরে দু’জনের সম্পর্কও একেবারে অটুট রয়েছে।

২০১৪ সালে যে নির্বাচনে জিতে মোদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাতে দীর্ঘ চার দশক পর ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল পার্লামেন্টে এককভাবে গরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের পরও নরেন্দ্র মোদি কিন্তু প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন, ‘আমি ক্যাপ্টেন হতে পারি, কিন্তু এই নির্বাচনের ম্যান অব দ্য ম্যাচ অবশ্যই অমিতভাই!’

এ হেন অমিত শাহ মোদির পর বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে যাওয়ার জন্য খুব নীরবে ও সন্তর্পণে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন বলেও কারো কারো বিশ্বাস।

‘দ্য প্রিন্টে’র রাজনৈতিক সম্পাদক ডি কে সিং যেমন বলছেন, ‘যেভাবে এবার বিজেপি লাখ লাখ ভোটে জেতা বহু জনপ্রিয় এমপি-কেও টিকিট দেয়নি, কিংবা মাসকয়েক আগে শিবরাজ সিং চৌহানের মতো সিনিয়র নেতাকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে ছেঁটে ফেলেছে তাতে মনে করা যেতেই পারে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সামান্যতম দাবিদার হতে পারেন এমন সবাইকেই ধীরে ধীরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।’

‘এখন আমাকে দয়া করে বলতে যাবেন না এগুলো সব হচ্ছে বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার নির্দেশে’, যোগ করেন তিনি। তার ইশারা কার দিকে, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না।

রাজনাথ সিং (৭২)
নিউজট্র্যাকের সম্পাদক তথা বিজেপির রাজনীতি গুলে খাওয়া যোগেশ মিশ্র কিন্তু মোদির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে তৃতীয় আর একটি নামও দেখছেন- সেটি রাজনাথ সিংয়ের।

রাজনাথ এই মুহূর্তে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মোদির প্রথম মেয়াদে ছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অটলবিহারি বাজপেয়ির সরকারেও তিনি ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন- যে অভিজ্ঞতা আজকের বিজেপিতে প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে আর কারোরই নেই।

রাজনাথ সিং লখনৌ আসন থেকে নির্বাচিত বহু বছরের এমপি, বিজেপির সাবেক সভাপতিও বটে।

‘আসলে আমি যেটা বুঝেছি নরেন্দ্র মোদি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন ফিসফিসানি বা হুইসপারিংকে। তিনি চমক দিতে খুব পছন্দ করেন, আর যেটা নিয়ে আগে থেকেই জল্পনা চলছে সেটাই করাটা তার ঘোরতর না-পসন্দ!’, বলছিলেন যোগেশ মিশ্র।

‘আর যেহেতু যোগি বা অমিত শাহর নাম নিয়ে এখন থেকেই এত চর্চা, তাই হয়তো দেখা যাবে তিনি এদের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য একজনকে বেছে নিলেন!’

আর ঠিক এখানেই রাজনাথ সিংয়ের ‘সম্ভাবনা’ দেখছেন পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ।

মনে রাখতে হবে, বিজেপির সভাপতি থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদির নাম কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন রাজনাথই। নরেন্দ্র মোদি তখন গুজরাটের বারো বছরের মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই, কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরের কোনো নেতা নন।

বাস্তবের রাজনীতিতে প্রতিদান বলে যদিও কিছু হয় না- নেহাত কৃতজ্ঞতার বশেও মোদি হয়তো সে কথা মনে রাখতে পারেন। তবে বয়সটা অবশ্যই রাজনাথ সিংয়ের বিপক্ষে যাবে, কারণ মোদির চেয়ে তিনি মাত্রই বছরখানেকের ছোট।

শারীরিক সক্ষমতা বা ফিটনেসে অবশ্য মন্ত্রিসভায় তার সতীর্থদের অনেকের চেয়ে রাজনাথ অনেক এগিয়ে, দেশ জুড়ে ভোটের প্রচারও করছেন অক্লান্তভাবে।

রাজনাথ সিংয়ের অনুকূলে আরও দুটো ফ্যাক্টরও কাজ করতে পারে- এক, তিনি সঙ্ঘের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং দুই, বিরোধী শিবিরের বহু নেতা-নেত্রীর সাথেও তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব হৃদ্যতার।

উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের ছেলে রাজনাথ সিংও খুব কম বয়স থেকেই আরএসএসের সদস্য। ফিজিক্সের ছাত্র ছিলেন, কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি বহু বছর ধরে সঙ্ঘের হয়ে সাংগঠনিক কাজকর্মও চালিয়ে গেছেন।

যোগেশ মিশ্র বলছিলেন, ‘আরএসএসের অত্যন্ত আস্থাভাজন তিনি। তাকে ‘ট্রাবলশুটার’ হিসেবে সঙ্ঘ খুবই ভরসা করে এবং গত দশ বছরে বহু সঙ্কটের মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা রাজনাথকে কাজে লাগিয়েছেন।’

বিজেপি যখন ক্ষমতায়, তখন প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীর মতো শীর্ষ পদগুলোতে আরএসএস সব সময় নিজেদের বিশ্বস্ত লোকজনকেই বসাতে চেয়েছে। ফলে এখানেও যোগি আদিত্যনাথের তুলনায় রাজনাথ এগিয়ে থাকবেন।

তার আর একটা বড় সুবিধা হলো- কলকাতায় মমতা ব্যানার্জিই হোন বা মুম্বাইতে উদ্ধব ঠাকরে- বিরোধী শিবিরের এই নেতাদের সাথেও রাজনাথ সিং যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে ফোন ঘুরিয়ে কথা বলতে পারেন।

রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও বিরোধী দলগুলোর নেতানেত্রীদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কে রাজনাথ সিং কখনো তার প্রভাব পড়তে দেননি।

বিদায়ী লোকসভায় বহুজন সমাজ পার্টির এমপি দানিশ আলি বলছিলেন, ‘বিজেপিতে একসময় সুষমা স্বরাজ বা অরুণ জেটলির মতো নেতারা যে কাজটা করতেন, অর্থাৎ সবার সাথে সুসম্পর্ক রেখে মানিয়েগুছিয়ে চলতে পারতেন- এখন সেটা করার মতো লোক আছেন কেবল রাজনাথ সিং।’

তিন বছর আগের কৃষক আন্দোলনের সময় প্রতিবাদী কিষাণ নেতাদের সাথে রফা আলোচনাতেও রাজনাথ সাফল্য পেয়েছিলেন, মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

‘রাজনাথ সিং নিজে একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। তাকে বিজেপির একটি মডারেট ফেস, অর্থাৎ উদার ও মধ্যপন্থী মুখ হিসেবেই দেখা হয়।’

‘ফলে পার্লামেন্টে বিজেপির শক্তি যদি কমে যায় এবং সরকার গড়ার জন্য তাদের অন্য দলেরও সমর্থন দরকার হয়- তখন রাজনাথ সিংকেই নেতৃত্বে নিয়ে আসা হবে না, এটা কে বলতে পারে?’, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন দানিশ আলি।

ফলে নরেন্দ্র মোদির উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে রাজনাথ সিংও কিন্তু প্রবলভাবে আছেন।

‘ফ্রন্টরানার’ না-হলেও হয়তো ‘ডার্ক হর্স’ বা কালো ঘোড়া হিসেবে, কিংবা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তার জন্য সুযোগ এনে দিতে পারে!

শেষ কথা বলবে উত্তরপ্রদেশ?
নরেন্দ্র মোদির পর যিনিই বিজেপির হাল ধরুন, তার নাম চূড়ান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের যে খুব বড় ভূমিকা থাকবে তা নিয়ে অবশ্য লখনৌর বিজেপি দফতরে কারওরই এতটুকুও সংশয় নেই। শহরের সিনিয়র সাংবাদিকরাও এই একটা প্রশ্নে সবাই একমত।

আসলে উত্তরপ্রদেশেই আছে ভারতের যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি লোকসভা আসন- ৮০টি। এই রাজ্যে না-জিততে পারলে দেশের ক্ষমতায় আসা যে কার্যত অসম্ভব, এটাও অতীতে বারবার দেখা গেছে।

বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ‘ডিলিমিটেশন’ বা আসন পুনর্বিন্যাস করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে, সেটা হলে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা আসনের সংখ্যা অবধারিতভাবে আরো বাড়বে।

২০১৪তে ‘মিশন ২৭২ প্লাসে’র লক্ষ্য রেখে দলের ইতিহাসে প্রথমবার বিজেপি লোকসভায় এককভাবে গরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল- সেখানেও তাদের ৭২টি আসন এসেছিল শুধু উত্তরপ্রদেশ থেকেই।

সোজা কথায়, এই একটি রাজ্যই নরেন্দ্র মোদির সরকারকে দারুণ মজবুত করে তুলেছিল।

এমন কী দেশকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রধানমন্ত্রীও দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ। স্বাধীন ভারতের ৭৭ বছরের ইতিহাসে প্রায় ষাট বছর তারাই সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার মধ্যে জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধি, অটলবিহারী বাজপেয়ি থেকে নরেন্দ্র মোদি- কে নেই?

বস্তুত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকা নরেন্দ্র মোদিকেও কিন্তু উত্তরপ্রদেশ হয়েই পার্লামেন্টে যেতে হয়েছে।

ওই রাজ্যের বারাণসী আসন থেকে জিতেই তিনি ২০১৪তে প্রথম এমপি হয়েছিলেন, এবারেও তিনি সেখান থেকেই লড়ছেন।

নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে একসময় মহারাষ্ট্রের নেতা নীতিন গডকড়ি বা দেবেন্দ্র ফাডনবিশের নামও অল্পবিস্তর শোনা যেত।

কিন্তু তারা যে লড়াইতে অনেক পিছিয়ে পড়েছেন, তার একটা বড় কারণ উত্তরপ্রদেশের সাথে তাদের কোনো সংযোগ নেই। হিন্দিতেও তারা কিছুটা দুর্বল, উত্তরপ্রদেশের কোনো জনসভায় তাদের ভাষণ দিতেও দেখা যাচ্ছে না।

উল্টোদিকে মোদির পর দলীয় নেতৃত্ব যে তিনজনের হাতে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি – তারা প্রত্যেকেই হয় উত্তরপ্রদেশের ভূমিপুত্র, কিংবা ওই রাজ্যের রাজনীতির সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত।

যেমন, গাড়োয়ালের যুবক অজয় বিস্ত সন্ন্যাস নেয়ার পর হয়েছিলেন যোগি আদিত্যনাথ- আর রাজ্যের গোরখপুর হয়ে উঠেছিল তার কর্মভূমি। আর গত সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি তো উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও।

অমিত শাহ-কে যে সাফল্যের জন্য নরেন্দ্র মোদি ২০১৪র ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন- সেটাও কিন্তু ছিল উত্তরপ্রদেশেই।

চারটি প্রধান দলের সমর্থকে বিভক্ত ও জাতপাতের রাজনীতিতে বিদীর্ণ উত্তরপ্রদেশে কোনো দল যে একচেটিয়া সাফল্য পেতে পারে, তা এক সময় ভাবাই যেত না।

অমিত শাহর ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ তত্ত্বই দশ বছর আগে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল, এটা বিশ্লেষকরা অনেকেই মানেন।

এখনো তিনি কিন্তু ওই রাজ্যে লাগাতার প্রচার করে যাচ্ছেন- এবং প্রয়োজনে নিজের ‘পলিটিক্যাল বেস’কেও গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশে সরিয়ে আনতে অমিত শাহ অবশ্যই কোনো দ্বিধা করবেন না।

রাজনাথ সিং-ও উত্তরপ্রদেশের সন্তান। তার রাজনীতির হাতেখড়িও সেখানে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন একটা সময়।

গত দশ বছর ধরে তিনি হাই-প্রোফাইল লখনৌ কেন্দ্রের এমপি, যেখান থেকে একসময় লড়তেন অটলবিহারি বাজপেয়ির মতো বিজেপি লেজেন্ড।

বস্তুত ভারতে যে অংশটা ‘হিন্দি হার্টল্যান্ড’ বা ‘গোবলয়’ নামে পরিচিত, তার নিউক্লিয়াস হলো উত্তরপ্রদেশ। আর এটাই আজ পর্যন্ত গোটা দেশে বিজেপির সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি।

একদা বিজেপির পরিচিতি ছিল ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানে’র পার্টি হিসেবে, আর তথাকথিত 'হিন্দি বেল্ট'ই ছিল তাদের মূল শক্তির জায়গা।

বিগত এক দশকে ভারতের নতুন নতুন অংশে তারা কমবেশি শক্তিবৃদ্ধি করতে পেরেছে এটা ঠিকই, তবুও আজ পর্যন্ত দেশের ক্ষমতায় আসার জন্য তাদের প্রধান ভরসা কিন্তু এই অঞ্চলটাই- এবং বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ।

লখনৌতে নিজের অফিসে বসে যোগেশ মিশ্র তাই কিছুটা গর্বমেশানো সুরেই বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদির পরে কে, এই প্রশ্নটার জন্ম দিল্লিতে হয়েছে সেটা ঠিকই।’

‘কিন্তু এটাও জেনে রাখুন, এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দেবে উত্তরপ্রদেশ!’
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement