সন্দেশখালীতে ধর্ষণের ‘মিথ্যা’ অভিযোগ প্রত্যাহার ২ নারীর
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৯ মে ২০২৪, ২১:৫২
পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালিতে যে নারীদের ওপরে নির্যাতন হয়েছিল বলে পুলিশে অভিযোগ করা হয়েছিল, তাদেরই দুজন সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
তারা বলছেন যে তাদের দিয়ে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করানো হয়েছিল এবং তা করিয়েছিলেন স্থানীয় এক বিজেপি নেত্রী।
আবার অন্য একটি পুরানো ভিডিও কলকাতার বাংলা সংবাদমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে, যেখানে সন্দেশখালি যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেই বসিরহাট কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্রসহ আরো কয়েকজন স্থানীয় নারীকে দেখা যাচ্ছে, যারা প্রশ্ন তুলছেন যে ‘সন্দেশখালির নির্যাতিতা’ বলে যাদের রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা কারা।
এই ঘটনা এমন সময়ে সামনে এল যখন গত শনিবার গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দেখা গেছে যে স্থানীয় এক বিজেপি নেতা স্বীকার করছেন যে সন্দেশখালির নারীদের ওপরে তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন স্থানীয় নেতা নিয়মিত নির্যাতন করেছেন, ধর্ষণ করেছেন বলে যে আন্দোলন করা হয়েছিল, সেটি পুরোই সাজানো ঘটনা ছিল।
‘এটা মিথ্যা অভিযোগ’
যে দুই নারী তাদের করা ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা বলে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে এই মর্মে তারা বয়ানও দিয়ে এসেছেন।
এরা সম্পর্কে বধূ এবং শাশুড়ি।
মিতা মাইতি নামে ওই সন্দেশখালির ওই বধূ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ‘দিল্লি থেকে মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা এসেছেন বলে আমার শাশুড়িকে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। জানতে চাওয়া হয় যে তার কী অভিযোগ রয়েছে। যেটা সত্য অভিযোগ যে আমরা ১০০ দিনের কাজ করে টাকা পাইনি, সেটাই বলেন আমার শাশুড়ি। সেখানে একটা সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়া হয়।’
তিনি যে ১০০ দিনের কাজের ব্যাপারে উল্লেখ করছিলেন, সেটা হলো গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প। এই প্রকল্পে সারা বছর ১০০ দিন কাজ দেয়ার কথা।
ওই নারী বলেন, ‘পরে আমি বাড়ি এসে বিষয়টা জানতে পেরে আমি পিয়ালি দাসকে ফোন করি। তিনি বলেন, যে তোমাদের ভয়ের কিছু নেই।’
তিনি পরে জানতে পারেন যে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা নারীদের তালিকায় তার ও শাশুড়ির নাম রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সাথে এমন কিছু ঘটেনি। এটা মিথ্যা অভিযোগ। আমরা কোনো মিথ্যা অভিযোগের সাথে যুক্ত হতে চাই না।’
আবার তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেয়ায় তাদের একঘরে করে দেয়া হয়েছে এবং হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও পুলিশের কাছে নতুন করে অভিযোগ করেছেন ওই দুই নারী।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার তৃণমূল কংগ্রেস বলেছে যে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী ও অন্যদের বিরুদ্ধে তারা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানাতে চলেছে।
বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্রর নতুন ভিডিও
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম একটি ভিডিও দেখাচ্ছে, যেখানে লোকসভায় বিজেপির বসিরহাটের প্রার্থী রেখা পাত্রসহ তিনজন নারীকে দেখা গেছে।
ভিডিওটি দেখে মনে করা হচ্ছে যে রেখা পাত্র বিজেপির প্রার্থী হওয়ার আগে ধারণ করা হয়েছিল এটি।
ওই ভিডিওতে এক নারীকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমরা সন্দেশখালি আন্দোলনে যুক্ত। আমরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাহলে আমাদের ছাড়া রাষ্ট্রপতি ম্যাডামের কাছে কারা গেল? আমরা তাহলে কারা?’
ভিডিওতে রেখা পাত্রকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমরা নির্যাতিতারা সন্দেশখালিতে পড়ে আছি, তাহলে আমাদের হয়ে কারা গেছে তা জানা প্রয়োজন।’
পাত্রর প্রশ্ন, ‘রাষ্ট্রপতি ম্যাডামের কাছে গিয়েছেন যে আমাদের কিছু জানিয়েছিলেন? আমরা আন্দোলনের মুখ, আমাদের না নিয়ে গিয়ে অন্যদের সাজিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস কে দিয়েছে?’
ঘটনাচক্রে বৃহস্পতিবারই বসিরহাট কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন রেখা পাত্র।
গোপন ভিডিওতে ‘স্বীকারোক্তি’
গত শনিবার একটি স্টিং অপারেশনের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করে তৃণমূল কংগ্রেস। এছাড়া সেই স্টিং অপারেশনের ভিডিওটি পৃথকভাবে একটি ইউটিউব চ্যানেলও আপলোড করা হয়েছিল।
সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের যে অভিযোগ সেটি পুরোটাই সাজানো ঘটনা এবং এর পেছনে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর যোগ রয়েছে, এমনটাও উঠে এসেছে ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে।
বিজেপির যে নেতার ভিডিও গোপনে ধারণ করা হয়েছে, তার নাম গঙ্গাধর কয়াল। তিনি সন্দেশখালিতে বিজেপির দুই নম্বর ব্লকের মণ্ডল-সভাপতি। ওই সন্দেশখালি দু-নম্বর ব্লকের নারীরাই দলবদ্ধভাবে প্রতিবাদ শুরু করেন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
ভিডিওটি একটি কথোপকথনের। প্রশ্নকর্তাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু গঙ্গাধর কয়ালের চেহারা স্পষ্ট।
ভিডিওটি শুরুর সেকেন্ড তিরিশেকের মাথায় প্রশ্নকর্তা বলছেন, ‘দাদা, তুমি জানো তোমরা কী লেভেলের কাজ করেছ! ধর্ষণ হয় নাই। তাকে ধর্ষণ বলে চালিয়েছ! তোমার বাড়ির বৌকে দিয়ে এই কাজ করাতে পারতে? আমরা তো পারব না। দাদা সেখানে বাইরের লোক হয়ে তাদের দিয়ে এই কাজ করিয়েছে। কীভাবে ওঁদের ব্রেনওয়াশ করলে?’
এর উত্তরে গঙ্গাধর কয়ালকে হাসতে হাসতে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘শুভেন্দুদার নির্দেশেই আমরা এই কাজ করেছি। উনি আমাদের সাহায্য করেছেন। শুভেন্দুদা বলেছেন, এটা না করলে, তাবড় তাবড় লোকদের গ্রেফতার করানো যাবে না। আমরাও ওখানে দাঁড়াতে পারব না।’
এরপরে তার কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, ‘গোটা বিষয়টি শুভেন্দুদা নিয়ন্ত্রণ করত?’
জবাবে গঙ্গাধর কয়াল বলছেন, ‘হ্যাঁ উনিই সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন।’
তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি কী বলছে?
ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিও এবং ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ তুলে নেয়ার জন্য দুই নারীর আবেদনের পরে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘আসলে ধর্ষণ নিয়েও বিজেপি নোংরা রাজনীতি করে। নারীদের আমরা দোষ দেব না। জমি নিয়ে আমাদের কিছু সমস্যা ছিল। নারীরা মুখ খুলেছেন। সেটা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটে যেত।’
অন্যদিকে বিজেপির এক নেতা বলেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেস এখন কেন মুখ খুলছে? দু-তিন মাস তো তারা চুপ করেছিল। তারা আগে বলছিল যে, সন্দেশখালির নারীরা মিথ্যা বলছেন, এখন আবার বলছে তাদের দিয়ে মিথ্যা বলানো হচ্ছে।’
শনিবার যে ভিডিওটি সামনে এসেছিল, সেটি উচ্চমানের কারিগরি বিদ্যা ব্যবহার করে বানানো হয়েছে এবং তার পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা রয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছিল বিজেপি।
সন্দেশখালি এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছিল কারণ সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও জোর করে জমি দখলে অভিযোগ উঠেছিল। এই ইস্যু নিয়ে বিজেপি শুধু গোটা রাজ্যে নয়, সারা দেশেই প্রচার চালাচ্ছিল।
কিন্তু একেবারে ভোটের মুখে যেভাবে একের পর এক ভিডিও সামনে আসছে, যেখানে বিজেপির স্থানীয় নেতারা সন্দেশখালির নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে সাজানো বলে ক্যামেরায় বলছেন, তারপরে গোটা ইস্যুটিই ঘুরে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা