যেখানে অবৈধ পাথর খনির মিহি গুঁড়াতে ভরে ওঠে ফুসফুস
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৬ মে ২০২৪, ১৮:২০
শেখ কামালুদ্দিনের মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন ভর দুপুরে। সরকারি একটা তালিকা থেকে তার নম্বরে যোগাযোগ করে জানালাম যে আমরা আসছি তাদের রাউতারা গ্রামে, তার বাবার সাথে কথা বলতে, তার শারীরিক অসুস্থতার খবর নিতে।
বীরভূম জেলার মুহম্মদবাজারে তার আগে কদিন ঘুরে দেখেছি চারদিকে শুধুই ধুলো আর ধুলো। এই অঞ্চলের কিছু বৈধ আর বেশিরভাগই অবৈধ পাথর খনি আর পাথর ভাঙ্গার ক্রাশার মেশিন থেকে উড়ে আসা ধুলোয় চারিদিক ছেয়ে থাকে।
এখানে বলে রাখি,‘খাদান’ শব্দটা অনেকের কাছে অপরিচিত হতে পারে। এটাকে খনিই বলা যেতে পারে। তবে বীরভূমের এই অঞ্চলে খাদান শব্দটাই বহুল প্রচলিত, তাই এই প্রতিবেদনে অনেকের কথায় ‘খাদান’ শব্দটা লিখা থাকবে।
ফিরে যাই রাউতারা গ্রামে।
বড় রাস্তা থেকে যখন ওই গ্রামের দিকে ঢুকলাম, তখন পথের দু’পাশেই সবুজ ফসলের ক্ষেত।
তবুও এরকমই একটা এলাকার বাসিন্দা কামালুদ্দিনের কী করে সিলিকোসিস হলো?
‘শ্বাস নিতে কষ্ট হয়’
এ সব ভাবতে ভাবতেই রাউতারা গ্রামে তার বাড়ির পথ দেখিয়ে যখন নিয়ে গেলেন তার মেয়ে, কামালুদ্দিন তাড়াহুড়ো করে ফিরলেন, কোথাও একটা কাজে গিয়েছিলেন।
ঘরে ঢুকেই বসে পড়লেন, মুখ খুলে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন। একটু জল খেলেন। কয়েক মিনিট পরে বলেন,‘আজকাল ভাত খেলাম কি একটু জোরে হাঁটলাম, তাতেই হাঁপ উঠে যায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’
তাকে আরো একটু সময় দিলাম স্বাভাবিক হতে।
তারপর জানতে চেয়েছিলাম, ফেব্রুয়ারি মাসে সিলিকোসিস আক্রান্তদের যে তিনটি নামের তালিকা প্রশাসন দিয়েছে, সেখানে তার নাম এল কী করে? কীভাবে এই রোগ হলো তার?
কামালুদ্দিন বলেন,‘আমার শ্বাসকষ্ট ওই খড়ি কোম্পানিতে কাজ করতে করতেই শুরু হয়েছে।’
চুরকি মুর্মু আর শুভ মার্ডির কথা
শেখ কামালুদ্দিনের বাড়ি থেকে প্রয়াত চুরকি মুর্মুর বাড়ি ঘণ্টাখানেকের রাস্তা, যদি ওই পথের বেশিরভাগটাকেই আদৌ রাস্তা বলা যায়!
গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে গেলে দূরত্ব আট থেকে নয় কিলোমিটার।
চুরকি মুর্মু মারা গেছেন ২০১৭ সালে।
তার পুত্রবধূ এলিজাবেথ মুর্মু বলেন, মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে তার শাশুড়ির ঠিক একই রকম উপসর্গ দেখা দিয়েছিল, যেমনটা আমরা দেখেছিলাম মকামালুদ্দিনের।
চুরকি মুর্মু অবশ্য ‘খড়ি কোম্পানি’তে কাজ করতেন না। তিনি কাজ করতেন পাথর খনিতে, তাদের হাবড়াপাহাড়ী গ্রামের আশেপাশেই যেসব পাথর খনি আছে, সেখানে।
ওই মুহম্মদবাজার এলাকায় প্রায় সাড়ে ৬০০ পাথর খনি আছে, যেগুলো বেআইনিভাবে চলে। লাইসেন্স প্রাপ্ত খনিও আছে, তার সংখ্যা ১৬২-৬৩টি।
ওইসব খনি বন্ধ করার নির্দেশ অনেক আগেই দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত।
চুরকি মুর্মু যে খনিতে কাজ করতেন তার লাইসেন্স আছে কি না, তা বলতে পারলেন না তার পরিজনরা।
আর ওই এলাকায় গিয়ে খনি মালিকের কাছে লাইসেন্সের ব্যাপারে জানতে চাওয়া কেন অতি বিপজ্জনক এবং তাতে প্রাণের ভয় আছে, সে ব্যাপারে এই প্রতিবেদনের শেষের দিকে লিখবো।
ফিরে আসি সিলিকোসিস রোগীদের প্রসাথে।
শেখ কামালুদ্দিনের যেমন সিলিকোসিস রোগ ধরা পড়েছে, মিসেস মুর্মুর রোগটা যে কী, তা তিন-চারটে সরকারি হাসপাতাল ধরতেই পারেনি নাকি!
এমনটাই বলছিলেন এলিজাবেথ মুর্মু।
তার সন্দেহ সিলিকোসিস ধরা পড়তে পারে, এই আশঙ্কায় সরকারি হাসপাতালগুলো চুরকি মুর্মুর রোগ নির্ণয়ই করেনি।
এলিজাবেথ মুর্মুর কথায়,‘খাদানে, ক্রাশারে কাজ করত। কাজ করতে করতে উনার কাশি হচ্ছিল। একবারে কাশতে কাশতে, মানে, পেচ্ছাপ বেরিয়ে যেত ওর। কষ্ট হচ্ছিল। চিকিৎসা হয়েছে সিউড়িতে, বর্ধমানে, বোলপুর। রোগটা ধরতে পারল না।’
ওই হাবড়াপাহাড়ী গ্রামেই থাকেন সুভ মার্ডি। গিয়েছিলেন মাঠে গরু চরাতে।
আমাদের আসার খবর পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরলেন।
একেবারে কাঠির মতো চেহারার মানুষটা হাঁপাচ্ছিলেন।
অনেকক্ষণ সময় নিলেন কথা বলার জন্য।
নিজের মাতৃভাষা সাঁওতালি আর বাংলা মিশিয়ে বললেন, চার-পাঁচ বছর তিনি পাথর খনিতে কাজ করেছেন।
সুভ মার্ডি বলেন,‘ড্রিল ধরতাম, পাথর ভাঙতাম, গাড়িতেও বোল্ডার লোড করতাম। আমরা যত জন গেছিলাম, তার চার-পাঁচজন শুনলাম মারা গেল।’
চুরকি মুর্মুর মতো তারও রোগটা যে সিলিকোসিস কি না, সেটা তিনি জানেন না।
রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা
চিকিৎসকরা বলছেন সিলিকোসিস রোগ সারানো যায় না।
এই মানুষগুলোর ফুসফুসে সিলিকোসিস নাকি যক্ষ্মা বা অন্য কোনো ফুসফুসের রোগ হয়েছে, তারও কোনো সঠিক সরকারি পরিসংখ্যান ছিলই না।
অতি সম্প্রতি কয়েকটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির চালিয়েছে সরকার। সেখান থেকেই কামালুদ্দিনসহ তিনজনের সিলিকোসিস ধরা পড়েছে সরকারি হিসাবেই।
সিলিকোসিস রোগীদের সরকারি ভাতা দেয়ার নিয়ম আছে। এককালীন দুই লাখ ভারতীয় টাকা, প্রতিমাসে চার হাজার টাকা করে পেনশন পাওয়ার অধিকারী সিলিকোসিস আক্রান্তরা। আর তার মৃত্যু হলে আরো দুই লাখ ভারতীয় টাকা পাবে তার পরিবার আর পারিবারিক পেনশন পাওয়ার কথা সাড়ে তিন হাজার ভারতীয় টাকা প্রতিমাসে।
শুধু যে পাথর খনি বা ক্রাশারে কাজ করেছেন, এমন মানুষদের ফুসফুসের রোগ হচ্ছে, তা নয়।
মুহম্মদবাজারের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক ডা. ইন্তেকাফ চৌধুরী বলছিলেন,‘এখানে যারা আছেন, সবাই কিন্তু খাদানে কাজ করেছেন, এরকম কিন্তু নয়। অনেকে এই এলাকায় ছিলেন বহু বছর ধরে অথবা কোনো একটাভাবে যুক্ত ছিলেন কিছু একটা কারণে।
ডা. চৌধুরী বলেন, অনেকের ক্ষেত্রে একটা স্ট্রং হিস্ট্রি পাওয়া যাচ্ছে যে খাদানে কাজ করতেন বা ক্রাশারে কাজ করতেন অথবা সিলিকা-যুক্ত যেসব এলাকা, সেখানে কাজ করতেন, যেখানে ডাস্টের এক্সপোজার সবথেকে বেশি। আমি গত দুবছর ধরে যা দেখেছি, এখানে শ্বাসকষ্টের পেশেন্ট বেশ ভালো সংখ্যায় আছে।’
ফেব্রুয়ারি মাসে চিহ্নিত তিনজন সিলিকোসিস রোগী এখনো পেনশন বা এককালীন ক্ষতিপূরণ পাননি। স্থানীয় প্রশাসন দেখলাম খুবই তৎপর এই ব্যাপারে। তারা বলছে, ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
ফুসফুসের রোগী অনেক বেশি
সরকারি তৎপরতার পাশাপাশি অতি সম্প্রতি মুহম্মদবাজারের দেউচা-পাচামী অঞ্চলে কয়েকজন সমাজকর্মী একটা স্বাস্থ্য শিবির করেছিলেন।
ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখের ওই শিবিরে ১৬০ জন স্থানীয় বাসিন্দার স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়।
সিলিকোসিস রোগ নির্ণয়ের জন্য ওই স্বাস্থ্য শিবিরে ঠিক কীভাবে পরীক্ষা করতে হবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন, আইএলও-র মান অনুযায়ী, সেটি ঠিক করে দিয়েছিলেন পেশা-জনিত রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কুনাল দত্ত। তিনি ওই অঞ্চলে প্রায় ১৪ বছর আগেও এরকমই একটা স্বাস্থ্য শিবির করেছিলেন।
তিনি বলেন,‘বীরভূমের এই যে অঞ্চল, যেখানে খাদান এবং ক্রাশার চলছে, এই অঞ্চলের যদি স্বাস্থ্য সংখ্যাতত্ত্ব দেখেন, এই অঞ্চলের ফুসফুসের অসুখ সেটা টিবি হোক, ব্রঙ্কাইটিস হোক বা সিলিকোসিস যা ডায়গনসিস হয়েছে হোক-সেটার পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গের নন-ক্রাশার, নন-খাদান এলাকার তুলনায় চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। এটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি।’
সর্বশেষ স্বাস্থ্য শিবিরে আসা ১৬০ জনের মধ্যে ২৪ জনের শরীরে সিলিকোসিস বাসা বেঁধেছে বলে তার সন্দেহ। এদের মধ্যে ১২ জন নারী এবং ১২ জন পুরুষ। বয়স ৩০ থেকে ৭০ এর মধ্যে।
এ বছরের স্বাস্থ্য শিবিরে যত জনকে সিলিকোসিস রোগী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, প্রায় দেড় দশক আগের স্বাস্থ্য শিবিরেও সন্দেহজনক সিলিকোসিস রোগীর সংখ্যাটাও অনেকটা একই ছিল।
মুখে‘গামছা বাঁধতাম’
যে ‘খড়ি কোম্পানি’-র কথা বলেন, কামালুদ্দিন, সেই খড়ি মাটির কারখানা বীরভূমের মুহম্মদবাজারে বেশ অনেকগুলিই চোখে পড়েছে আমাদের। কামালুদ্দিন যে এলাকায় থাকেন, সেই প্যাটেলনগরেও নজরে এসেছে খড়ি মাটির আর ‘রিফ্র্যাক্টরি’ কারখানা।
খড়ি মাটি দিয়ে যেমন দারুণ সুন্দর আলপনা দেওয়া হয়, তেমনই ইস্পাত বা বিভিন্ন কারখানার ব্লাস্ট ফার্নেসে ব্যবহৃত ‘ফায়ার ব্রিক’ তৈরিতে এবং, ব্যাপকভাবে চিনামাটির নানা জিনিস তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়।
শেখ কামালুদ্দিনের সাথে কথা বলার সময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, আর মনে হচ্ছিল ওই ‘চিনামাটি’র কাপেই তো চা খাই আমরা! ওই খড়ি মাটি দিয়েই তো আলপনা দেয়া হয়, আর সেই মাটির যোগান দিতে গিয়েই ফুসফুসের এই দুরারোগ্য রোগ বাঁধল তার!
তিনি বলেন, নাক মুখ ঢাকার জন্য তো মাস্ক বা অন্য কোনো আবরণ থাকত না, তাই মুখে গামছা বেঁধেই তিনি প্রায় ৩৫ বছর কাজ করেছেন ওই ‘খড়ি কারখানা’-তে।
একটু হাঁপাতে হাঁপাতেই তিনি বলেন, মুখে কিছু দিত না তো, ওই গামছা বাঁধতাম। গামছা বেঁধে কাজ করতাম। শ্বাসকষ্ট হইলে তখন ওই ডাক্তার দেখাইতাম, ওষুধপত্র খাইলে কমে যেত। তিন-চারজন যারা ওইখানে কাজ করত, তারা মারা গেছে।
মুহম্মদবাজার এলাকার পাথর খনি আর ক্রাশার এলাকাগুলোতে কোথাওই চোখে পড়েনি যেকারো মুখে কোনো আবরণ আছে। শ্রমিক হোন, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া গ্রামের নারী-পুরুষ অথবা স্কুল থেকে সাইকেল চালিয়ে বাড়ির পথ ধরা ছেলে-মেয়েরা বা একটা বিয়ে বাড়িতে আসা অভ্যাগতদের কাউকেই দেখলাম না মাস্ক অথবা অন্য কোনও ধরনের মুখ-আবরণী ব্যবহার করতে।
বিপদে পরিবেশ
হাবড়াপাহাড়ী গ্রামের সমাজকর্মী সাদি হাঁসদা বলেন, এমন অনেক এলাকা আছে, যেখানে খোলা জিনিসপত্র রাখলেই সেসব পাথরের ধুলোয় ঢেকে যায়।
‘হরিণসিং-এ, আর ওই কেতপাহাড়ি, এখানে পাথরচাল, নতুনপাড়া ওইগুলোতে এরকম থালা বাসন বাটি রাখলে পুরো ধুলোয় ভর্তি হয়ে যায়। কাপড়চোপড়ও রাখা যায় না।’
সেটি আমরাও বিলক্ষণ টের পাচ্ছিলাম। গাড়ির জানালার কাঁচ নামানোই যাচ্ছিল না। যখন মানুষের সাথে কথা বলতে গাড়ি থেকে নামছিলাম তখন দেখছিলাম, ওই রাস্তায় চলতে চলতে আমাদের গাড়ির ওপরেও মোটা ধুলোর আস্তরণ পড়েছে।
মনে হচ্ছিল আমরা তো এসেছি দু’দিনের জন্য, আর যারা এই পরিবেশে সারা বছর থাকেন, বছরের পর বছর থাকেন, তাদের তাহলে কী অবস্থা হতে পারে!
সমাজকর্মী কুনাল দেব বলেন, এই জন্যই এটাকে শুধুমাত্র পেশা-জনিত রোগ, অর্থাৎ যারা পাথর খাদানে কাজ করে, তাদের সমস্যা বললে হবে না। এটা এনভায়রনমেন্টাল হ্যাজার্ড।
তিনি প্রায় আড়াই দশক ধরে এই অঞ্চলে সামাজিক কাজ করেন এবং ‘উথনাও’ সামাজিক সংগঠনের সম্পাদক।
তার কথায়, ‘গোটা অঞ্চলে যেভাবে ধুলো উড়ছে, যেভাবে ট্রাকগুলো যায় ওভারলোডেড ট্রাক চলে, তার ফলে যে ধরনের মেটাল রোড তৈরি হয় ইনিশিয়ালি, যে ছয়মাসের বেশি টেকে না, তার ফলে আরো বেশি ধুলো ওড়ে। জল যেভাবে দেয়ার কথা, সেটা দেয়া হয় না, খুবই অনিয়মিত। তার ফলে ২৪ ঘণ্টাই ওখানে রাস্তা থেকে ধুলো ওড়ে। রাস্তার পাশে যেসব বাড়িঘর থাকে, সাঁওতাল গ্রামগুলোতে, তারা কিন্তু ওই ধুলোটা খায়।’
দেবই বলছিলেন যে কয়েকশো পাথর খনি আর ক্রাশারের বেশিরভাগটাই চলে বেআইনিভাবে।
বেআইনি খনি আর ক্রাশার
শুধু মুহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা-পাচামী অঞ্চলেই প্রায় ছয়শোটি পাথর খনি আর ক্রাশার চলে। লাগোয়া এলাকা শালভদ্রায় রয়েছে আরো প্রায় আড়াইশোটি খনি।
পাথর খনি শিল্পের সূত্রগুলো জানিয়েছে এর মধ্যে দেউচার ১৫২টি আর শালভদ্রার গোটা ১২ খনির আইনি অনুমতি আছে। বাকি সবগুলোই চলে বেআইনিভাবে।
আবার পুরো বীরভূম জেলায় বেআইনি পাথর খনির সংখ্যা হাজারেরও বেশি, বৈধ খনি দুশোরও কম।
তবে প্রশাসন অবশ্য স্বীকারই করে না যে বীরভূমে কোনও অবৈধ খনি আছে।
বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ বলেন,‘এখানে পাথর ব্যবসা আছে। পাথর ব্যবসা থাকার প্রয়োজন আছে, নাহলে ডেভেলপমেন্টের কাজ হবে না। রাস্তা থেকে, ড্রেন থেকে নির্মাণ, কিছুই হবে না, উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যাবে। তবে আমাদের কাছে অবৈধ পাথর খাদানের কোনো খবর নেই। বৈধ খাদান যতগুলো আছে, ততগুলোই চলছে। অবৈধ খাদান আমরা চলতে দেব না প্রশাসনিকভাবে আর চলবেও না বীরভূম জেলাতে।’
জেলা প্রশাসন স্বীকার না করলেও কয়েক বছর আগেই এই অঞ্চলের বহু পাথর খনি যে অবৈধ, তা ঘোষণা করে সেগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত।
আবার এই পাথর খনি থেকে নির্গত মিহি পাথর-গুঁড়া যে মানুষের শরীরে রোগ বাধাচ্ছে, তা নিয়ে সরব হয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।
তা সত্ত্বেও কীভাবে চলে এই অবৈধ খনিগুলি?
একজন লাইসেন্স-প্রাপ্ত খনি মালিক এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের সাথে কথা বলতে, তবে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম এত বড় বেআইনি ব্যবসাটা চলে কীভাবে?
তার কথায়,‘এটা আমাদের যে রাজ্য সরকার আছে, তাদের কিছু প্রভাবশালী নেতাদের পারমিশনে চলে। রাজ্য সরকারের কয়েকটি দফতরের সাথে যোগসাজশে চলছে এগুলো।
ওই খনি মালিক বলেন, সরকার পায় ২৫ শতাংশ অর্থ আর ৭৫ শতাংশ যায় প্রভাবশালী নেতাদের কাছে এবং যে ব্যক্তির নামে টেন্ডার করা হচ্ছে, তার কাছে। প্রতিটা দফতরেই টাকা যায়, রাজ্য সরকারের হোক বা কেন্দ্রীয় সরকারী দফতার।
দূষণ থেকে মুক্তি কীভাবে?
পাথর গুঁড়ার দূষণ থেকে বাঁচার উপায় খুবই সহজলভ্য, বলছেন, বিশেষজ্ঞরা।
পেশা-জনিত রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কুনাল দত্তের কথায়,‘সেফ প্র্যাকটিস আছে। যেকোনো জায়গায় ডাস্ট এমিশন প্রিভেন্ট করার জন্য হয় এনক্লোজড লোকাল এক্সহস্ট ভেন্টিলেশন পদ্ধতিতে বড় পাখা দিয়ে টেনে নেয়া হবে ধুলোটাকে। অথবা ড্রাই প্রসেসের বদলে ময়েস্ট প্রসেস স্প্রিঙ্কলার লাগিয়ে জল ছেটানো হবে।
কুনাল দত্ত বলেন, খুব সহজ পদ্ধতি, এগুলো টেকনোলজিকালি বিরাট কিছু রকেট সায়েন্স নয়। কিন্তু এগুলো করা হবে না। কারণ বেআইনিভাবে যেখানে এই জিনিস চলতে পারে, মানুষের জীবন নেয়ার মতো ঘটনা চলতে পারে, সেখানে এই ছোট ছোট জিনিস করতে গেলে তাদের খরচ বাড়বে। ফলে প্রফিট কমে যাবে, তাই করবে না।
তবে সরকার এই অঞ্চল নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে দেউচা পাচামীর মানুষ হয়তো ভবিষ্যতে পাথর-গুঁড়ার দূষণ থেকে রক্ষা পাবেন, কিন্তু সম্ভাবনা রয়েছে অন্য এক দূষণের কবলে পড়ার।
এই দেউচা-পাচামী অঞ্চলে পাথরের স্তরের নিচে পাওয়া গেছে ভারতের সব থেকে বড় কয়লা ভাণ্ডার।
গোটা এলাকা জুড়ে কয়লা খনি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে এখন।
তাই পাথর গুঁড়ার দূষণ থেকে রক্ষা পেলেও ভবিষ্যতে হয়তো এখানকার মানুষকে সহ্য করতে হবে কয়লা গুঁড়ার দূষণ।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা