দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসাথে কী বলল অস্ট্রেলিয়া
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০২ মে ২০২৪, ২১:০৪
অস্ট্রেলিয়ায় ২০২০ সালে ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ অভিযান চালিয়ে যে দুই গুপ্তচরকে ওই দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তারা ভারতীয় ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষাবিষয়ক ক্ষেত্রে নজরদারির পাশাপাশি একাধিক অভিযোগ তোলা হয়েছে ওই ভারতীয় গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে।
একাধিক সংবাদমাধ্যমে এই খবর পর ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কথা দাবি করেছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার।
২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জানিয়েছিলেন তাদের দেশে কিছু বিদেশী এজেন্ট সক্রিয় রয়েছে। যদিও সেই এজেন্টরা কোন দেশের, এই বিষয়ে সে সময় কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি তিনি।
এদিকে, চলতি সপ্তাহে একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রধান যে বিদেশী গুপ্তচরের কথা বলেছিলেন, তারা ভারতীয়। অস্ট্রেলিয়ার সরকার অবশ্য এই দাবি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি।
তবে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং জানিয়েছেন, যেকোনো বিদেশী হস্তক্ষেপের সাথে মোকাবিলা করতে তার সরকার প্রস্তুত।
অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার কোষাধ্যক্ষ জিম শার্লেমার্স বুধবার সংবাদ সংস্থা ‘অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’কে (এবিসি নিউজ) বলেন, ‘আমি এই ব্যাপারে না ঢোকার কথাই বলব।’
‘ভারতের সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে… এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পর্ক। উভয় পক্ষের চেষ্টার ফল স্বরূপ সাম্প্রতিক সময়ে দু’টো দেশ আরো কাছাকাছি এসেছে।’
প্রসঙ্গত, এই অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে এমন একটা সময়ে যখন ভারতের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে গোয়েন্দা অভিযান চালানোর অভিযোগকে ঘিরে ইতোমধ্যে তোলপাড় চলছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে গত বছর খালিস্তানি নেতা ও মার্কিন নাগরিক গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার চেষ্টায় (যা ব্যর্থ হয়) জড়িত ছিল, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র‘।
বিক্রম যাদব নামে ভারতীয় এক এজেন্টের কথাও ওই প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি ভাড়াটে খুনিদের পান্নুনের বাসস্থান এবং অন্যান্য তথ্য দিয়েছিলেন বলেও দাবি করা হয়েছে সাম্প্রতিক প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে।
যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন একটা গুরুতর বিষয়ে ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘ভিত্তিহীন’।
অনিদিকে, দ্য গার্ডিয়ান দিন কয়েক আগে তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বিদেশের মাটিতে বসবাসকারী দেশবিরোধীদের নির্মূল করার জন্য ভারত বিস্তৃত রণকৌশল অনুসরণ করছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত ২০২০ সাল থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি কার্যকলাপ চালিয়েছে। সেই অভিযোগও অস্বীকার করেছে ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘বিদেশের মাটিতে এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড চালানো ভারতের নীতি নয়।’
ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ
তিন বছর আগে ‘অস্ট্রেলিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন’-এর (এএসআইও) প্রধান মাইক বার্গেস বলেছিলেন, ‘গুপ্তচরদের একটা নেটওয়ার্ক ২০২০ সাল জুড়ে কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক রাজনীতিবিদ, একটি দূতাবাস এবং রাজ্য পুলিশ সার্ভিসের সাথে পরিকল্পিতভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।’
সেই সময় বার্গেস বলেছিলেন, ওই এজেন্টরা ‘ভারতীয় সম্প্রদায়ের উপর কড়া নজর রেখেছিল।’ এর পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে ‘বিমানবন্দরের সুরক্ষা প্রোটোকল সম্পর্কে‘ আলোচনা করেছিল এবং ‘অস্ট্রেলিয়ান বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত গোপনীয় তথ্য পাওয়ার চেষ্টাও করেছিল।’
তিনি আরো জানিয়েছিলেন, এএসআইও ভারতীয় এজেন্টদের পরিকিল্পত অভিযান বানচাল করার আগে অস্ট্রেলিয়ার স্পর্শকাতর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ করেছিল তারা (ভারতীয় এজেন্টরা)।
সোমবার ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অভিযানের সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে দুই ভারতীয়কে বহিষ্কার করা হয়।
অন্যদিকে, এবিসি নিউজ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে ভারতীয় এজেন্টদের একটা দল অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা প্রকল্প বিষয়ক গোপন তথ্যের উপর নজর রেখেছিল।
অস্ট্রেলিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশনের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন তাদের সংস্থা ‘কোনও গোপন বিষয়ে মন্তব্য করবে না।’
ক্যানবেরার ভারতীয় হাইকমিশনও বিবিসির তরফে করা মন্তব্যের অনুরোধের জবাবে কিছু বলেনি।
ভারতের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিককালে এমন একাধিক অভিযোগ উঠেছে। বিদেশের মাটিতে ভারতের ‘গোপন কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগ সম্পর্কে পশ্চিমা মিত্রদের ‘উদ্বেগও’ প্রকাশ্যে এসেছে। এই তালিকায় গত বছরের জুন মাসে কানাডায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। যদিও সেই অভিযোগ ভারত সরকারের তরফে বারবার অস্বীকার করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্য, শক্তি এবং অভিবাসন-সহ একাধিক বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এর মাধ্যমে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের পাশাপাশি, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়াও কৌশলগত কোয়াড জোটের সদস্য। এই জোটের উদ্দেশ্য চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মাথায় রেখে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করা।
ভারত অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার। অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার লোক ভারতীয় বংশোদ্ভুত বলে দাবি করা হয়।
ভারত কী বলছে
খালিস্তানি নেতা ও মার্কিন নাগরিক গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার জড়িত থাকার দাবি জানিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ওয়াশিংটন পোস্ট, সেটিকে ‘ভিত্তিহীন‘ বলে মন্তব্য করেছে ভারত সরকার। মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদনের বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
মঙ্গলবার এক বিবৃতি জারি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ওই প্রতিবেদনে একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে।’
‘সংগঠিত অপরাধী এবং সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক নিয়ে মার্কিন সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ করার পর ভারত সরকার একটা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। তারা এর তদন্ত করছে। এই বিষয়ে অনুমান, দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য কোনওভাবেই সহায়তা করে না।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘মি. পান্নু হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অভ্যন্তরীণ মহল জানত’-এই দাবি জানিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখছে?
এর উত্তরে বেদান্ত প্যাটেল বলেন, ‘ভারতের তদন্ত কমিটির ফলাফলের ভিত্তিতে ভারত সরকার জবাবদিহি করবে বলে আমরা আশা করি। তাদের সাথে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি এবং ভারতের কাছ থেকে আরো তথ্য চাইছি।’
‘আমাদের উদ্বেগের বিষয়ে ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার বিষয়টা অব্যাহত রাখব। এর বাইরে এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’
ওয়াশিংটন পোস্টে কী বলা হয়েছে
ওয়াশিংটন পোস্টের ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, গত বছরের ২২শে জুন যে সময়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো হচ্ছিল, তখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র‘-এর এক কর্মকর্তা আমেরিকায় খালিস্তানপন্থী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার জন্য আমেরিকায় ভাড়াটে খুনিদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
সংবাদ সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘র’-এর অফিসার বিক্রম যাদব এই হত্যাকাণ্ডকে ‘এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার‘ দেওয়া হচ্ছে বলে বর্ণনা করেছিলেন।
কয়েকজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি জানায়, মি. পান্নুর নিউ ইয়র্কের বাসভবনের বিষয়ে ভাড়াটে খুনিদের জানিয়েছিলেন বিক্রম যাদবই। বলা হয়েছিল, মার্কিন নাগরিক গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নু তার বাড়িতে এলেই ‘আমাদের তরফ থেকে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পেয়ে যাবে।’
ওয়াশংটন পোস্টের প্রতিবেদনে একথা দাবি করা হয়েছে যে বিক্রম যাদবের পরিচয় এবং গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুর হত্যার ষড়যন্ত্র মামলার সাথে তার কোনওরকম যোগসূত্র এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ যে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিল, সেটা যে ‘র‘-এর দ্বারা পরিচালিত, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বিক্রম যাদবের নাম।
বর্তমান ও সাবেক পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতে, সিআইএ, এফবিআই এবং অন্যান্য সংস্থার বিস্তৃত তদন্তে ‘র‘-এর বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও তদন্তের আওতায় চলে এসেছেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট আরো দাবি করেছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও মনে করে গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে নিশানায় রেখে যে অভিযান চালানো হয়েছিল তাতে অনুমোদন ছিল ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান সামন্ত গোয়েলের।
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা, যারা ওয়াশিংটন পোস্টের সাথে কথা বলেছেন, তারা এই অভিযানের বিষয়ে জানতেন। ওই কর্মকর্তারা দাবি করেছেন বিদেশে বসবাসরত শিখ চরমপন্থীদের নির্মূল করার জন্য মি. গোয়েলের উপর চাপ ছিল।
এর আগে, গত ১৮ জুন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের কাছে খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় ভারতের হাত থাকার অভিযোগ ওঠে, যা তারা বারবার অস্বীকার করেছে।
একই সাথে ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে মোদী সরকার যাদের ‘সন্ত্রাসী‘ বলে ঘোষণা করেছিল এমন ১১ জন শিখ ও কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্ট আরো দাবি করেছে যে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সম্ভবত ‘র‘-এর এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন। তবে প্রতিবেদনে প্রকাশিত এই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত বছরের নভেম্বর মাসে আমেরিকা দাবি করেছিল, নিউ ইয়র্কের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে হত্যার জন্য কাউকে ভাড়া করেছিল ভারতীয় নাগরিক নিখিল গুপ্তা। ওই ভাড়াটে খুনিকে এক লক্ষ ডলারও দিয়েছিলেন তিনি।
মার্কিন আদালতে পেশ করা নথিতে বলা হয়েছিল, নিখিল গুপ্তা এই কাজের নির্দেশ পেয়েছিলেন ভারতের এক সরকারি কর্মীর কাছ থেকে।
আমেরিকার অনুরোধে গত বছরের জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেফতার করা হয় গুপ্তাকে। সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা