২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভারতে কেন বারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হয়

ভারতে কেন বারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। - ছবি : সংগৃহীত

ভারতে ঠিক কী কারণে শুক্রবার সন্ধ্যায় একাধিক ট্রেনের সংঘর্ষের কমপক্ষে ২৬১ জন নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও এখনো কোনো উত্তর নেই।

দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশার একটি ছোট স্টেশনের কাছে দু’টি দ্রুতগতির যাত্রীবাহী ট্রেন ও একটি মালবাহী ট্রেনের ‘ত্রিমুখী সংঘর্ষে’ এ ঘটনা ঘটে।

একটি চলন্ত ট্রেন এসে স্থির মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দেয়। এতে ওই ট্রেনের কোচগুলো পাশের তৃতীয় লাইনে উল্টে যায়, যার ফলে ওই লাইনে আগত ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়।

এ দুর্ঘটনার পেছনের সত্য উদঘাটনে ব্যাপক তদন্তের প্রয়োজন। তবুও এটি আবারো ভারতে রেলওয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগকে নতুন করে সামনে এনেছে।

ভারতের বিস্তৃত রেল ব্যবস্থা, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ হিসাবে খ্যাত। এক লাখ কিলোমিটার মানে ৬২ হাজার মাইলেরও বেশি বিস্তৃত রেললাইন সারাদেশকে এক বিশাল নেটওয়ার্কে জুড়ে রেখেছে। বছরে আড়াই কোটিরও বেশি যাত্রী এই রেল লাইন ব্যবহার করে।

ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনি বৈষ্ণবের মতে, গত বছর প্রায় পাঁচ ২০০ কিলোমিটার নতুন ট্র্যাক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি বছর আট হাজার কিলোমিটার রেল লাইন আপগ্রেড করা হচ্ছে।

অশ্বিনি বৈষ্ণব সম্প্রতি বলেছেন, বেশিরভাগ রেললাইন আপগ্রেড করা হচ্ছে যেন এর ওপর ট্রেনগুলো ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে।

এছাড়া উল্লেখযোগ্য অংশে ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার গতিতে চলাচলের জন্য রেললাইনকে উন্নত করা হচ্ছে এবং আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ এমনভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে যেন ট্রেনগুলো ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে।

স্পষ্টতই এটি সারাদেশে দ্রুত ট্রেন চলাচল নিশ্চিতে সরকারের পরিকল্পনার একটি অংশ। বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই ও আহমেদাবাদ শহরের মধ্যে একটি উচ্চ-গতিসম্পন্ন রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে।

তবুও ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া দেশটির রেলওয়ে খাতের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির রেলওয়ে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, বিবেক সাহাই এমনটাই বলেছেন।

তিনি বলছেন, একটি ট্রেন বিভিন্ন কারণে লাইনচ্যুত হতে পারে- রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হতে পারে, ত্রুটিপূর্ণ কোচের কারণে হতে পারে এবং ট্রেন চালনায় সমস্যা থেকেও হতে পারে।

ভারতের সরকারি রেলওয়ে সেফটি রিপোর্ট ২০১৯-২০-এ দেখা গেছে, রেল দুর্ঘটনার ৭০ ভাগ ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৮ ভাগ বেশি। এরপরের দু’টি কারণ হচ্ছে- ট্রেনের অগ্নিকাণ্ড ও সংঘর্ষ। যা যথাক্রমে মোট দুর্ঘটনার ১৪ ভাগ ও আট ভাগ।

প্রতিবেদনে ৪০টি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা গণনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন ও সাতটি মালবাহী ট্রেন।

এর মধ্যে ১৭টি লাইনচ্যুত হয়েছে রেললাইনে ত্রুটি থাকার কারণে। যার মধ্যে ফাটল ও রেললাইনের সংকোচন-প্রশমন দু’টি বড় কারণ।

রিপোর্ট অনুযায়ী ট্রেন-ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগনে ত্রুটির কারণে মাত্র নয়টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে।

এছাড়া ধাতুতে তৈরি রেললাইনগুলো গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রসারিত হয় এবং শীতকালে তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে সংকোচনের মধ্য দিয়ে যায়। এজন্য এই রেললাইনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়।

ঢিলে হয়ে থাকা লাইনগুলোকে টাইট দেয়া, নিয়মিত স্লিপার পরিবর্তন করা এবং অ্যাডজাস্টিং সুইচগুলোকে লুব্রিকেন্ট দিয়ে পিচ্ছিল রাখা জরুরি এ জন্য। এ ধরনের রেললাইন সাধারণত পায়ে হেঁটে অথবা ট্রলি, লোকোমোটিভ এবং রিয়ার ভেহিকলে চড়ে পরীক্ষা করা হয়।

ভারতের রেলপথগুলোর সক্ষমতা ট্র্যাক রেকর্ডিং কারের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। মূলত লাইনের ওপর দিয়ে ট্রেনগুলো প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার থেকে ১৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে কি-না এবং লাইনগুলো সে অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়েছে কি-না তা মূল্যায়ন করে থাকে।

ভারতে ২০১৭ সালের এপ্রিল এবং ২০২১ সালে মার্চ মাসের মধ্যে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় নিরীক্ষকদের প্রতিবেদনে কিছু বিষয় উঠে এসেছে :

- রেললাইনগুলোর জ্যামিতিক এবং কাঠামোগত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার জন্য ট্র্যাক রেকর্ডিং কারগুলোর পরিদর্শনে ৩০ ভাগ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত ঘাটতি ছিল, রিপোর্টে বলা হয়েছে।

- লাইনচ্যুত হওয়ার এক হাজার ১২৯টি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করা হয়।

- লাইনচ্যুত হওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ অভাব। এ কারণে ১৭১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনুমোদিত সীমার বাইরে ট্র্যাক প্যারামিটারগুলোর বিচ্যুতির কারণে এমনটা হয়েছে।

- যান্ত্রিক কারণে ১৮০টিরও বেশি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি কোচ এবং ওয়াগনে ত্রুটির কারণে ঘটেছে।

- ‘খারাপ ড্রাইভিং এবং অতিরিক্ত গতি’ লাইনচ্যুত হওয়ার জন্য দায়ী অন্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।

কেন করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়েছিল তা তদন্ত করলেই জানা যাবে।

ভারতীয় ট্রেনগুলোতে অ্যান্টি-কোয়ালিশন ডিভাইসগুলো স্থাপনের বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। তবে এ সিস্টেম এখন পর্যন্ত কেবল দু’টি প্রধান রুটে বসানো হচ্ছে। দিল্লি ও কলকাতার মধ্যে এবং দিল্লি ও মুম্বাইয়ের মধ্যে। রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা এই তথ্য দিয়েছেন।

এর আগে ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে এক যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে আসতে থাকা মালবাহী ট্রেনের সাথে সংঘর্ষে ১৫০ জনেরও বেশি নিহত হয়।

তদন্তকারীরা বলেছেন, মাওবাদীরা রেললাইনে নাশকতা করার কারণে কলকাতা-মুম্বাই যাত্রীবাহী ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছিল। ওই ঘটনায় পাঁচটি যাত্রীবাহী বগি পাশের লাইনে ছিটকে পড়ে এবং ওই লাইনে আসতে থাকা মালবাহী ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ হয়।

শুক্রবারের দুর্ঘটনায় এখনো কোনো নাশকতার আভাস পাওয়া যায়নি।

ভারতীয় রেলওয়ের মতে, ২০২১-২২ সালের মধ্যে ৩৪টি রেল-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত, ট্রেনে আগুন বা বিস্ফোরণ, লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সাথে রাস্তার যানবাহন সংঘর্ষ ইত্যাদি। সংখ্যার হিসাবে আগের বছরের তুলনায় ২৭টি বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

৩১ মে ‘দ্য হিন্দু’ সংবাদপত্র জানিয়েছে, ২০২২-২৩ সালে এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে ৪৮টি হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনার বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন এবং তারা তাদের সিনিয়র ম্যানেজারদের বলেছেন যে ট্রেনের ক্রুদের দীর্ঘ সময় কাজ করানোর অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে।

বিশেষ করে ইস্ট কোস্ট রেলওয়ে এবং সাউথ ইস্ট সেন্ট্রাল রেলওয়েতে এমন অভিযোগ বেশি এবং এ বিষয়ে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে বলেছেন তারা।

শুক্রবার সন্ধ্যার দুর্ঘটনার স্থানটি ইস্ট কোস্ট রেলওয়ে জোনে পড়েছে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement