চীনে অফিস পার্টিতে মদ্যপানের ‘বিষাক্ত‘ সংস্কৃতি নিয়ে বাড়ছে জনরোষ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১০:০৪
চীনে কাজের পর অফিস পার্টির প্রচলন বহুদিনের। এসব পাটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মদ্যপানের একরকম অলিখিত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কাজের জায়গায় বহুদিন ধরে চলা এই সংস্কৃতি এখন দেশটির জনগণের কাঠগড়ায়।
চীনের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি কোম্পানি আলিবাবার এক অফিস পার্টিতে এক নারী কর্মচারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর থেকে কর্পোরেট জগতে ক্ষমতাধরদের আচরণ নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ চীনা নাগরিক মদ্যপানের জন্য অফিস কর্মীদের ওপর জবরদস্তি করার এই 'বিষাক্ত সংস্কৃতির' অবসান দাবি করছেন।
চীনে কাজের পর ঘন ঘন অফিস পার্টির সংস্কৃতি বহুদিনের। কর্মীরা একজোট হয়ে মদ্যপান, হই-হুল্লাহ করেন। এসব পার্টিতে অংশ নেয়ার অলিখিত বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।
যেমন, মিং শিকে প্রতি দু-সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন কাজের পর সহকর্মীদের সাথে মদ্যপান করতে যেতে হয়।
মিং শি এই নারীর ছদ্ম নাম। কারণ তিনি তার পরিচয় গোপন রাখতে চান।
এসব অফিস পার্টি তার একবারেই পছন্দ নয়। কারণ এ পার্টিগুলো এমন নয় যে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারে কোনো পানশালায় সহকর্মীদের সাথে বসে দু-এক গ্লাস বিয়ার পান করে বাসায় ফেরা যায়।
বরং দেখা যায়, এসব পার্টিতে অনেক সময়ই কোম্পানির ক্লায়েন্টরা আসে এবং তাদের সাথে হেসে কথা বলতে হয়, তাদের সাথে মদের গ্লাসে ঠোকাঠুকি করতে হয়।
এগুলো নিয়ে কখনই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি গুয়াংজুভিত্তিক এই জনসংযোগ পরামর্শক।
‘যদিও আমি নিজে পানের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, কিন্তু তারপরও কখন পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ে - তা নিয়ে সবসময় আমার মধ্যে ভয় কাজ করে,’ বিবিসিকে বলছিলেন ২৬ বছরের মিজ মিং ।
‘হঠাৎ হঠাৎ কেউ কেউ যৌন বিষয়ক নানা রসিকতা করে। অস্বস্তি হলেও তখন মজা পাওয়ার ভান করতে হয়।’
মিং শি-র মত বহু তরুণী অফিস কর্মচারী একই ধরণের অভিজ্ঞতার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন। তারা বলছেন, ইচ্ছা না থাকলেও এসব অফিস পার্টিতে তাদের যেতে হয়। কারণ, চীনে ব্যবসা পেতে এবং উচ্চপদস্থদের সুনজরে থাকার জন্য 'গুয়াংশি' অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পর্কের রাখার গুরুত্ব অনেক।
ধর্ষণ কেলেঙ্কারিতে আলিবাবা
প্রযুক্তি জায়ান্ট আলিবাবার একজন সিনিয়র ম্যানেজারের বিরুদ্ধে মদ্যপানে অচেতন এক অধস্তন কর্মচারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর চীনের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর পার্টিতে বেসামাল মদ্যপানের যে সংস্কৃতি - তা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।
ওই কোম্পানির একজন নারী কর্মচারী তার ১১-পাতা জোড়া অভিযোগপত্রে বলেছেন, কোম্পানির এক বিজনেস ট্রিপে গিয়ে রাতভর এক মদের পার্টিতে অচেতন হয়ে পড়লে তিনি ধর্ষণের শিকার হন। তার এই দীর্ঘ অভিযোগপত্রটি চীনা সোশ্যাল মিডিয়া উইবোতে ভাইরাল হয়ে যায়।
আলিবাবার ওই নারী কর্মচারী অভিযোগ করেন, ব্যবসা সম্পর্কিত এক ডিনার পার্টিতে তার ঊর্ধ্বতনরা তাকে জোর করে প্রচুর মদ পান করান। পরে সকালে তার হোটেল রুমে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তিনি নগ্ন। আগের রাতের ঘটনা তিনি মনে করতে পারেননি।
পরে হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটে ওই নারী দেখেন, তার ম্যানেজার ওই রাতে চারবার তার হোটেল কক্ষে গেছেন।
আলিবাবা তাদের অভিযুক্ত ওই ম্যানেজারকে বরখাস্ত করেছে।
কিন্তু চীনা সরকারি কৌঁসুলিরা ওই ম্যানেজারের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। তাদের কথা, মদ পানে জবরদস্তি করা বড় কোনো অপরাধ নয়। চীনা পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত ওই ব্যক্তি তার শাস্তি হিসাবে ১৫ দিন আটক থাকবেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নতুন করে আর কোনো তদন্ত হবে না।
তবে চীনা সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে ঝড় শুরু হয়েছে। শুধু যে কাজের জায়গায় যৌন হয়রানির সমালোচনা হচ্ছে তাই নয়, কাজের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মদ্যপানের জন্য কর্মচারীদের জবরদস্তি করার যে 'বিষাক্ত সংস্কৃতি' - তার বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ শুরু হয়েছে।
'কাজের জায়গায় মদপানের সংস্কৃতি নিয়ে আপনাদের মত কী' এই হ্যাশট্যাগে উইবোতে এক পোস্টে ১১ কোটি হিট হয়েছে। সেখানে মানুষজন কাজের জায়গায় ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পার্টিতে তাদের ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন।
'প্রত্যাখ্যান মানেই অসম্মান'
চীনের পূর্ব এশীয় প্রতিবেশী দেশগুলোতেও একইরকম ব্যবসা-কেন্দ্রিক মদ্যপানের সংস্কৃতি প্রচলিত।
জাপানের 'নোমিকাই' এবং দক্ষিণ কোরিয়ার 'হোসিক' নামের অফিস পার্টিকেও কর্মস্থলে বা ব্যবসাক্ষেত্রে গভীর সম্পর্ক তৈরির পন্থা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সম্মান-আনুগত্য দেখাতে জুনিয়র কর্মচারীদের অনেক সময়ই সিনিয়রদের সাথে মদ পান করতে হয়। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খরিদ্দারদের তুষ্ট করতেও একই কাজ করে।
‘আপনাকে তার সাথে মদ খেতে ডাকার জন্য ঊর্ধ্বতনদের উদ্দেশ্যে অনেক প্রশংসাসূচক শব্দ প্রয়োগ করতে হয়। কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়,’ বলেন মিজ রুই মা, যিনি চীনের বিভিন্ন জায়গায় এসব ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ডিনার পার্টিতে গেছেন।
‘আপনি যতবার অন্যের সাথে মদের গ্লাসে ঠোকাঠুকি করবেন, ততই মাতাল হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।’
অনেক সময় সিনিয়র ম্যানেজাররা তাদের নিজেদের বোতল খালি করার জন্য সদ্য নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের চাপ দেন।
‘বসের মুখের ওপর না বলা খুবই কঠিন। কারণ চীনে প্রশাসনিক কাঠামোতে উঁচু-নিচুর পার্থক্য খুবই সুস্পষ্ট,’ বলেন মিজ মা। এ কারণে কোনো কর্মচারীর পক্ষে এ ধরণের ডিনারের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা প্রায় অসম্ভব।
‘এমন কোনো দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকে প্রচণ্ড বেয়াদবি হিসাবে দেখা হয়। যে কর্মচারী তার ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে চান, তারা এমন প্রত্যাখ্যানের কথা ভাবতেই পারেন না।,’ বলছেন চীনের ব্যবসা বিষয়ক পরামর্শক সংস্থা ডাক্সু'র বিশ্লেষক হ্যান উ লিউ।
‘এসব ডিনার পার্টি জুনিয়র কর্মচারীদের ক্যারিয়ারের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব জায়গায় তারা তাদের বসদের প্রশংসা তোয়াজ করার সুযোগ পান। কিন্তু সবাই এতে স্বস্তি পান না,’ তিনি বলেন।
চীনা সরকার ২০১৬ সালে সরকারি কর্মচারীদের জন্য কাজের সময় মদ ছোঁয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি এই আদেশের আওতায় নেই।
মদ্যপানের সাথে কাজের দক্ষতার কী সম্পর্ক?
গত বছর জানুয়ারিতে শেনজেনে এক নিরাপত্তা রক্ষী তার বসের চাপে কাজ শেষে মদ্যপান নিয়ে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অ্যালকোহলের বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় মারা যাযন। তার আরেক সহকর্মীকে হাসপাতালে যেতে হয়।
এরপর গত আগস্টে, একজন তরুণ ব্যাংক কর্মচারী অভিযোগ করেন, এক অফিস পার্টিতে নির্দেশমতো পান না করার জন্য তার সিনিয়র তার গালে চড় মারেন, গালিগালাজ করেন। একটি অনলাইন চ্যাট গ্রুপে এ কথা লেখার পর বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ হয়েছিল।
ওই তরুণ ব্যাংক কর্মী লিখেছিলেন, ‘অনেক সহকর্মী এত মদ পান করেছিলেন যে তাদের অনেকে বমি করেছেন। এবং বেসামাল এক কর্মকর্তা নারী সহকর্মীদের গায়ে হাত দিয়েছেন।’ তিনি লেখেন, ‘আমি আমার হিউম্যান রিসোর্স বিভাগকে জিজ্ঞেস করতে চাই: আমার মদ্যপান না করার সাথে আমার কাজের দক্ষতার কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে?’
এর জবাবে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে একজন সিনিয়র কর্মকর্তা সীমা লঙ্ঘন করেছেন এবং তার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়। আরো জানানো হয়, ওই কর্মকর্তাকে সতর্ক করা হয়েছে এবং তার বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছে।
এ বছরের গোঁড়ার দিকে ক্রিস উ নামের এক সেলেব্রিটিকে নিয়ে একটি ধর্ষণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযোগ ওঠে তরুণীদের চাকরি দেওয়ার লোভ দিয়ে সাক্ষাৎকারে ডেকে তাদের জোর করে মদ পান করানো হয়। ক্রিস উ অবশ্য তা অস্বীকার করেন।
জোর করে মদ্যপান করানোর সাম্প্রতিক এমন বেশ কিছু কেলেঙ্কারির পর, অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, চীনের ব্যবসা-সম্পর্কিত পার্টিতে জবরদস্তি মদ্যপানের প্রচলিত প্রথা হয়ত খুব দ্রুত নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
‘ব্যবসা সংশ্লিষ্ট এসব মদের পার্টি বহুদিন ধরে চলছে, কিন্তু আলিবাবার ঘটনা নিয়ে জনমনে যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচেছ - তা সম্ভব হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে,’ বিবিসিকে বলেন ডাক্সুর পরামর্শক মি. লিউ।
‘চীনারা ইন্টারনেটে খুবই তৎপর। এত মানুষ অনলাইনে জড়িত যে তারা যে কোনো ব্যাক্তি বা কোম্পানিকে মুহূর্তের মধ্যে বড় ধরণের চাপে ফেলতে পারে।’
'জঘন্য' এই রীতি বন্ধ হোক
হালে এমনিতেই চীনের বেশ কিছু বড় কোম্পানি নানা বিষয় নিয়ে সরকারি চাপের মুখে পড়েছে। ফলে কেলেঙ্কারি নিয়ে তারা এখন খুবই ভীত।
‘চীনের কর্পোরেট জগতের সাথে রাজনীতির যে একটা টানাপড়েন দেখা যাচ্ছে - তাতে এসব প্রতিষ্ঠান এখন কোনোভাবেই চাইবে না যে কোনো কেলেঙ্কারির সূত্রে তাদের ওপর নজর পড়ুক,’ বলেন লিউ।
আলিবাবাকে নিয়ে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পর কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ড্যানিয়েল ঝাং এক নোটে তার কর্মচারীদের আশ্বস্ত করেছেন, কোম্পানি জবরদস্তি মদ্যপানের সংস্কৃতির ঘোর বিরোধী।’
চীনের দুর্নীতি-বিরোধী সংস্থা এই 'জঘন্য' কর্পোরেট সংস্কৃতি বন্ধের ডাক দিয়েছে। অনলাইনে এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে এ ব্যাপারে তারা চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর নজরদারি বাড়াবে।
‘চীনে কাজের পর মদ্যপানের দীর্ঘদিনের প্রচলিত রীতি নিশ্চিতভাবে বদলাবে,’ বলেন লিউ।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা