মকবুল ফিদার চিত্রকর্ম বাজেয়াপ্ত করল ভারত
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯:৩৬
ভারতের রাজধানী দিল্লির এক আদালত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেইনের দু'টো চিত্রশিল্প বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। পাতিয়ালা হাউজ কোর্টের ফার্স্টক্লাস জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এই নির্দেশ দিয়েছেন।
সম্প্রতি দায়ের করা এক অভিযোগে জানানো হয়, এমএফ হুসেইনের আঁকা হিন্দু দেব-দেবীর সম্বলিত দু'টো চিত্রকর্ম দিল্লির এক চিত্র প্রদর্শনশালায় প্রদর্শন করা হয়েছিল যা ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে।’ অমিতা সচদেবা নামে পেশায় এক আইনজীবী ওই অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
এই মামলার প্রেক্ষিতে চলতি সপ্তাহে পুলিশকে ওই চিত্রকর্ম বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছে দিল্লির আদালত।
তবে এমন ঘটনা নতুন নয়। ২০১১ সালে ৯৫ বছর বয়সে মারা যাওয়া এই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীকে তার চিত্রকর্মে হিন্দু দেব-দেবীর নগ্ন ছবি চিত্রায়নের জন্য প্রায়শই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
যে প্রদর্শনীকে ঘিরে বিতর্ক সেটা আয়োজন করেছিল দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ডিএজি)। তবে ডিএজি কর্তৃপক্ষ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, পুলিশ এই মামলায় ‘বিস্তারিত’ তদন্ত করেছে। পুলিশি তদন্তের সময় প্রদর্শনশালার পক্ষ থেকে কোনোরকম ‘বিচারযোগ্য অপরাধ’ পাওয়া যায়নি।
গত বছর অক্টোবর মাসে আয়োজন করা হয়েছিল ওই প্রদর্শনী। 'হুসেইন : দ্য টাইমলেস মডার্নিস্ট' শীর্ষক ওই প্রদর্শনীতে ২৬ অক্টোবর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার আঁকা শতাধিক চিত্রকর্ম প্রদর্শন করা হয়েছিল।
অভিযোগকারী অমিতা সচদেবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটারে)-এ লেখেন গত ৪ ডিসেম্বর তিনি ডিএজি-র প্রদর্শনশালায় প্রদর্শিত ‘আপত্তিকর চিত্রগুলোর’ ছবি তুলেছিলেন। এই শিল্পীর বিরুদ্ধে ওঠা আগেকার অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ-খবর করার পাঁচ দিন পর তিনি পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন।
এরপর ১০ ডিসেম্বর সচদেবা জানান, তদন্তকারী পুলিশ অফিসারকে সাথে নিয়ে ওই চিত্র প্রদর্শনশালায় গিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় তিনি লক্ষ্য করেন ওই দু'টো চিত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তার অভিযোগ প্রদর্শনশালার তরফে জোর দিয়ে বলা হয়, ওই দু'টো চিত্র কখনো প্রদর্শনীতে রাখাই হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে সচদেবা তার তোলা যে ছবি পোস্ট করেছেন সেখানে নগ্ন নারীর পাশে হিন্দু দেবতা গণেশ ও হনুমানকে চিত্রিত করা হয়েছে।
একইসাথে ওই আইনজীবী আরো অভিযোগ করেছেন যে সংশ্লিষ্ট মামলার রিপোর্ট জমা দিতে ‘ব্যর্থ হয়েছে’ দিল্লি পুলিশ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর অমিতা সচদেবা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রদর্শনশালার সেই সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণের আবেদন জানান যে সময় ওই দু'টো চিত্র প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ।
চলতি সপ্তাহের সোমবার দিল্লির পাতিয়ালা হাউস কোর্টের বিচারক জানান, সিসিটিভির ফুটেজ হাতে পাওয়ার পর সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ।
তদন্তে জানা গেছে, ব্যক্তিগত পরিসরে ওই প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছিল এবং এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এই শিল্পীর নিজস্ব কর্মকে তুলে ধরা।
এদিকে, ডিএজি কর্তৃপক্ষ একটা বিবৃতিতে জানিয়েছে, তদন্তের সময় তাদের তরফ থেকে পুলিশকে সবরকমের সাহায্য করা হয়েছে। একইসাথে এও জানানো হয়েছে আনুমানিক পাঁচ হাজার দর্শককে আকৃষ্ট করেছে 'হুসেইন : দ্য টাইমলেস মডার্নিস্ট' শীর্ষক প্রদর্শনী এবং ‘গণমাধ্যমের পাশাপাশি জনসাধারণের কাছ থেকেও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া মিলেছে।’
প্রদর্শনশালার দাবি, অভিযোগকারীই একমাত্র দর্শক যিনি ওই প্রদর্শনীর কোনো শিল্পকর্ম নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।
বিবৃতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অভিযোগকারী ইচ্ছাকৃতভাবে ওই ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশনের খবর মারফর প্রচার করেছেন যাতে আরো বড় সংখ্যক মানুষ তা দেখতে পান এবং পাশাপাশি এই যুক্তিও দিয়েছেন যে ওই একই চিত্র তার ব্যক্তিগত ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে।’
মকবুল ফিদা হুসেইন ভারতের অন্যতম নামকরা চিত্রশিল্পীদের মধ্যে একজন ছিলেন। ‘ভারতের পিকাসো’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। লাখ লাখ ডলারে বিক্রি হয়েছে তার বিভিন্ন শিল্পকর্ম। কিন্তু তার বহু চিত্রশিল্পই ভারতে বিতর্কের সৃষ্টিও করেছে।
কর্মজীবনে একাধিক বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে হুসেইনকে। তার বিরুদ্ধে ‘অশ্লীলতার’ অভিযোগ যেমন তোলা হয়েছিল, তেমনই হিন্দু দেবীর নগ্ন চিত্র আঁকার পর কট্টরপন্থী হিন্দুদের নিন্দার সম্মুখীনও হতে হয়েছে এমএফ হুসেইনকে।
তার চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ‘মাদার ইন্ডিয়া’ নিয়ে বিতর্কের পর প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এই চিত্রশিল্পী। এটা ২০০৬ সালের ঘটনা। 'মাদার ইন্ডিয়া' শীর্ষক চিত্রে এক নগ্ন নারীকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ভারতীয় মানচিত্রের আকৃতি তৈরি করতে দেখা যায়, যাকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
ওই বছরই দেশত্যাগ করেন হুসেইন এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনেই ছিলেন তিনি।
এরপর ২০০৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মকবুল ফিদা হুসেইনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করতে অস্বীকার করে। শীর্ষ আদালতের তরফে জানানো হয়েছিল, তার চিত্রকর্ম কোনোভাবেই ‘অশ্লীল’ ছিল না এবং ভারতীয় আইকনোগ্রাফি ও ইতিহাসে নগ্নতা কিন্তু ‘একটা সাধারণ বিষয়’।
ভোপাল, ইন্দোর ও রাজকোটে এমএফ হুসেইনের বিরুদ্ধে দায়ের করা ফৌজদারি মামলা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেই আবেদনও খারিজ করে দেয় ভারতের শীর্ষ আদালত।
ওই সময় একইসাথে ভারতে বাড়তে থাকা ‘নতুন বিশুদ্ধতাবাদের’ সমালোচনা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট।
তার যে সমস্ত চিত্রশিল্পের বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানা’ এবং ‘জাতীয় অখণ্ডতাকে বিঘ্নিত করার’ অভিযোগ উঠেছিল সেই শিল্পকর্মের বিষয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য তলব করার আবেদনও জানানো হয়েছিল। সেই সময় নির্বাসনে ছিলেন হুসেইন।
সুপ্রিম কোর্টের তরফে শিল্পকর্মের বিষয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য তাকে ডেকে পাঠানোর সেই আবেদনও খারিজ করে দেয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের তরফে বলা হয়েছিল, ‘এই জাতীয় বহু বিষয়, আলোকচিত্র এবং প্রকাশনা রয়েছে। সেই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে মামলা করবেন কি? মন্দিরের কাঠামোতে থাকা শিল্পের বিষয়ে কী বলবেন?’
‘হুসেইনের কাজ শিল্প। যদি আপনি তা না দেখতে চান, তাহলে দেখবেন না। এই জাতীয় অনেক শিল্পের নিদর্শন তো মন্দিরের কাঠামোতে রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, অনেকের মতে ভারতে শৈল্পিক ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
গত অক্টোবরে শুল্ক বিভাগকে তিরস্কার করেছিল মুম্বাই হাইকোর্ট। বিখ্যাত শিল্পী এফএন সুজা এবং আকবর পদমসির শিল্পকর্মকে ‘অশ্লীল’ আখ্যা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করেছিল শুল্ক বিভাগ।
মামলা সম্পর্কিত নিদেশ দেয়ার সময় বম্বে হাইকোর্ট জানিয়েছিল, প্রতিটা নগ্ন শিল্পকলা বা যৌনতা সম্পর্কিত শিল্পই যে অশ্লীল, তা নয়।
একথা জানিয়ে শুল্ক বিভাগের বাজেয়াপ্ত করা সাতটা শিল্পকর্ম ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা