২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ মাঘ ১৪৩১, ২৩ রজব ১৪৪৬
`

ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নিয়ে ‘পানিযুদ্ধে’ জড়াচ্ছে চীন-ভারত!

ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নিয়ে ‘পানিযুদ্ধে’ জড়াচ্ছে চীন-ভারত! - ছবি : আল জাজিরা

ভারত সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এর বিরোধিতা করছে স্থানীয়রা। তারা বলছেন, এই বাঁধ নির্মাণ করা হলে ২০টি গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে। আরো দুই ডজন গ্রাম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সেজন্য কোনোভাবেই এই বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না।

কিন্তু ভারত সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এতে ১৩.২ বিলিয়ন বিনিয়োগের চিন্তা করছে তারা। এতে একটি জলাধার নির্মিত হবে, যাতে অন্তত নয় বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধরে রাখা যাবে। সেখান থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এই প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটিই হবে ভারতের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।

সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে এই প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখনো তার সম্ভাব্যতার উপর জরিপ চালাচ্ছেন। তবে স্থানীয়রা এই বাঁধ নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। ফলে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার বিক্ষোভ দমনের জন্য আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। তবে এখনো সেখানে কোনো সংঘর্ষ হয়নি।

বিক্ষোভকারীরা জোর দিয়ে বলছেন যে তারা কোথাও যাচ্ছেন না। তারা বলছেন, সরকার আমাদের বাড়ি-ঘর ও নদী-নালা দখল করে শিল্পাঞ্চল তৈরি করবে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। এটা আমাদের সম্পত্তি। আমরা তা ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।

সিয়াং আদিবাসী কৃষক ফোরাম (এসআইএফএফ) সম্প্রদায়ের সভাপতি জিজং বলেছেন, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, এই বাঁধ নির্মাণ হতে দেব না।

অবশ্য বিজেপি সরকার বলছে, ‘বিক্ষোভকারীরা ভুল বুঝছেন।’ অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু জোর দিয়ে বলেছেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য কেবল বাঁধ নির্মাণই নয়। বরং এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো সিয়াং নদীকে বাঁচানো।

একটি ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র
সিয়াং আদিবাসী কৃষক ফোরাম যে বাঁধ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে, এর সাথে রয়েছে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের বিশেষ স্বার্থ। এখানে চীন ও ভারত পানি ও নিরাপত্তার জন্য একটি ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ নিয়ে তাদের মাঝে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্ত সংঘর্ষও হচ্ছে।

তিব্বতের কৈলাস পর্বত থেকে সিয়াং নদীর উৎপত্তি হয়েছে। কৈলাসে নদীটি ইয়ারলুং জাংবো নামে পরিচিত। এরপর এটি আরেকটু প্রশস্ত হয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রদেশ করে। ভারতের বেশিরভাগ এলাকায় এটি ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। পরে সেটি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলিত হয়।

গত মাসে চীন ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশের মুখে তিব্বতের মেদোগ কাউন্টিতে ইয়ারলুং জাংবোর উপর তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দেয়।

২০২০ সালে চীন প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এর পরপরই নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা ‘চীনা বাঁধ প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব প্রশমিত করার জন্য’ একটি পাল্টা বাঁধ নির্মাণের বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা শুরু করে। ভারতীয় কর্মকর্তারা ভাবছেন, সিয়াং বাঁধের বিশাল জলাধার আসন্ন মেদোগ বাঁধের মাধ্যমে নদীর প্রবাহে যে ব্যাঘাত ঘটবে, তা পূরণ করবে। একইসাথে তা আকস্মিক বন্যা বা জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখবে।

কিন্তু হিমালয় অঞ্চলে বিশাল এই দু’টি বাঁধ স্থানীয় লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলবে। কারণ, এই স্থানটি খুবই স্পর্শকাতর; ঘন ঘন বন্যা ও ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ফলে বিশেষজ্ঞ ও জলবায়ু কর্মীরা এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তারা বলেছেন, হিমালয়ের জলসম্পদ নিয়ে ভারত ও চীনের বিপজ্জনক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোকে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

‘প্রধান বিপর্যয়’
ইয়ারলুং জাংবো নদীর উপর মেদোগ কাউন্টিতে নির্মিত নতুন মেগা-বাঁধটি মধ্য চীনের থ্রি জর্জেস বাঁধকেও ছোট করে তুলবে। এটিই হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলবাঁধ। বেইজিং বলেছে, ২০৬০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমন লক্ষ্য পূরণে এই প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ হবে। চীনা সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, বাঁধটির জন্য ১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। চীনের পক্ষ থেকে কতজন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে সে সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

নামচা বারওয়া পর্বতের কাছে গ্রেট বেন্ডে এই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এক ধরণের প্রকৌশলগত বিস্ময় তৈরি হবে। যেহেতু এই জল বিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম গিরিখাতগুলোর মধ্যে একটিতে পড়ে -যার গভীরতা ৫,০০০ মিটার (১৬,৪০০ ফুট) ছাড়িয়ে যায়- এটি বার্ষিক প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।

নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) চীনা গবেষণার অধ্যাপক বিআর দীপক বলেন, ইয়ারলুং জাংবো এবং এর উপনদীগুলোতে চীন যেসব বাঁধ তৈরি করেছে, তার মধ্যে এই বিশাল নতুন প্রকল্পটি সর্বশেষ। এই বাঁধগুলোকে ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষ বাধার প্রধান অনুঘটক হিসেবে চিহ্নিত করা উচিৎ।

তিনি আরো বলেন, ‘ট্রান্স-ওয়াটার নদীগুলো থেকে কোনো কোনো বড় ধরনের সঙ্ঘাতের উৎপত্তি হয়েছে। সিন্ধু নদীর উপনদীগুলোর পানি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের একটি প্রধান কারণ। এদিকে, ইথিওপিয়া ও মিসর নীল নদের উপর ইথিওপিয়া যে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে, তা নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সিয়াং নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারতের প্রতিক্রিয়া আগুনে ঘি ঢালার মতো ভূমিকা রাখবে।

এই গবেষক বলেন, যতদিন চীন এই নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ অব্যাহত রাখবে, ততদিন পর্যন্ত ভয় ও উদ্বেগ অব্যাহত থাকবে এবং নিম্ন তীরবর্তী দেশগুলো এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লোই ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে যুক্তি দেয়া হয়েছিল যে তিব্বত মালভূমি থেকে উৎপন্ন নদীগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ মূলত চীনকে ভারতের অর্থনীতির উপর দমন করে।

‘চোকহোল্ড’
ইতিহাসজুড়ে ইয়ারলুং জাংবো নদী প্রায়ই চীনে ‘নদীর অচলাবস্থা’ নামে পরিচিত ছিল। পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত অন্যান্য প্রধান চীনা নদীর বিপরীতে এটি গ্রেট বেন্ডে তীব্রভাবে দক্ষিণে বাঁক নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।

ভারতের সীমান্তের পাশে বাঁধের জন্য বেইজিংয়ের এই কৌশলগত স্থানটি বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লিতে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা গবেষণার সহকারী অধ্যাপক সহেলি চট্টরাজ বলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে চীন ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কৌশলগত কারণ হিসেবে বাঁধটি ব্যবহার করার কার্ড পাবে।’

তার এই বক্তব্যের সঙ্গে দীপকও একমত। তিনিও মনে করেন যে বাঁধের বিশাল জলাধারের কারণে বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো নিম্ন নদীতীরবর্তী অঞ্চল সবসময় ভয় পাবে যে চীন জলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে; বিশেষ করে শত্রুতার ক্ষেত্রে।

তিনি আরো বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, জলাধারটির ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। এটি ভূখণ্ডের ভঙ্গুরতার উদ্বেগকেও বাড়িয়ে তোলে। সেজন্য এই নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণ বিভিন্ন বিপদে পরিপূর্ণ। বিংশ শতাব্দীতে প্রায় ১৫ শতাংশ বড় ভূমিকম্প- রিখটার স্কেলে ৮.০ এর বেশি মাত্রার- হিমালয়ে আঘাত হানে। তিব্বতে আঘাত হানা বড় ভূমিকম্পের এই ধরণটি অব্যাহত রয়েছে। ৭ জানুয়ারি ৭.১ স্কেলের ভূমিকম্পে কমপক্ষে ১২৬ জন নিহত হয়।

ভূমিকম্পের পর চীনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরীক্ষা করা এই অঞ্চলের ১৪টি জলবাঁধের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটিতে ক্ষতির অশুভ লক্ষণ দেখা গেছে। একটির দেয়াল হেলে পড়েছিল, অন্য কয়েকটিতে ফাটল দেখা গিয়েছিল। তিনটি বাঁধ খালি করা হয়েছিল এবং বেশ কয়েকটি গ্রাম খালি করা হয়েছিল।

এদিকে, ভারত সরকার অরুণাচল প্রদেশে বাঁধ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের বলেছে, চীন যেন তাদের জমি প্লাবিত করতে না পারে, ওই ঝুঁকি কমাতে একটি পাল্টা বাঁধ তৈরি করা প্রয়োজন। তারা ‘পানি বোমা’ এবং ‘পানি যুদ্ধ’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করে তার সতর্কতাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

সহকারী অধ্যাপক চাটজা উল্লেখ করেছেন, ভারত বা চীন কেউই জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক জলধারা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী নয়, যা ব্রহ্মপুত্রের মতো ভাগ করা স্বাদুপানির সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে।

২০০২ সাল থেকে ভারত ও চীন বন্যার সময় ব্রহ্মপুত্র নদের জলবিদ্যুৎসংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগির জন্য একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। কিন্তু ২০১৭ সালে ভুটানের সাথে তাদের সীমান্তের কাছে ডোকলামে সামরিক সংঘর্ষের পর ভারত বলেছে যে বেইজিং সাময়িকভাবে জলবিদ্যুৎসংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করে দিয়েছে। ওই বসন্তে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যে বন্যার এক ঢেউ আঘাত হানে। যার ফলে ৭০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং চার লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

দীপক বলেন, ‘এটি একটি সমস্যাকর পরিস্থিতি। যখন সম্পর্কের অবনতি হয় বা ২০১৭ সালের মতো সঙ্ঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন চীন তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করে দেয়।’

প্রতিবেশীদের মধ্যে তিক্ততা
মেদোগ কাউন্টি বাঁধটি চীনের ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) অংশ ছিল এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এর পরিকল্পনা চলছে। তবে ২৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ঘোষণা করা হয়। এর ফলে ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, নয়াদিল্লি ‘নদীর পানির উপর ব্যবহারকারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তাদের ভূখণ্ডে নদীতে মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে চীনা পক্ষের কাছে ভারতের উদ্বেগ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে।’

তিনি আরো বলেন, নয়াদিল্লি বেইজিংকে ‘ব্রহ্মপুত্রের ভাটির রাজ্যগুলোর স্বার্থ যেন উজানের অঞ্চলে কার্যকলাপের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করারও’ আহ্বান জানিয়েছে। তিনি যোগ করেন যে ভারত ‘নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখবে।’

দু’দিন পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্পটি ‘নিম্ন নদী অঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না’ এবং বেইজিং ‘বিদ্যমান চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে (নিম্ন নদী তীরবর্তী) দেশগুলির সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবে এবং দুর্যোগ প্রতিরোধে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে’।

তিনি আবারো পরিষ্কার শক্তি এবং অন্যান্য জলবিদ্যুৎ বিপর্যয়ের দিকে চীনের মূল ভূমিকায় মেদোগ কাউন্টি বাঁধের ভূমিকার উপর জোর দেন। তবুও ভারত ও চীনের মধ্যে আস্থার অভাব রয়েছে।

২০২০ সালের অক্টোবরে বিতর্কিত সীমান্তে মারাত্মক সামরিক সঙ্ঘর্ষ হয়। এতে লাদাখে প্রায় পাঁচ বছরের উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল।

কিন্তু ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে চুক্তিটিকে তিক্ত সম্পর্কের বরফ ভাঙার জন্য ভুল করা উচিত নয়। ‘জল নিয়ে এই সর্বশেষ সঙ্ঘর্ষের ঘটনাসহ ভারত ও চীনের মধ্যে অনেকগুলো বিভেদ ও উত্তেজনা রয়েছে, যা আমরা সম্পর্কের শক্তি দেখতে পাব বলে আশা করি।’

কুগেলম্যান উল্লেখ করেছেন যে ‘ভারত ও চীন উভয়ই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব বহন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পানির ঘাটতি। এতে সামনের সময়গুলো তাদের পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হবে।’ তিনি আরো বলেন, ভারত যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হওয়ার আশা করছে, তা চীনে বোতলজাত অবস্থায় দেখতে পারছে না।’

‘বাংলাদেশ সবচেয়ে প্রতিকূল প্রভাবের মুখোমুখি হবে’
কিন্তু ভারত ও চীন যখন টানাপোড়েনে লিপ্ত হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ অনুভব করতে পারে।

জল সম্পদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এমন একটি নাগরিক সমাজ সংস্থা রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, যদিও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার (২২৪,০০০ বর্গমাইল) এলাকার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশে পড়ে, নদীব্যবস্থা বার্ষিক দেশের ৬৫ শতাংশেরও বেশি পানি সরবরাহ করে। এই কারণেই এটিকে ‘বাংলাদেশের জীবনরেখা’ হিসেবে দেখা হয়।

তিনি আরো বলেন, ‘চীন ও ভারতের মধ্যে ‘বাঁধের বিনিময়ে বাঁধ’ প্রতিযোগিতা আমাদের উপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

এই আশঙ্কা ঢাকা-ভিত্তিক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা খান এক দশক ধরে বোধ করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। কোনো সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন বা ব্যবহৃত প্রযুক্তির বিবরণ নেই।’ তিনি কিছুটা ক্ষেদ মিশিয়ে বলেন, আমাদের তথ্য ভাগাভাগি করে নেয়া এবং বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাই, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন এবং তারপর সামাজিক ও দুর্যোগ প্রভাব মূল্যায়ন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের কাছে কিছুই নেই।’

ব্রহ্মপুত্র বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের আগে বাংলাদেশে বিশ্বের বৃহত্তম পলি ব-দ্বীপগুলোর মধ্যে একটি গঠন করে। এর তীরে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষকে সরাসরি সহায়তা করে। খান বলেন, যদি পলি প্রবাহে কোনো ভারসাম্যহীনতা থাকে, তবে এটি নদীর তীরে ভাঙন বাড়িয়ে দেবে এবং সম্ভাব্য ভূমি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা অদৃশ্য হয়ে যাবে।’

খান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ভারতের বাঁধ বাংলাদেশের অববাহিকার অংশের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকারক হতে পারে। আপনি অন্য একটি বাঁধ দিয়ে বাঁধের মোকাবিলা করতে পারবেন না। কারণ, এটি ভাটিতে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর বিশাল এবং মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।’

বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান নীতির বিষয়ে রোকন বলেন, ‘আমাদের চীনা বা ভারতীয় বাঁধ সম্পর্কে ‘অপেক্ষা করুন এবং দেখুন’ মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ব্রহ্মপুত্র নদের বিষয়ে আলোচনা কেবল বাংলাদেশ ও ভারত, অথবা ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হওয়া উচিত নয়; এটি অববাহিকাজুড়ে আলোচনা হওয়া উচিত।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকা থেকে নয়াদিল্লি সমর্থিত ছিল বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারত থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। এর অর্থ হলো ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য মোকাবেলায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর কোনো যৌথ প্রচেষ্টা বা ঐক্যবদ্ধ প্রতিহত নেই।

খান যেখানে এই পানি সঙ্কটকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য ‘একটি সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন, সেখানে উইলসন সেন্টারের কুগেলম্যান আশাবাদী নন। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যে চীন বহিরাগত কোনো দেশের চাপকে গ্রাহ্য করে না। তা সে এক, দুই, এমনকি ১০টি দেশেরই হোক না কেন। চীনের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার অবস্থানে থাকলেও বেইজিংয়ের পদক্ষেপকে ঠেকানোর জন্য এটি যথেষ্ট হবে না।’

এদিকে, এই জল-সঙ্কটের সম্মুখভাগে থাকা সম্প্রদায়গুলো যে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে তা কেবল বাড়তেই থাকবে। বিশেষজ্ঞরা এমনই বলছেন। কুগেলম্যান বলেন, এই জল-সঙ্কটের তাৎপর্য এবং গুরুত্বের উপর যথেষ্ট জোর দেয়া সম্ভব নয়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই উত্তেজনাগুলোকে আরো বিপজ্জনক এবং আসন্ন দশকে সম্ভাব্য অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

সিয়াং নদীর কাছে পারং গ্রামে ফিরে জিজং বলেন, তার বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই। “আমরা এই বাঁধগুলোর প্রভাব সম্পর্কে আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে সচেতন করে তুলছি।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি পরবর্তী প্রজন্ম সম্পর্কে জানি না। তবে আমি যদি ৯০ বছর বয়সীও হই এবং হাঁটতেও না পারি, তবুও আমি প্রতিরোধ চালিয়ে যাব।’

আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আবু সাঈদ 


আরো সংবাদ



premium cement
মিয়ানমারে ২ জান্তা সৈন্যকে কেন হত্যা করেছে জানাল এএ সৌদি কোম্পানি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনায় আগ্রহী বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ ও বৈশ্বিক সরবরাহ কাঠামোয় যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি রাঙ্গামাটিতে জামায়াতের কর্মী ও সহযোগী সদস্য সম্মেলন পাকুন্দিয়ায় কৃষক হত্যার মূল আসামি গ্রেফতার ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত পলাতক আসাদুজ্জামান খানের সাক্ষাৎকার মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ’ যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন করার আহবান ট্রাম্পের, অন্যথায় শুল্ক আরোপের হুমকি সিলেট সীমান্তে এবার ৫ কোটি টাকার চোরাই পণ্য জব্দ বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় ভারত : জয়সওয়াল বিএনপির কথার টোন আওয়ামী লীগের সাথে মিলে যাচ্ছে : নাহিদ ইসলাম খুবি ছাত্রকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা

সকল