ভারতে সবচেয়ে বেশি সাইবার প্রতারণা হোয়াটসঅ্যাপে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৪৪
মানুষকে ঠকানোর অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যম। ভারতে হোয়াটসঅ্যাপে সবচেয়ে বেশি সাইবার প্রতারণা হয়।
টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি ও সস্তায় ডেটা ব্যবহারের দৌলতে ভারতে বিপুল জনপ্রিয় হয়েছে সামাজিক মাধ্যম। এর মধ্যে সবার আগে রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ। ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়ছে টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রামেরও। এর সুযোগে বাড়ছে প্রতারণাও।
কেন্দ্রের রিপোর্ট
মোবাইলকে ব্যবহার করে অনলাইনে প্রতারণা এখন নিত্যনৈমিত্তিক অভিযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত প্রবীণ মানুষদের টার্গেট করছে প্রতারকরা। তবে কমবয়সীরাও এর থাবা থেকে বাঁচছে না। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২৩-২৪ সালে বারতে সাইবার অপরাধ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখান থেকেই উঠে আসছে সাইবার অপরাধের নানান ফন্দিফিকির ও ভারতে কিভাবে তারা কাজ করে সেই ছবি।
ভারতে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় ৬০ কোটি। বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় এই সংখ্যা বেশি। এর ফলে প্রতারকদের হাতে চলে এসেছে এই বিপুল আকারের অনলাইন প্লাটফর্ম।
কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব অনুযায়ী, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের প্রথম তিন মাসে ৮৬ হাজারের বেশি প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ৪৪ হাজার অভিযোগ ছিল হোয়াটসঅ্যাপ সংক্রান্ত। এক্ষেত্রে টেলিগ্রাম ও ইনস্টাগ্রাম ছিল দুই ও তিন নম্বর স্থানে।
গত বছরের হিসেব অনুযায়ী, ভারতে টেলিগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে নয় কোটি। এই সংখ্যা রোজই বাড়ছে। একই সময়ে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করেন প্রায় চার কোটি মানুষ। হিসেব অনুযায়ী, টেলিগ্রামে প্রতারণার সংখ্যা ছিল প্রায় ২৩ হাজারের কাছাকাছি। এই সংখ্যা ইনস্টাগ্রামের ক্ষেত্রে প্রায় ২০ হাজার। ২০২৪ সালের গোড়ায় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ১২৫ কোটি টাকার প্রতারণা করা হয়েছে। যদিও বেসরকারি হিসাব এর থেকে অনেক বেশি।
কিভাবে প্রতারণা
এই পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, প্রতারকদের বেশি পছন্দের হোয়াটসঅ্যাপ। এর ব্যবহারকারী সংখ্যা বেশি। এই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা সহজ হওয়ায় খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর সাহায্যে নানা ভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছে প্রতারকরা। এর অন্যতম ডিজিটাল অ্যারেস্ট। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও জনতাকে সতর্ক করেছিলেন।
কখনো বিপুল টাকার মুনাফা টোপ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। কখনো বিভিন্ন সংস্থার নাম করে লোভনীয় উপহারের বিনিময়ে টাকা হাতাচ্ছে প্রতারকরা। কখনো আবার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঠকাচ্ছে অনলাইন প্রতারকেরা।
সমাজ মাধ্যমে এই ধরনের জালিয়াতির পোশাকি নাম দেয়া হয়েছে পিগ বুচারিং স্ক্যাম। সাধারণভাবে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে লিংক পাঠানো হয়। সেই লিংকে ক্লিক করলে কী সুবিধা মিলবে, তার বর্ণনা আগেই দেয়া হয়। প্রথমে গ্রাহককে হাত করার জন্য টাকা ফেরত দেয়া হয়। তারপর অনেক বেশি টাকা হাতিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। কোনোভাবেই তাদের নাগাল পান না প্রতারিত ব্যক্তি।
ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি বিভিন্ন সফটওয়্যার-এর মাধ্যমে তৈরি করে আপলোড করে দেয়ার ভয় দেখায় অনলাইন দুর্বৃত্তরা। সম্মান ও মর্যাদাহানির ভয়ে কার্যত প্রতারকদের হাতে পণবন্দী হয়ে পড়েন অনেকে। তাদের কাছ থেকে দফায় দফায় বিপুল টাকা আদায় করে প্রতারকেরা।
লিংক থেকে সাবধান
প্রতারকরা অতীতে মূলত শর্ট মেসেজিং সার্ভিস বা এস এম এস ব্যবহার করে প্রতারণার লিংক পাঠাত। এখন কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে তাদের কাছে। তারা লিংক পাঠাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামের মতো অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার আগে কেউ বুঝতে পারছেন না, এর পেছনে প্রতারকদের হাত থাকতে পারে।
অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোনো সীমান্ত না থাকায় বিদেশ থেকে প্রচারকরা ভারতীয়দের মধ্যে জাল বিছিয়ে দিচ্ছে অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে। সেগুলোকে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া নিয়মিত চালায় কেন্দ্র। অনেক অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে ১৭ হাজার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে। তারপর নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা।
উন্নত প্রযুক্তি ও জনগণের অসতর্কতা এদের অস্ত্র। সাইবার বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম নিজেদের কন্টেন্ট খতিয়ে দেখে, গোলমাল হলে ডিলিট করে। কিন্তু অভিযোগ এলে পদক্ষেপ করার দায় চ্যাটিং অ্যাপের নেই। জলিয়াতদের প্রযুক্তি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন, এটা সকলেরই উদ্বেগের কারণ।’
বাঁচবার উপায় কী?
নারী ও প্রবীণরা মূলত প্রতারকদের নিশানায় ছিলেন। এখন জাল আরো ছড়িয়েছে। সব ধরনের মানুষকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে তারা।
গড়িয়ার স্কুলশিক্ষক তারক কবিরাজ বলেন, ‘আমি শেয়ারে লগ্নি করি না। হঠাৎ এক দিন ফোন আসে। ব্রোকার পরিচয় দেয়। একটা লিংক পাঠিয়ে গ্রুপ জয়েন করতে বলে। অথচ আমি এ ধরনের লগ্নি করি না।’
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্যের একই অভিজ্ঞতা। বলেন, ‘আমাকে ফোন করে বলে, আপনি ক্রেডিট কার্ডের টাকা খরচ করে ফেলেছেন। এখনই টাকা না মেটালে জরিমানা হবে। অথচ আমার ক্রেডিট কার্ড নেই।’
কিভাবে এই পরিস্থিতি এড়ানো যেতে পারে, তার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাইবার বিশেষজ্ঞ রাজর্ষি রায়চৌধুরীর পরামর্শ, ‘চ্যাটিং যারা করছেন, তাদের সচেতন হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, মোবাইল ফোন যেন কোনোভাবে হ্যাকারদের কব্জায় না চলে আসে।’
রাজর্ষির বক্তব্য, ‘সবার আগে হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য চ্যাটিং অ্যাপে অটো ডাউনলোড অপশন বন্ধ করতে হবে। ডাউনলোড ফ্রম আননোন নম্বরকেও নিষ্ক্রিয় করতে হবে। অপরিচিত ব্যক্তির পাঠানো কোনো লিংকে ক্লিক করা যাবে না।’
সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘আমাদের এখানে অধিকাংশ মানুষই হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। এর ব্যবহার এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেছে যে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রতারকরাও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতারিত হওয়ার দুটি কারণ আছে। ভয় এবং লোভ। ডিজিটাল অ্যারেস্টের ভয় দেখিয়ে এবং বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে মূলত প্রতারণা করা হয়। যারা চটজলদি লাভ করতে চান তারা ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন। যারা মনে করছেন আমরা কিছু একটা অপরাধ করেছি, তারা ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। তারাও প্রতারিত হচ্ছেন। যারা একদমই প্রযুক্তি জানেন না, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষরা, তারাও প্রতারিত হচ্ছেন। এমনকি যারা প্রযুক্তি সম্পর্কে জানেন তারাও এর থেকে বাদ যাচ্ছেন না। প্রতারকরা এত সুন্দর কথা বলে বা এত সুন্দর স্ক্রিপ্ট আছে এদের কাছে যেকনো মানুষই প্রতারিত হতে পারেন।’
পিগ বুচারিং স্ক্যাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রতারকরা প্রথমে বন্ধুত্ব করে, তারপর ইনভেস্টমেন্ট এর কথা বলে। এমন দারুণ দারুণ গল্প বলে যেগুলো সবই মিথ্যে কিন্তু তাতে মানুষ আকর্ষিত হয়। প্রথমে অল্প পরিমাণ টাকা নিয়ে সেটাকে দ্বিগুণ করে ফেরত দেয়। খুবই বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে বড় পরিমাণ টাকা এরা নিয়ে নেয়। তখন এই টাকাটা ফেরত দেয় না। এগুলো কৃপটোকারেন্সিতে হয়। টেলিগ্রাম চ্যানেলে কোনো ইনভেস্টার থাকে না। এরা টেলিগ্রাম দিয়ে এই জালিয়াতি করে থাকে।’
সন্দীপের সতর্কবাণী, ‘অজানা অচেনা লোকের সাথে বন্ধুত্ব করার দরকার নেই ডিজিটাল দুনিয়ায়। আধার কার্ড বা এই জাতীয় গোপন তথ্য চাইলে কখনোই তা দেয়া উচিত নয়। কোনো সফটওয়্যার আপলোড করার আগে দু-তিনবার ভাবতে হবে। সস্তায় ইনভেস্টমেন্ট করার অনেক লোভনীয় অফার আসতে পারে, সেগুলোতে গুরুত্ব দেবেন না। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোনো ইনভেস্টমেন্ট করার দরকার নেই।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা