২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভারতে জামা মসজিদ ঘিরে সংঘর্ষের দু’দিন পরে যে চিত্র দেখা গেছে

ভারতে জামা মসজিদ ঘিরে সংঘর্ষের দু’দিন পরে যে চিত্র দেখা গেছে - সংগৃহীত

ভারতের উত্তরপ্রদেশের সম্ভল শহরে শাহি জামা মসজিদের বাইরে পুলিশের বিপুল সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এখনো সেখানে যত্রতত্র ইট-পাথর পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পুড়ে যাওয়া গাড়িগুলো সরানো হলেও, ছাইয়ের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল রোববার। আদালতের নির্দেশে ওইদিন সকালে জামা মসজিদে জরিপ চলাকালীন উত্তেজিত জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ওই ঘটনায় কমপক্ষে চারজনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ২০ জনেরও বেশি পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন।

পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, সহিংসতার ঘটনায় যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের নাম বিলাল, নাঈম, কাইফ এবং আয়ান।

নিহতদের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে তাদের।

তবে মোরাদাবাদ রেঞ্জের ডিআইজি মুনিরাজ জি দাবি করেছেন, পুলিশ গুলি চালায়নি।

বিবিসি সংবাদদাতা সুমেধা পালের সাথে কথোপকথনের সময় সম্ভলের এমপি জিয়া উর রহমান বার্ক পুরো ঘটনার জন্য পুলিশ প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন।

এদিকে, নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে পুলিশের অনেক সদস্যকে সম্ভলে নেয়া হয়েছে। সেখানকার রাস্তাঘাট জনশূন্য। পুলিশ ছাড়া মাত্র হাতে গোনা কয়েকজনকে যাওয়া আসা করতে দেখা যায়।

স্থানীয় প্রশাসন সম্ভলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্ভলে বহিরাগত, সমাজকর্মী এবং রাজনীতিবিদদের প্রবেশের বিষয়ে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলও।

পুলিশের অবশ্য দাবি, সম্ভলের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি রয়েছে।

মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
মোরাদাবাদ রেঞ্জের ডিআইজি মুনিরাজ জি সোমবার সকালে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।’

এই সহিংসতার ঘটনায় এখনো পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিআইজি। বিবিসির সাথে কথোপকথনের সময় মুনিরাজ জিও দাবি করেন, পুলিশ গুলি চালায়নি।

রোববারের ঘটনার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে সম্ভল পুলিশ এখন পর্যন্ত এমপি জিয়াউর রহমান বার্ক-সহ দু’হাজার ৭০০ জনেরও বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। রোববার সন্ধ্যার মধ্যেই ২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এমপি বার্ক জানান, রোববার যখন দ্বিতীয়বার জরিপ চলছিল, তখন তিনি বেঙ্গালুরুতে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর একটা মিটিংয়ে ছিলেন।

তার কথায়, ‘প্রথমবার জরিপের সময় আমি যখন সেখানে ছিলাম, তখন এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে আমার অনুপস্থিতিতে, এই সহিংসতার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।’

তার দাবির স্বপক্ষে তিনি বিমানের টিকিট দেখিয়েছেন।

অন্যদিকে, সম্ভলের পুলিশ সুপার কৃষ্ণ কুমার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ড্রোন ফুটেজ এবং ঘটনার ভিডিওর ভিত্তিতে ওইদিনের ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হবে। সহিংসতায় লিপ্ত প্রত্যেককে গ্রেফতারও করা হবে।

নিহতদের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য
এরই মধ্যে নিহত ব্যক্তিদের দাফন করা হয়েছে। সম্ভলেরই একটা মহল্লা তাবেলা কোটের একটা দোকানের শাটার পেরিয়ে চলে আসা বুলেটের চিহ্ন দেখে সহিংসতার চিত্র পরিষ্কার বোঝা যায়।

রোববারের সহিংসতায় একই এলাকার বাসিন্দা নঈম গাজী (৩৪) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

নাঈমের মা বাড়ির বাইরে এক যুবককে আঁকড়ে ধরে বারবার কাঁদছিলেন, ‘আমার সিংহের মতো ছেলেকে জামা মসজিদের কাছে ঘিরে ফেলে হত্যা করা হয়েছে।’

সংবাদদাতা যখন তাদের সাথে দেখা করেন তখন নাঈমের লাশ ময়নাতদন্তের ঘরে ছিল। তার মা ইদ্রো গাজী বলেন, ‘বাড়িতে আমার ছেলেই একমাত্র উপার্জন করত। এখন কিভাবে চারজন শিশুকে খাওয়াব। আমি বিধবা, একা আমার সন্তানদের বড় করেছি। আমার বার্ধক্যের অবলম্বনকে হারিয়েছি। আমার ছেলে একটি মিষ্টির দোকান চালাত, সে তার মোটরসাইকেলে তেলের কৌটো কিনতে গিয়েছিল। সকাল ১১টায় আমরা ফোন পাই যে তাকে গুলি করা হয়েছে। আমি শুধু আমার সন্তানের লাশ পেতে চাই।’

নাঈমের চার সন্তান। তার স্ত্রী একেবারেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। তিনি শুধু বলছেন, ‘যা ঘটছে তা ন্যায়বিচার নয়। মুসলমানদের একতরফাভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। এটা নিপীড়ন।’

পুত্রবধূকে সান্ত্বনা দিতে দিতে ইদ্রো বলেন, ‘আমরা মামলা করব না, ধৈর্য ধরব, ঘরে বসে থাকব। পুলিশ আর সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস আমাদের নেই।’

‘আমার ছেলের বুকে গুলি লেগেছে’
এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে বাগিচা সরায়তরিন মহল্লার একটা মসজিদের বাইরে মানুষের ভিড়। কিন্তু যারা জড়ো হয়েছেন তাদের সকলেই চুপচাপ ছিলেন। এখানে মসজিদের সিঁড়িতে মাথা নিচু করে বসে আছে নাফিস। তার বছর বাইশের ছেলে বিলালও সহিংসতায় নিহত হয়েছে।

ছেলের নাম নিতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ছেলে বিলাল কাপড়ের কাজ করতেন।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমার ছেলের বুকে গুলি করেছে। আমার ছেলে নিরীহ ছিল। কাপড় কিনতে দোকানে গিয়েছিল। আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য পুলিশই দায়ী।

এর জন্য প্রকৃতপক্ষে কে দায়ী, তা জিজ্ঞাসা করলে, বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তিনি বলেন, ‘কাকেই বা আমরা দোষ দেবো। সবাই দেখতে পাবে কে দায়ী। আমাদের কেউ নেই, আমাদের আছেন শুধু আল্লাহ। আমার জোয়ান ছেলে ছিল, ওর বিয়ে দিতে হতো। সেও চলে গেল। আমি ঠেলাগাড়ি টেনে ওকে বড় করেছিলাম। পুলিশের বুলেট তাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।’

সহিংসতার ঘটনায় মুহম্মদ কাইফ (১৭) নামে এক কিশোরও নিহত হয়েছেন। তুর্তিপুরা এলাকার বাসিন্দা কাইফের বাড়িতে শোকের ছায়া রয়েছে। নারীদের চিৎকারের শব্দ সে বাড়ির নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দেয়।

কাইফের বাবা তাদের বোঝাচ্ছেন, ‘আমার ছেলে চলে গিয়েছে। এখন আর সে ফিরে আসবে না। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। তাকে শান্তিতে দাফন করতে হবে।’

সংবাদদাতারা যখন কাইফের বাড়িতে পৌঁছায়, তখনও তার লাশ ময়নাতদন্তের ঘরে ছিল। কাইফের মা আনিসা অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ফেরি করত। বিসাতখানা (প্রসাধনী সামগ্রী) বিক্রি করত। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা জানতাম না যে সে মারা গেছে। আমরা সারাদিন তাকে খুঁজছিলাম।’

আনিসার অভিযোগ, বিকেলে পুলিশ এসে ঘরের দরজা ভেঙে তার বড় ছেলেকে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে যায়।

কাইফের মামা মুহম্মদ ওয়াসিম বলেন, ‘আমার এক ভাগ্নেকে পুলিশ গুলি করেছে আর অন্যজনকে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। আমাদের একমাত্র দোষ আমরা মুসলমান, আমাদের মানুষ হিসেবেও গণ্য করা হয় না।’

কার বুলেটে মৃত্যু?
পুলিশের গুলিতেই বাড়ির ছেলের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে নিহতদের পরিবার। অন্যদিকে পুলিশের দাবি, উত্তেজিত জনতার দিক থেকে গুলি চালানো হয়। রোববারের ঘটনায় চারজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে পুলিশ। কোনো পরিস্থিতিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে তা তদন্তের পর পরিষ্কার হবে।

সম্ভলের হায়াতনগর এলাকার পাঠান এলাকার এক কবরস্থানে দাফন করা হয় বছর চল্লিশের রোমান খানকে। কবরের কাছে কাঁদতে থাকা তার মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করেন সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা।

সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় রোববার মোরাদাবাদের কমিশনার এ কে সিং সম্ভলে নিহতদের মধ্যে রোমান খানের নাম উল্লেখ করেছিলেন।

তার জানাজায় আসা লোকজন চাপা স্বরে আলোচনা করছিলেন, ‘পুলিশের গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে।’

কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে রাজি ছিল না রোমান খানের পরিবার। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লাশ দাফন করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক আত্মীয় বলেন, ‘পরিবার চায়নি ময়নাতদন্ত হোক, কেউ মামলা করুক। আমরা সবাই ধৈর্য ধরছি। ওর লাশ নিঃশব্দে দাফন করেছি।’

দাফনের সময় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের আশঙ্কা ছিল, ক্যামেরায় ধরা পড়লে পুলিশ তদন্তের নাম করে তাদের আটক করতে পারে।

স্থানীয় কংগ্রেস নেতা তৌকির আহমেদ বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এমন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে যে তারা বলতে রাজি নন যে কিভাবে তার পরিবারের সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।’
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement