২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

৯ বছর ধরে নকল আদালত যেভাবে চালাচ্ছিলেন ভুয়া বিচারক

মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান নামে ওই ব্যক্তি নিজেকে সালিশী আদালতের জজ হিসেবে দাবি করেন - ছবি : বিবিসি

ভারতের গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরের একটা ব্যস্ত এলাকায় তৈরি শপিং সেন্টারে সকাল থেকেই বহু মানুষ সরু সিঁড়িতে বসে রয়েছেন। অপেক্ষা করছেন কখন তাদের পালা আসবে।

কিছুক্ষণ পরে আদালতের ক্লার্কের পোশাকধারী এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে চিৎকার করলে অপেক্ষারত মানুষেরা তাদের আইনজীবীদের নিয়ে ছুটে যান। বিচারকের চেয়ারে বসা ব্যক্তি দুই পক্ষের যুক্তি-তর্ক শোনেন এবং রায় ঘোষণা করেন।

প্রথম নজরে, এই দৃশ্য দেখে মনে হবে যে আদালতের স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে। কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।

সন্ধ্যায় আদালতের কাজ শেষ হলে বিচারক ক্লায়েন্ট বা মক্কেলদের সাথে কথা বলতে শুরু করেন এবং তাদের পক্ষে রায় দেয়ার জন্য টাকাও দাবি করেন। এরপর যদি হিসাব মতো সব মিলে যায় আর চুক্তি পাকা হয়, তাহলে রায় সেই মক্কেলের পক্ষে দেয়া হয়।

ঘটনাটা গান্ধীনগরের। সেখানে বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজেকে বিচারক বলে দাবি জানানো এক ব্যক্তি ভুয়া আদালত পরিচালনা করছিলেন। চলচ্চিত্রের গল্পকে হার মানিয়ে দিতে পারে এই বাস্তব ঘটনা, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ সেই ভুয়া সালিশি আদালতের বিচারক এখন পুলিশের হেফাজতে।

মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান নামে ওই ব্যক্তিকে সম্প্রতি আদালতে পেশ করে পুলিশ। সেখানেও তিনি নিজেকে সালিশী আদালতের জজ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়, বিচারকের কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাকে মারধর করেছে এবং বাধ্য করেছে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ স্বীকার করতে।

এরপর, তার ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

আদালত কী বলেছে?
সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেফতারকৃত মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে ভুয়া আদালত গঠন এবং জালিয়াতি করে রায় দেয়ার অভিযোগে অবিলম্বে প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেন সিটি সিভিল কোর্টের বিচারক জয়েশ এল চৌতিয়া। আদালত তাকে ১০ দিনের জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত কয়েক মাসে গুজরাটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত এক ভুয়া উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে কর্মরত এক ভুয়া অফিসার, ভুয়া সরকারি অফিস, নকল টোল বুথ এবং নকল পুলিশ অফিসার ধরা পড়েছে।

এবার প্রকাশ্যে এসেছে এই ভুয়া বিচারকের এক নকল সালিশ আদালত পরিচালনার ঘটনা, যা সকলকে হতভম্ভ করেছে।

কিভাবে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করছিলেন নিজেকে সালিশী জজ বলে দাবি জানানো এই ব্যক্তি এবং কী করে তিনি এত বছর এই নকল আদালত চালিয়ে এসেছেন, সে বিষয়ে জানতে এই মামলার সাথে যুক্ত আইনজীবী ও এক পুলিশকর্তার সাথে কথা বলেছে বিবিসি গুজরাটি।

এক বছরে ৫০০ রায়
মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান গত নয় বছর ধরে এই কাজ করে আসছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত এই ব্যক্তির দাবি আইনে পিএইচডি করেছেন তিনি। আহমেদাবাদ, ভদোদরা ও গান্ধীনগরে জমি বিবাদে সালিশী পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন বলে দাবি করেছেন।

আহমেদাবাদ জোন-২ এর ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) শ্রীপাল শেশমা বিবিসিকে বলেন, ‘মরিস ক্রিশ্চিয়ান মূলত সবরমতীর বাসিন্দা।’

তিনি জানান, ‘কয়েক বছর আগে গান্ধীনগরে ভুয়া আদালত খুলেছিলেন মরিস। পুলিশে অভিযোগের জেরে সেই আদালতের ঠিকানা বদলে ফেলতে বাধ্য হন। আদালতের ঠিকানা বদলে দিয়েছিলেন। বর্তমানে গান্ধীনগরের সেক্টর ২৪-এ একটা ভুয়া আদালত চালাচ্ছিলেন তিনি।’

পুলিশ জানিয়েছে, সিটি সিভিল কোর্টে মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান স্বীকার করেছেন যে তিনি গত এক বছরে গান্ধীনগর, আহমেদাবাদ ও ভদোদরায় মিলিয়ে ৫০০টি বিতর্কিত জমি সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়েছেন।

প্রতিবেশী কী বলছেন?
এক সময় মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের প্রতিবেশী ছিলেন স্যামুয়েল ফার্নান্ডেজ। তিনি আহমেদাবাদের সবরমতীর কবীর চক এলাকার বহুদিনের বাসিন্দা।

বিবিসিকে স্যামুয়েল ফার্নান্ডেজ বলেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখত মরিস। লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিত। মরিসের মা গোয়ার বাসিন্দা ছিলেন আর বাবা রাজস্থানের।’

‘অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল মরিস কিন্তু কখনো ফেরত দেয়নি। এই অভ্যাসের কারণে সবরমতীর সকলেই ওর থেকে দূরে থাকতে শুরু করে।’

‘এক সময় এই এলাকা ছেড়ে চলে যায় মরিসের পরিবার। তার কয়েক বছর পরে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, তখন মরিস জানিয়েছিল ও বিদেশে পড়াশোনা করেছে এবং বিচারক হয়েছে।’

স্যামুয়েল ফার্নান্ডেজের মতে, বড় কর্মকর্তাদের মতো জীবনযাপন করতেন মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান। তিনি গাড়িতে ভ্রমণ করতেন। এমনকি তার ব্যাগ ধরে রাখার জন্য একজন ব্যক্তি ছিলেন।

কিভাবে ভুয়া আদালত চালাতেন?
এই মামলার শুনানির সময় সরকারি আইনজীবী আদালতে যে তথ্য পেশ করেছেন, সেখান থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ শুরু করে সরকার। কারণ ছিল আদালতে দায়ের হওয়া বিপুল সংখ্যক মামলার বোঝা। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মামলা নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী ও আইনজীবী নিয়োগ করা হয়।

এই সময়েই মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান সালিশীর প্রশংসাপত্র পান। এরপরই প্রথমে গান্ধীনগরের সেক্টর-২১-এ তার ভুয়া আদালত শুরু করেন।

আদালত পরিচালনার জন্য বিচারকের আসনের ব্যবস্থা করেন। আদালতে একজন বিচারককে যেমন আসনে দেখা যায় তেমনই একটা চেয়ার কেনেন তিনি।

এরপর দু’জন টাইপিস্টকে নিয়োগ করেন, জামিনদার নিয়োগ করেন এবং বিতর্কিত জমি ও ভবন সংক্রান্ত মামলার বিচার শুরু করে দেন।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের আইন বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট দীপক ভাট বিবিসি গুজরাটির সাথে কথোপকথনের সময় ব্যাখ্যা করেন, ‘বিচার প্রক্রিয়ার বিপুল বোঝা কমাতে সালিশ এবং দুই পক্ষের সমঝোতার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। আরবিট্রাল আইনের ৭ ও ৮৯ ধারা অনুযায়ী এই নিয়োগ করা যেতে পারে’

মধ্যস্থতাকারী কিভাবে কাজ করেন সে বিষয়েও জানিয়েছেন দীপক ভাট। তিনি বলেন, ‘মধ্যস্থতাকারীর কাজ হলো সমঝোতায় আসা যায় এমন মামলায় দুই পক্ষকে লিখিত চুক্তির জন্য রাজি করানো। এই লিখিত চুক্তি তখনই বৈধ হবে যখন দুই পক্ষই অনুমোদন জানাবে এবং স্বাক্ষর করবে।’

দীপক ভাট বলেন, ‘আদালতের মতো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা সালিশের নেই। আদালত দ্বারা অনুমোদিত হলে তবেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে আসা চুক্তি বৈধ হবে।’

কিভাবে প্রকাশ্যে এলো সত্য?
ডিসিপি শ্রীপাল শেশমা বলেন, ‘সেক্টর ২১-এ ভুয়া আদালত চালানোর সময় মরিসের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগের পর মরিস রাতারাতি ২১ নম্বর সেক্টরের অফিস খালি করে ২৪ নম্বর সেক্টরে একটা আদালত শুরু করে দেন।’

তবে তার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম অভিযোগ নয়। ইতোমধ্যেই এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশে একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চ, মণিনগর ও চাঁদখেদায় মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রথমে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল গুজরাট বার কাউন্সিল।

গুজরাট বার কাউন্সিলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও আইনজীবী অনিল কেলা বিবিসি গুজরাটিকে বলেন, ‘আমরা তার ডিগ্রির বিষয়ে জানতে ছেয়েছিলাম। সেই সময় তখন তিনি বলেছিলেন বিদেশে পড়াশোনা করেছেন এবং তার কাছে এমন ডিগ্রি রয়েছে যে দেশের প্রতিটা ক্ষেত্রে তিনি আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করতে পারবেন।’

‘আমাদের প্রথম সন্দেহ ছিল এই কথা ভেবে যে এত উঁচু ডিগ্রিধারী একজন ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করা উচিত। তিনি কেন নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস করবেন?’

এরপর তার ডিগ্রি সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখা হয়।

‘বার কাউন্সিল যখন তার ডিগ্রি ইত্যাদির বিষয়ে খতিয়ে দেখে তখন জানা যায় সেগুলো সবই জাল। এর ভিত্তিতেই তিনি চার্টারের (দলিল বা সনদ) জন্য আবেদন করেছিলেন। এমনকি ওকালতি করার জন্যও তার প্রয়োজনীয় নথি ছিল না। তাই আমরা ২০০৭ সালে ক্রাইম ব্রাঞ্চে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করি।’

পাশাপাশি অন্যান্য অভিযোগের উল্লেখও করেছেন অনিল কেলা। ‘আমরা আরো জানতে পেরেছি, তাকে মুম্বাইয়ে ৯টি ভিন্ন পাসপোর্ট ও জাল ভিসা রাখার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে তিনি যে ভুয়া আদালত পরিচালনা করছেন সে বিষয়ে আমাদের ধারণাও ছিল না।’

আহমেদাবাদ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চে অভিযোগ ছাড়াও ধৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২০১২ সালে চাঁদখেদা থানায় এবং ২০১৫ সালে মণিনগর থানায় জাল নথির অভিযোগে প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়।

আহমেদাবাদের একটি মামলা
আহমেদাবাদের পালড়ির ঠাকোরওয়াসের বাসিন্দা বাবু ঠাকোরের জমি নিয়ে আহমেদাবাদ মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের সাথে বিবাদ চলছিল। পেশায় দিনমজুর তিনি।

ফোনে কথোপকথনের সময় বাবু ঠাকোর বিবিসিকে বলেন, ‘আমি একজন দিনমজুর, আমার জমি নিয়ে বিবাদ চলছে। এই মামলা নিয়ে আদালতে যাওয়ার মতো টাকা আমার কাছে ছিল না। তাই আমরা মরিস ক্রিশ্চিয়ানের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলাম।’

‘মরিস আমাদের বলেছিল, জমির মূল্য ২০০ কোটি টাকা। এই জমি আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেব। জমির টাকা এলে ফি বাবদ ৩০ লাখ টাকা এবং নথি সংক্রান্ত খরচের জন্য ১ শতাংশ টাকা আপনাকে দিতে হবে।’

‘উত্তরে আমি হ্যাঁ বলেছিলাম। এর জন্য আহমেদাবাদ কালেক্টরের অফিসে নিযুক্ত উকিলের কথা অনুযায়ী সই-সাবুদ করি। ২০১৯ সালে আমাকে নির্দেশ দিয়ে জানানো হয়- এই জমি এখন তোমার।’

গুজরাট সরকারের আইনজীবী ভিবি শেঠ বিবিসিকে বলেন, ‘আমি যখন মামলাটি দেখি, তখন লক্ষ্য করি আদেশে লেখা রয়েছে যে সরকার অবৈধভাবে বাবু ঠাকোরের জমি নিয়েছে।’

‘আট থেকে দশ লাইনের এই আদেশে জমির আয়তন, জমি কার নামে করা রয়েছে এবং তা কখন করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না। শুধু তাই নয়, স্ট্যাম্প পেপারে কিন্তু ওই আদেশ ছিল না।’

এরপর পুরো বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়।

ভিবি শেঠ বলেন, ‘আমরা যখন বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু করি, তখন আদালত থেকে জানা যায় মরিস ক্রিশ্চিয়ানের কাছে সালিশীর জন্য প্রয়োজনীয় পদ ছিল না। কারণ তাকে নিয়ে হাইকোর্টের ১১ ধারা অনুযায়ী সালিশীর জন্য নিয়োগ নিয়ে কোনো আদেশ ছিল না। নিজেই স্পিড পোস্টের মাধ্যমে মামলার জন্য হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতেন মরিস।’

এরপর বাবু ঠাকোরের আইনজীবী ক্রিস্টিনা ক্রিশ্চিয়ানের সাথে যোগাযোগ করা হয়।

ভিবি শেঠ বলেন, ‘আমরা যখন বাবু ঠাকোরের আইনজীবী ক্রিস্টিনা ক্রিশ্চিয়ানকে জেরা করি, তখন তিনি আদালতে স্বীকার করে নেন যে তিনি ফৌজদারি মামলার আইনজীবী, দেওয়ানি মামলার আইনজীবী নন।’

‘এরপর আমরা তদন্ত করে দেখি যে মরিস ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। সরকারি জমি দখলের জন্য যে এমন ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, সেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement