২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভারতের রাজনীতিতে ‘বাংলাদেশীদের’ যেভাবে অবজ্ঞার পাত্র বানানো হলো

১৯৮৫ সালে অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে কয়েকজনকে ধরে আনা হয়েছে রাজস্থানের ডিটেনশন সেন্টারে - ছবি : বিবিসি

প্রায় তিন দশক আগের কথা। ১৯৯৫ সাথে মহারাষ্ট্র রাজ্যে সেই প্রথম ক্ষমতায় এলো দুই হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনা আর বিজেপির জোট, ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসলেন শিবসেনা নেতা মনোহর জোশী। তবে সেই সরকারের রাশ আর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল শিবসেনা সুপ্রিমো বালাসাহেব ঠাকরের হাতে, বলাই বাহুল্য।

বিজেপি-শিবসেনা সরকার ক্ষমতায় এসেই মুম্বাই আর শহরতলির ঘিঞ্জি বস্তি এলাকাগুলোতে শুরু করল ‘বাংলাদেশী খেদাও’ অভিযান।

শহরের কোনায় কোনায় তখন পুলিশ হানা দিয়ে তুলে আনত বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের, আর সেই নারী-পুরুষ-শিশুদের তুলে দেয়া হতো কলকাতাগামী মুম্বাই-হাওড়া ট্রেনের কামরায়।

অভিযুক্তদের আসল নাগরিকত্ব ভালোভাবে যাচাই না করেই তাদের দেয়া হতো ‘অবৈধ বাংলাদেশী’র তকমা, ফলে তখন প্রায়ই অভিযোগ উঠত পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের বাঙালি মুসলিমদেরও অভিযানে হেনস্থা হতে হচ্ছে।

ভারতের একটি রাজ্য সরকারের যেহেতু দেশ থেকে ডিপোর্ট করার ক্ষমতা নেই, তাই এই তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’দের রাজ্যছাড়া করেই দায় সারত মহারাষ্ট্র সরকার।

হাওড়া স্টেশনে নেমে শিথিল পাহারার সুযোগে এদের অনেকেই আবার জনারণ্যে মিশে যেতেন, কেউ কেউ রুটিরুজির তাগিদে আবার ফিরে আসতেন মুম্বাইতে।

কথিত ‘বাংলাদেশী’দের বিরুদ্ধে বালাসাহেব ঠাকরের এই লড়াই কিন্তু আমৃত্যু জারি ছিল!

তার শেষ জীবনে, যখন শিবসেনা আর রাজ্যের ক্ষমতায় নেই, তখনও ‘মি মুম্বাইকার’ (আমরা যারা মুম্বাইয়ের) গোছের দলীয় জনসভাগুলোতে নিয়মিত ভাষণ দিতে যেতেন প্রবীণ এই নেতা।

আর শিবসৈনিকদের উদ্দেশে সেখানে তিনি বলতেন, ‘যে তানসা লেকের পানি মুম্বাইয়ের তৃষ্ণা মেটে, বাংলাদেশীরা এসে সেই লেকের পানি শুকিয়ে ফেলছে। তানসা লেক একদিন মরে গেলে এই বাংলাদেশীরা পালিয়ে যাবে, আমাদের কিন্তু মুম্বাইতেই থাকতে হবে। কাজেই এখনই এদের তাড়ান!’

‘অবৈধ বাংলাদেশী’দের বিরুদ্ধে এই অভিযান অবশ্য মুম্বাইয়েরও আগে শুরু হয়েছিল ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। যখন ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে একটি বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে, মুখ্যমন্ত্রী হন দলের বর্ষীয়ান পাঞ্জাবি নেতা মদনলাল খুরানা।

রাজধানীর হিন্দু ভোটব্যাংক সুসংহত করার চেষ্টায় বিজেপিও তখন প্রচার শুরু করেছিল, অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে বাংলাদেশী মুসলিমরা শহরের সিলমপুর, নিজামুদ্দিন বা জাফরাবাদসহ বিভিন্ন এলাকা ছেয়ে ফেলছে- এখনই তাদের তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

বিজেপি ক্ষমতায় আসার মাসকয়েক আগে মদনলাল খুরানার নেতৃত্বে বাংলাদেশীদের তাড়াতে দিল্লিতে একটি রাজনৈতিক অভিযানও শুরু করা হয়েছিল, যার নাম দেয়া হয় ‘ইলান-ই-জং’ (যুদ্ধ ঘোষণা)!

তখন পূর্ব দিল্লি আসনের এমপি ছিলেন বিজেপির কট্টরপন্থী নেতা বি এল শর্মা প্রেম, বাংলাদেশী তাড়ানোর ইস্যুতে যিনি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীরও এক ধাপ আগে।

মদনলাল খুরানার সরকার অভিযানে কোনো ঢিলেমি করলেই তিনি হুঙ্কার দিতেন, ‘দরকারে মিলিটারি নামিয়ে বাংলাদেশীদের দিল্লিছাড়া করতে হবে।’

আর রাজধানীতে যেকোনো ভোট এলেই এই সব কথাবার্তা ও অভিযানের বহর বাড়ত যথারীতি!

‘শরণার্থী’ আর ‘অনুপ্রবেশকারী’র ন্যারেটিভ
এর আগে, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ছাত্র সংগঠন ‘আসু’-র নেতৃত্বে যে আসামে যে তীব্র আন্দোলন ও ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান হয়েছিল, তাতেও একটা বাংলাদেশীবিরোধী মাত্রা অবশ্যই ছিল। কিন্তু ভারতের বাকি অংশেও এটা ছড়িয়ে পড়ে মূলত নব্বইয়ের দশক থেকেই।

আসামের বাইরে ভারতে কথিত ‘বাংলাদেশী’দের এভাবে আক্রমণের নিশানা করার প্রক্রিয়া শুরু হয় মূলত দিল্লি ও মুম্বাই থেকেই। যা এখন ধীরে ধীরে ক্রমশ ব্যাঙ্গালোর, আহমেদাবাদ, পুনে, জম্মু বা লক্ষ্ণৌর মতো বিভিন্ন শহরেই ছড়িয়ে পড়েছে।

বছর কয়েক আগে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রেও বিশ্লেষক রিজওয়ানা সামশাদ দেখিয়েছেন, দিল্লিতে বাংলাদেশী অভিবাসীদের উপস্থিতি ১৯৯০-এর দশক থেকেই কিভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নির্বাচনী প্রচারণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে।

‘দ্য ইনফিলট্রেটরস অব দিল্লি’ শীর্ষক এই গবেষণাপত্রের মূল কথাটা ছিল : হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টিতে ভারতে আগত হিন্দু বাংলাদেশীরা ‘শরণার্থী’ হলেও মুসলিম বাংলাদেশীরা হলো ‘ইনফিলট্রেটর’ বা অনুপ্রবেশকারী, যারা ভারতের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে বাংলাদেশীবিরোধী এই ক্যাম্পেইন একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে, এখন অবৈধ বাংলাদেশী কথাটার সাথে জুড়ে গেছে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটাও।

প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্ষমতায় আসার পর নিজে এই ইস্যুটা নিয়ে বহুদিন নীরব ছিলেন। কিন্তু তার ‘ডেপুটি’ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কথিত অবৈধ বাংলাদেশীদের আক্রমণ করতে সৌজন্য বা শালীনতার কোনো ধার ধারেননি!

গত কয়েক বছরে তিনি একটার পর একটা জনসভায় তাদের উদ্দেশ্য করে ‘ঘুষপেটিয়া’, ‘উইপোকা’র মতো অবমাননাকর শব্দ অবলীলায় ব্যবহার করেছেন। দলের ছোট-বড়-মাঝারি নেতারাও এ ব্যাপারে বিশেষ পিছিয়ে ছিলেন না।

মাত্র দিন কয়েক আগেও অমিত শাহ ঝাড়খণ্ডের একটি জনসভায় হুমকি দিয়েছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে এই অনুপ্রবেশকারীদের ‘উল্টা করে ঝুলিয়ে সিধে করা হবে!’ বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই কূটনৈতিক স্তরে এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর ভারতেও যে উৎসাহ-উদ্দীপনা-আবেগের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, মাত্র ২০-২২ বছরের মধ্যে সেই ‘বাংলাদেশী’রা কিভাবে ভারতের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে অবজ্ঞা ও অবমাননার পাত্র হয়ে উঠলেন?

অথচ সার্বভৌম বাংলাদেশকে সম্মান জানাতে একাত্তরে কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী, ভারতের ছোটখাটো নানা জনপদের নামকরণ পর্যন্ত করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা উত্তাল হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর যৌথ জনসভায়।

সেই বাংলাদেশের অধিবাসীদের এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এদেশে ‘কুনজরে’ দেখা শুরু হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় নিহিত আছে ভারতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অন্দরেই।

বাংলাদেশ-লাগোয়া আসামের পরিপ্রেক্ষিত হয়তো এক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা, কিন্তু বাকি ভারতেও কিভাবে এই প্রক্রিয়াটা ছড়িয়ে পড়ল যাতে ‘বাংলাদেশী’ বা ‘রোহিঙ্গা’কে অনেকে এদেশে এখন প্রায় গালিগালাজের পর্যায়ে ফেলে দিচ্ছেন?

এই প্রসঙ্গটি নিয়ে দিল্লিতে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক, অ্যাকাডেমিক, বিজেপি ও বিজেপি-বিরোধী দলের রাজনীতিকদের সাথে। তাদের বক্তব্যের সারকথাই এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো।

‘বাংলাদেশী মানে মুসলিম’
দিল্লির কাছে ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বাংলাদেশ নিয়ে চর্চা ও গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে। দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন ভিআইএফ বা আইডিএসএ-এর মতো থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর সাথে, পরিচালক ছিলেন কলকাতার মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজেরও।

ড. দত্ত বলছিলেন, এই যে ভারতের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ‘বাংলাদেশী’দের নিয়মিত গালমন্দ করে থাকেন, এর সাথে আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারার একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে।

তার কথায়, ‘সোজা কথাটা হলো, বাংলাদেশী বলতে এখানে বিদেশী মুসলিমদের বোঝানো হচ্ছে। আর যেটা সঙ্ঘ পরিবার বিশ্বাস করে যে মুসলিমরা হলো নো ডু-গুডার, মানে কোনো ভালো কাজ করতেই পারে না, তাদেরকে সেভাবেই তুলে ধরা হচ্ছে। এখন আমি যদি ধরে নেই মোদি-অমিত শাহরা যে কথাগুলো বলছেন সেটা আরএসএসের ভাবধারারই প্রতিফলন, তাতে এটা বোঝা আরো সহজ হবে। বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমরা এদেশে অবৈধভাবে ঢুকেছেন, সে দেশে এই মুসলিমরাই হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছেন- এই ন্যারেটিভ দিয়েই তথাকথিত বাংলাদেশীদের আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে।’

শ্রীরাধা দত্ত আরো মনে করেন, বাংলাদেশীদের এই খল চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার প্রক্রিয়াটা আসাম থেকেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘আসামসহ উত্তর-পূর্বের সব রাজ্যেই ভূমিপুত্র বনাম বহিরাগত একটা সংঘাত বরাবরই ছিল। আর সেখানে মুসলিম মানেই ধরে নেয়া হতো বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজন, সে তারা বা তাদের পূর্বপুরুষরা যতদিন আগেই আসুন না কেন।’

১৯৯৮ সালে আসামের তদানীন্তন রাজ্যপাল লেফটেন্যান্ট গভর্নর এস কে সিনহা দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, তাতেও পরিষ্কার বলা হয়েছিল যে বাংলাদেশ থেকে ঘটা অবৈধ অনুপ্রবেশ শুধু অসমিয়া জাতিসত্ত্বা বা পরিচিতির জন্যই হুমকি নয়, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও একটা বড় বিপদ।

তিনি বলেন, ‘এস কে সিনহার সেই রিপোর্টও বাংলাদেশী তকমাকে ভারতের জন্য বিপজ্জনক একটা মাত্রা দিয়েছিল। পরে অমিত শাহ বা তার দলের অন্য নেতারা সেটাকেই এখন একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

ইদানীং বিজেপির শীর্ষ নেতারা যে আবার বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের ইস্যুতে সরব হয়েছেন, তার সাথে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের সম্পর্ক আছে বলেও তিনি মনে করেন।

ড. দত্ত বলছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে যে ৫৫০-৬০০ শিক্ষার্থী মারা গেলেন, ভারতের মিডিয়াতে সেটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ১০-১২ জন হিন্দুর নিহত হওয়ার খবরকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একটি মৃত্যুও অবশ্যই কাম্য নয়, কিন্তু এখানে মাত্রার একটা তারতম্য আছে। এখন ভারতের সাধারণ লোকজন বাংলাদেশকে যেহেতু জাজ করবেন দেশজ মিডিয়ার দৃষ্টি দিয়েই, তাই তাদের চোখে বাংলাদেশী মানেই এখন হিন্দু নির্যাতনকারী। রাজনীতির কারবারিরাও এটারই সুযোগ নিচ্ছেন, বাংলাদেশী বলে আরো গাল পাড়ছেন!’

বিজেপির এ ব্যাপারে কী বক্তব্য?
দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপির যে নীতি-নির্ধারণী গবেষণা সংস্থা বা পলিসি রিসার্চ সেল আছে, তার সাথে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত অনির্বাণ গাঙ্গুলি।

মূলত তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও পশ্চিমবঙ্গে বোলপুর বা যাদবপুরের মতো হাই-প্রোফাইল আসনে তিনি বিজেপির হয়ে ভোটেও লড়েছেন।

ড. গাঙ্গুলি কিন্তু পরিষ্কার বলছিলেন, তার দল বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের সবসময়েই সম্মানের চোখে দেখে থাকে। তাদের আপত্তি শুধু অবৈধ পথে আসা অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে।

অনির্বাণ গাঙ্গুলির কথায়, ‘আমি জানি না কে বলছে, আমরা বাংলাদেশীদের অবজ্ঞা করি! হয়তো কোনো আন্তর্জাতিক চক্র বিকৃত করে গোটা বিষয়টা পেশ করতে চাইছে। কিন্তু এখানে সাধারণ বাংলাদেশী নাগরিক ও অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে, এটা তো আগে বুঝতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যে কথাগুলো আপনারা উল্লেখ করছেন, সেটা কাদের উদ্দেশে বলা? যাদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়নি, বরং যারা নিজের থেকে অবৈধ পথে ভারতে ঢুকেছেন এবং এদেশে বছরের পর বছর ধরে রোজগার করে খাচ্ছেন, তাদেরকেই বলা! তারা ভারতে যেখানে থাকছেন, সেখানে সমস্যা তৈরি করছেন বলেই এই ব্যবস্থা নেয়ার কথা আসছে।’

অনির্বাণ গাঙ্গুলি আরো জানান, পিনাকী ভট্টাচার্যর মতো বাংলাদেশী অ্যাক্টিভিস্ট প্যারিসে বসে নিয়মিত ‘ভারত-বিরোধী গালমন্দ করে যাচ্ছেন বা ভারতীয়দের শাপশাপান্ত করছেন’- তবু ভারত কখনো তার বিরুদ্ধে কিছুই বলেনি!

তিনি বলেন, ‘ওনার বাকস্বাধীনতা আছে, যা খুশি করুন, আমাদের দেখার দরকার নেই। বাংলাদেশ ও তার মানুষকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু আমাদের সমস্যা আছে জসিমউদ্দিন রহমানির মতো বাংলাদেশীদের নিয়ে, যিনি তার নিজ দেশের ব্লগারদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েও এখন জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমাদের সমস্যা আছে বাংলাদেশের সেই সব লোকজনকে নিয়ে, যারা চোরাপথে এদেশে ঢুকে ভারতে হিন্দু বা আদিবাসীদের জমি দখল করে রেখেছেন, আমাদের সম্পদে ভাগ বসাচ্ছেন।’

সুতরাং বিজেপির দাবি, বাংলাদেশী ‘ঘুষপেটিয়া’ বলতে তারা যাদের বুঝিয়ে থাকে- তাদের সাথে বাংলাদেশের সাধারণ শান্তিপ্রিয় একজন নাগরিকের কোনো সম্পর্ক নেই।

রীতিমতো ডিফায়ান্ট ভঙ্গীতে বিজেপির এ নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা বলছেন ভারত কেন আমাদের অবজ্ঞা করে, তাদের বরং আমি পরামর্শ দেবো নিজের দেশের হিন্দুদের দিকে তাকান। ওই হিন্দুরাও তো নিজের ঘাম-রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ গড়েছেন, তাদের কেন দেশ ছাড়তে বলা হচ্ছে সেটা আগে দেখুন। একটু আগে আত্মসমীক্ষা করুন, তারপর বরং ভাববেন ভারতীয়রা কী বলতে চাইছে”,

‘নেহাতই ভোটের রাজনীতি’
বিগত প্রায় এক দশক ধরে ভারতের একজন সুপরিচিত ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান সুস্মিতা দেব। ২০১৪ সালে তিনি শিলচর থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে, পরে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিলে দল তাকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতে আসাম ও ত্রিপুরার মতো বিভিন্ন রাজ্যে অনুপ্রবেশের ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এই রাজনীতিবিদ।

সুস্মিতা দেব মনে করেন, এই যে বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশকারী বলে গালিগালাজ করা হয় এটা নেহাতই ভোটের রাজনীতি। অথচ সত্যি কথা বলতে বিজেপি বা ভারতের কোনো দলের সরকারই অনুপ্রবেশের সমস্যা মেটানোর জন্য কখনো আন্তরিক ছিল না।

তিনি বলেন, ‘আসামের মঙ্গলদই লোকসভা আসনে ১৯৭৯ সাথে যখন উপনির্বাচন হয়, তখনই ট্রাইব্যুনালের তদন্তে দেখা গিয়েছিল ভোটার তালিকার ৪০ শতাংশ নামই ভারতের নাগরিক নন। বিদেশীদের নিয়ে তখনই প্রথম কিন্তু আসামের টনক নড়ে। কিন্তু মুশকিল হলো আজ পর্যন্ত অনুপ্রবেশের এই সমস্যাটাকে শুধু ভোট এলেই উসকে দেয়া হয়েছে, এটার সমাধানের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। যে কারণে বাংলাদেশী বলে এক শ্রেণির মানুষকে আজও এ দেশে হেনস্থা করা হচ্ছে।’

সুস্মিতা দেবের যুক্তি হলো, অনুপ্রবেশের সমস্যার সত্যিই সমাধান করতে চাইলে ভারতের উচিত ছিল অনেক আগেই বাংলাদেশের সাথে দ্বি-পক্ষীয় আলোচনায় প্রসঙ্গটা উত্থাপন করা, যাতে এর একটা সমাধানের পথ বের করা যায়।

তিনি বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি আর শেখ হাসিনার মধ্যে এতগুলো সামিট লেভেল বৈঠক হয়েছে, বাংলাদেশকে শত শত কোটি টাকার ক্রেডিট লাইন দেয়া হয়েছে ... কিন্তু আমরা কি কখনো দেখেছি যে ভারত অনুপ্রবেশ নিয়ে কড়া আপত্তি জানিয়েছে? জানায়নি। আসলে ইচ্ছে করে এই সমস্যাটাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে, যাতে ভোট এলেই কথিত বাংলাদেশীদের ঘুষপেটিয়া বলে আক্রমণ শানানো যায়। কাজেই আমার মতে এটা পুরোদস্তুর একটা রাজনৈতিক গিমিক ছাড়া আর কিছু নয়!’

আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি তৈরির নামে বিদেশীদের চিহ্নিত করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেটার ব্যর্থতাও এই বাস্তবতার পেছনে একটা বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, ‘এনআরসির নামে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি খরচ হল, আসামের তিন কোটি মানুষ কাগজ দেখালেন, তারপরও বিজেপি সরকার সেই এনআরসি নোটিফাই পর্যন্ত করতে পারল না। এটাকে বিজেপির চূড়ান্ত ব্যর্থতা ছাড়া আর কী-ই বা বলবেন? অমিত শাহ বলেছিলেন এনআরসি দিয়ে আসামের ৪০ লাখ ঘুষপেটিয়াকে খুঁজে বের করবেন, একজনকেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডিপোর্ট করতে পারলেন না।’

ভারতে অবৈধ বিদেশী যদি কেউ থেকেও থাকেন, তাদের শনাক্ত করা থেকে শুরু করে ফরেনার্স অ্যাক্টে তাদের সাজা দেয়া কিংবা শাস্তিভোগের শেষে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে কথা বলে তাদের ফেরত পাঠানো- পুরো দায়িত্বটাই আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের।

তৃণমূল কংগ্রেসের এই সংসদ সদস্য মন্তব্য করেন, ‘সে সব কিছু না করে এবং একটা ফ্লপ নাগরিকত্ব আইন এনে বিজেপি আসলে বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশী তাসটাকে তারা শুধু ভোটের হাতিয়ার হিসেবেই রেখে দিতে চায়।’

দৃষ্টিভঙ্গি বদলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির অধ্যাপক, ওই প্রতিষ্ঠানের ভিসিও ছিলেন তিনি।

শরণার্থী ও অভিবাসন-সংক্রান্ত বিষয়গুলো তিনি গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে, বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়া তার বিশেষ আগ্রহের ক্ষেত্র।

ড. বসুরায় চৌধুরী বলেন, একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশকে ভারত যে চোখে দেখত তার তুলনায় আজ যে গড়পরতা ভারতীয়দের দৃষ্টিতে ‘বাংলাদেশী’ শব্দটার কনোটেশন (দ্যোতনা) পাল্টে গেছে, তার একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট আছে।

তার কথায়, ‘শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ প্রবেশ করল সামরিক শাসনের যুগে, জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গায় নিয়ে আসলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলা ভাষাকে যুক্ত করলেন ইসলামের সাথে। দূরত্ব বাড়ার প্রক্রিয়াটা কিন্তু তখন থেকেই শুরু। এরশাদের আমলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয়েছে, ব্যবধান আরো বেড়েছে। আবার বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসার পর যখন বিএনপি ক্ষমতায় এলো, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেখানে আশ্রয় পেয়েছে, দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে।’

ফলে সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী মনে করেন, এই যে আজ ভারতে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ বাংলাদেশীদের হেয় করে কথা বলেন তারা সম্পর্কের এই অবনতিটারই সুযোগ নেন।

আবার ভারতের ভেতরে আসাম আন্দোলনের মতো ইস্যুও নিঃসন্দেহে সেটাকে উসকানি দেয়।

তিনি আরো যোগ করেন, ‘বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা বাংলাদেশীদের সম্পর্কে যে সব কথা বলেন, সেটা কিন্তু এক ধরনের রেটোরিক- যা ভারতের নিজস্ব রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ শ্রোতাদের মাথায় রেখেই বলা। মানে ইংরেজিতে যাকে বলে ডোমেস্টেক কনসাম্পশন।’

তবে ঘরোয়া রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে এতে অবশ্যই কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু রাজনীতিবিদরা কবে আর দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা ভেবে পদক্ষেপ নেন?

সব্যসাচী বসুরায় চৌধুরী আরো বলেন, নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ যে সম্প্রতি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে সুর চড়িয়েছেন- এর পেছনেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের গভীর সম্পর্ক আছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে ঢাকা ও দিল্লির দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কে আমরা যে অবনতি ও অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করছি, সেটারও এতে প্রভাব আছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু ও আদিবাসী ভোট সংহত করার জন্য বিজেপি নেতৃত্ব স্পষ্টতই এখন আরো বেশি করে এই বাংলাদেশ কার্ডটা খেলতে চাইছে।’

তবে ‘বাংলাদেশী’ কথাটাকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্কের এই রাজনীতি করার প্রবণতা শুধু বিজেপির নয়- ভারতের অন্য বড় দলগুলোও যে কমবেশি একই কাজ করে এসেছে, সব্যসাচী বসুরায় চৌধুরী সেটাও মানেন।

ভারতের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে ‘বাংলাদেশী’ শব্দটা এই সব কারণ মিলিয়েই বিগত কয়েক দশকে একটা জটিল ও বহুমাত্রিক আকার নিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement