কাশ্মিরের নির্বাচনে বিপুল সাড়া, নেপথ্যে যা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫২
মাস চারেক আগে ভারত-শাসিত কাশ্মিরে যখন লোকসভা নির্বাচন হয়, তখনই বোঝা যাচ্ছিল ওখানে কিছু একটা বড়সড় পরিবর্তন অবশ্যই ঘটছে!
কারণ যে কাশ্মির একদা ‘ভোট বয়কট’ আর ‘সেনা জবরদস্তি’র জন্য পরিচিত ছিল, সেখানে মে মাসে গোটা রাজ্যেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট পড়ে প্রায় ৫৯ শতাংশের কাছাকাছি! ভোটে সেই অকল্পনীয় সাড়া মেলার পর এখন সেপ্টেম্বরে এসে বিধানসভা নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, প্রথম দফায় ভোট পড়ার হার প্রায় ৬২ শতাংশে পৌঁছে গেছে- বিগত প্রায় ৪০ বছরের মধ্যে যা কখনো ঘটেনি।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার ভোটের পরই রাজ্যের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা পি কে পোলে জানান, কাশ্মিরে লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচন মিলিয়ে গত সাতটা ভোটের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এই হিসাব। আর বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণেও অভাবনীয় সাড়া মিলেছে, প্রাথমিক হিসাবে সে দিনও ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশর বেশি।
এর মধ্যে জম্মুর মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা কিশতওয়ারে ভোটদানের হার তো ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। জম্মুর রামবান জেলায় ৭০ শতাংশ বা কাশ্মিরের কুলগামেও ৬৫ শতাংশ ভোটার পোলিং বুথে এসেছেন, আর সর্বত্রই ভোট হয়েছে রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশে।
অথচ এই কাশ্মিরেই মাত্র কিছুকাল আগেও নির্বাচন মানেই ছিল হুরিয়ত কনফারেন্স বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভোট বয়কটের ডাক।
আর পাশাপাশি অভিযোগ উঠত, বয়কটের ডাক ব্যর্থ করতে ভারতীয় সেনাবাহিনী জোর করে এক-আধটা আস্ত গ্রামকে বন্দুকের মুখে পোলিং বুথে নিয়ে গেছে, যাতে অন্তত এই ছবিটা তুলে ধরা যায় যে কাশ্মিরে ভোট দিতেও মানুষের লাইন পড়ছে!
কিন্তু আজ জম্মু ও কাশ্মিরের ভোটাররা যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে আসছেন, তাতে কোনো সংশয় নেই। চেনা-অচেনা কোনো গোষ্ঠীই ভোট বয়কটের ডাক দেয়নি, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও জোর খাটানোর কোনো অভিযোগ ওঠেনি।
তবে যে কোরসা ‘সাফল্যে’র যেমন একাধিক দাবিদার থাকে, তেমনি কাশ্মিরের এই নাটকীয় পটপরিবর্তনের নেপথ্যে কী, তা নিয়েও অনেকগুলো মতবাদ আছে।
ভারতের শাসক দল বিজেপি যেমন পরিষ্কার বলছে, পাঁচ বছর আগে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে তারাই কাশ্মিরকে দেশের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনেছে এবং সে কারণেই গোটা অঞ্চলে এখন শান্তি ও সুস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যালট বাক্সে কাশ্মিরিদের সেই আস্থারই প্রতিফলন ঘটছে বলে তাদের দাবি।
শ্রীনগর ও তার আশপাশে গত সপ্তাহে বহু সাধারণ কাশ্মিরির সাথে কথা বলেছি, তারা আবার অনেকেই বলছেন হ্যাঁ, পরিস্থিতির বেশ অনেকটা উন্নতি হয়েছে এতে কোনো ভুল নেই!
তারা বলছেন, ‘কিন্তু বিজেপির এতে কোনো কৃতিত্ব নেই! বছরের পর বছর ধরে টানা অস্থিরতা আর সহিংসতায় ক্লান্ত হয়ে কাশ্মিরের আমজনতাই এবার স্থির করেছে, ঢের হয়েছে, আমরা নিজেরাই উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনব আর ভোট দিতে যাব।’
কাশ্মিরে ন্যাশনাল কনফারেন্স বা পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মতো পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো আবার বিশ্বাস করে ৩৭০ ধারা এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব, আর বিপুল সংখ্যায় ভোট দিয়ে উপত্যকার মানুষ বিজেপির সেই ভয়াবহ বিতর্কিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
কাশ্মিরে এখনো ভারত ‘নিষিদ্ধ’ জামায়াত-ই-ইসলামীর নেতারা পর্যন্ত বলছেন, মানুষের হাতে আর কোনো প্রতিবাদের পথ নেই বলেই তারা বাধ্য হয়ে ভোট দিচ্ছেন, যাতে কাশ্মিরিদের কণ্ঠস্বর দিল্লির কানে পৌঁছায়!
আসল কারণ হয়তো এগুলো সব মিলিয়েই। তবে বাস্তবতা হলো ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করার পদক্ষেপের সাথে এই প্রতিটি ফ্যাক্টরেরই কিছু না কিছু সম্পর্ক আছে। জম্মু ও কাশ্মির যে আজ ভোটের লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছে, তার পেছনে সেই সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা অবশ্যই আছে।
বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপের পর গত পাঁচ বছরে কাশ্মিরের ‘গ্রাউন্ড রিয়েলিটি’তে ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, এই প্রতিবেদন আসলে তারই একটা সরেজমিন অন্তর্তদন্ত।
মোবাইল শাটডাউন থেকে ফাইভ জি
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের পার্লামেন্ট কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতি কেড়ে নেয়ার ঠিক পরদিন বিকেলেই শ্রীনগরের বিমান ধরেছিলাম। পুরো উপত্যকায় তখন মোবাইল ইন্টারনেট তো বটেই, সেলফোন বা ল্যান্ডলাইন পরিষেবা পর্যন্ত বন্ধ। সেই অবস্থা চলেছিল মাসের পর মাস।
শ্রীনগরের শেখ-উল-আলম এয়ারপোর্টে ফ্লাইট নামার পর স্পাইসজেটের এয়ারহোস্টেস যখন রোজকার অভ্যেসে বলেছেন, ‘এখন আপনারা মোবাইল ফোন চালু করে ইউজ করতে পারেন।’ ওই থমথমে পরিবেশেও গোটা প্লেন হাসিতে ফেটে পড়েছিল!
কাশ্মিরে তখন সর্বাধুনিক আইফোন বা স্যামসুং গ্যালাক্সিও নেহাতই অচল খেলনার চেয়ে বেশি কিছু নয়! উপত্যকায় সহিংসতা বাড়লেই তখন প্রশাসনের প্রথম কাজ ছিল, মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া।
ফোনে ডেটা না পেতে পেতে বিরক্ত কাশ্মিরি তরুণরা ওয়াই-ফাই হ্যাক করায় ওস্তাদ হয়ে ওঠে, বিভিন্ন বাড়ির বা শপিং মলের কোনায় জটলা করে তারা সেখানকার ওয়াই-ফাই দিয়ে নেট চালাচ্ছে, এটা ছিল শ্রীনগরে খুব পরিচিত দৃশ্য।
আর সেই কাশ্মিরেই পাঁচ বছর বাদে এবার গিয়ে দেখলাম, ফোনে ফাইভ-জি ডেটার স্পিড রাজধানী দিল্লির চেয়েও বেশি ছাড়া কম নয়!
বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে করতে কাশ্মিরিরা ইউটিউবে প্রিয় পাকিস্তানি সিরিয়াল ‘নূরজাহান’ ইউটিউবে দেখছেন কোনো বাফারিং ছাড়াই। তরুণ-তরুণীরা নেটফ্লিক্স থেকে প্রিয় শো নিজেদের ফোনে ডাউনলোড করে নিচ্ছেন চোখের নিমেষে!
পর্যটকের ঢল, ফুরফুরে আমেজ
পাঁচ বছর আগের সেই আগস্টে গোটা শহরে জারি ছিল কঠোর কারফিউ, রাস্তায় ছিল অবিরত ফৌজি টহল। শ্রীনগরে ডাল লেকের ধারে শিকারা আর হাউসবোটগুলো তখন যথারীতি খদ্দের পায়নি মাসের পর মাস।
আর সেই শ্রীনগরেই এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে রোজ প্রায় ৪০টা ফ্লাইট নামছে, দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সামলে কূল করতে পারছেন না ট্যাক্সি-চালক, শিকারাওলা বা হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকরা।
গত বছরের হিসাব বলছে, প্রায় ৭০ বছরের রেকর্ড ভেঙে শুধু কাশ্মির ভ্যালিতেই ২৭ লাখের বেশি পর্যটক এসেছেন। এদের মধ্যে যেমন ভারতীয়রা আছেন, তেমনি অনেকেই এসেছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা বাংলাদেশ থেকেও।
কেন্দ্রীয় সরকারের স্মার্ট সিটি প্রকল্পে শ্রীনগর শহরেরও ভোল ফিরেছে, ঝকঝকে রাস্তায় ছুটছে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক বাস আর অটো।
শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্র লালচকে যে ক্লক টাওয়ার বা ‘ঘণ্টাঘর’- সেই চত্ত্বরে মধ্যরাতের পরেও এখন আইসক্রিম খাওয়ার ভিড়, পিজা ডেলিভারির ব্যস্ততা কিংবা নিছক জয়-রাইডে আসা তরুণ-তরুণীদের নিশ্চিন্ত আড্ডা।
এ কাশ্মিরকে যেন সত্যিই চেনা যায় না! প্রায় ৩০ বছর ধরে আসছি শ্রীনগরে, সত্যি কথা বলতে এ দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি।
সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে, হামলা বা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও তার আগের পাঁচ বছরের চেয়ে অনেক কমেছে। কাশ্মিরি তরুণরা আগে কথায় কথায় পাথর ছুঁড়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতেন, সেই প্রবণতাও একেবারেই উধাও।
তবে বান্দিপোরা বা অনন্তনাগের দুর্গম ও প্রত্যন্ত প্রান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ বা এনকাউন্টারের ঘটনা এখনো বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। তবে প্রাণহানির সংখ্যা অবশ্যই কমেছে।
অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কাশ্মির উপত্যকা তুলনায় শান্ত হলেও সহিংসতা বা এনকাউন্টারের ঘটনাগুলো এখন সরে গেছে জম্মুর ডোডা, কিশতওয়ার বা রাজৌরির মতো নানা এলাকায়।
তবে সব মিলিয়ে গোটা রাজ্য যে আগের তুলনায় অনেক শান্ত ও স্বাভাবিক, পর্যটকরা ফুরফুরে মেজাজে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই! কিন্তু এটাও ঠিক, এগুলো সবই বহিরঙ্গের পরিবর্তন ... অথবা আপাত ‘স্বাভাবিকতা’য় ফেরা। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর কেন্দ্র কাশ্মিরে উন্নয়ন ও নিরাপত্তার নামে যে টাকা খরচ করেছে বা প্রচুর সেনা মোতায়েন করেছে, এর পেছনে তারও একটা প্রভাব অবশ্যই আছে।
কিন্তু বিশেষ স্বীকৃতি বাতিলের সিদ্ধান্তও কি কাশ্মিরিরা মন থেকে মেনে নিতে পেরেছেন? নাকি একটা পুরনো ক্ষতস্থানের মতো তাদের সেই ব্যথাটা আজও রয়েই গেছে?
‘ইমোশনাল কানেক্ট লস্ট’
শ্রীনগরের অভিজাত গোগজিবাগ এলাকায় নিজের প্রাসাদাপোম ভিলায় এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন কাশ্মির সরকারের সাবেক শীর্ষস্থানীয় আমলা শেখ বাশারাত হোসেইন।
সকাল-বিকেল বাগানে কাওয়াহ চা-তে চুমুক দিয়ে আর দেশ-দুনিয়ার রাজনীতিতে নজর রেখেই আজকাল দিন কাটে তার। কিন্তু ৩৭০ ধারা বিলোপের সেই দিনটা কিছুতেই ভুলতে পারেন না বাশারাত হোসেইন।
তিনি বলেন, ‘দেখুন, সোজা কথা সোজা বলাই ভালো। কাশ্মির একটা মুসলিম রাজ্য। ফলে দেশের সরকার যখন মুসলিমবিরোধী নীতি নিয়ে চলে বা ভারতের অন্য প্রান্তে মুসলিমরা নির্যাতিত হন, কাশ্মিরিরা তাতে ব্যথিত হন।’
তিনি মনে করেন, ৩৭০ ধারার বিলোপ সেই কফিনেই শেষ পেরেকটা ঠুকেছে। এমনকি তার পরিচিত মহলে যে বন্ধুরা পাকিস্তানের বিপক্ষে ও ভারতের পক্ষে গলা ফাটাতেন, তারাও আজকাল আর ভারতের হয়ে বড় একটা কথা বলেন না!
তিনি বলেন, ‘আমি বলব না এই ধারার বিশেষ গুরুত্ব ছিল বা এর ফলে কাশ্মির বিরাট কোনো সুবিধা পাচ্ছিল। কিন্তু এই বিশেষ স্বীকৃতিটা ছিল কাশ্মিরের একটা গর্বের জায়গা, ভারতভুক্তির শর্ত। সেই সমঝোতাটা আপনি দুম করে ভেঙে দিলে ইমোশনাল কানেক্টটাই তো নষ্ট হয়ে যায়!’
এর ফলে কাশ্মিরের সাথে বাকি ভারতের যে ‘মানসিক দূরত্ব’টা তৈরি হয়েছে, সেটা কাটিয়ে উঠতেও যে অনেক অনেক সময় লাগবে তা নিয়েও সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তার কোনো সংশয় নেই।
তীব্র আক্ষেপ ও বিষণ্ণতা মেশানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘তবু হয়তো একদিন এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে, এছাড়া কোনো উপায় যে নেই।’
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অমিত শাহ অবশ্য কিছুদিন আগেই ভ্যালিতে ভোটের প্রচারে গিয়ে বলেন, ‘৩৭০ ধারার কথা ভুলে যাওয়াই ভালো, কারণ সেটার দাফন হয়ে গেছে!’
তারপরেও ন্যাশনাল কনফারেন্স বা পিডিপির মতো দলগুলো ক্ষমতায় এলে ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যদিও তারা নিজেরাও জানে কাজটা কতটা কঠিন!
শ্রীনগরের লালচকে পিডিপির ঝকঝকে তরুণ প্রার্থী জুহেইব ইউসুফ মীর তবুও নিয়ম করে প্রতিটি পথসভা বা ছোটখাটো র্যালিতে বলে যাচ্ছেন, ‘২০১৯ সালের ৫ আগস্ট যে বেআইনি সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। যতক্ষণ শরীরে শ্বাস থাকবে, এই ধারা ফিরিয়ে আনার দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলতেই থাকবে!।’
পিডিপির সবুজ টি-শার্ট পরা তার অনুগামী ও সমর্থকরা নেতার কথায় নিয়মমাফিক হাততালি দেন ঠিকই, কিন্তু তাতে স্বতঃস্ফূর্ততার যেন বড়ই অভাব!
একটু পরে এই প্রতিবেদককেও ইউসুফ মীর যখন বলছিলেন, ‘৩৭০ কেড়ে নেয়ার পর কাশ্মিরিদের কণ্ঠস্বরও তো স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। আপনার পেশার লোকজন- সাংবাদিকদেরই তো এখানে কোনো স্বাধীনতা নেই!’ তার সমর্থকরাও তখন নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন!
আসলে এক সময় দেশের সংবিধানে দেয়া বিশেষ স্বীকৃতি যে এখন শুধুই অতীত, কাশ্মিরও যেন সেই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর জন্য তৈরি হচ্ছে।
৩৭০-পরবর্তী নির্বাচনী রাজনীতি
পাঁচ বছর আগে ৩৭০ ধারার বিলোপ জুম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতিই শুধু কেড়ে নেয়নি, এই অঞ্চলটিকে তা ভারতের একটি পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের বদলে নামিয়ে এনেছিল ‘কেন্দ্রশাসিত’ অঞ্চলের মর্যাদাতেও।
যার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরই এখন জম্মু ও কাশ্মিরের প্রশাসক বা দণ্ডমুণ্ডের কর্মকর্তা, বর্তমানে যে পদে রয়েছেন সাবেক বিজেপি রাজনীতিবিদ মনোজ সিনহা।
সাধারণ কাশ্মিরিরা অনেকেই মনে করেন, ব্রিটিশ আমলে যেমন লন্ডনের নিয়োগ করা ‘ভাইসরয়’ বা বড়লাট ভারত শাসন করতেন, এখন দিল্লিও যেন তাদের ভাইসরয়কে দিয়ে কাশ্মির শাসন করানোর পথ বেছে নিয়েছে। আর এটা তাদের কাছে বড়ই অপমানের!
ফলে এবারের নির্বাচনে কাশ্মিরের পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার দাবি প্রায় সব দলের ইশতেহারেই ঠাঁই পেয়েছে। এমনকি বিজেপি পর্যন্ত অঙ্গীকার করেছে, ‘যথাসময়ে’ জম্মু ও কাশ্মিরকে এই মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া হবে।
শ্রীনগরে ডাল লেকের উত্তর প্রান্তে হজরতবাল আসনে এবার প্রার্থী হয়েছেন স্থানীয় একটি মাজারের প্রভাবশালী পীরসাহেব বিলাল আহমেদ।
শানপোরা গ্রামের সরু পথ দিয়ে পীরসাহেব যখন বিশাল কনভয় নিয়ে রোড শো করছেন, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনিও কেন ভোটের লড়াইতে নামলেন?’
বিলাল আহমেদ জবাব দেন, ‘আসলে কাশ্মির হলো এমন একটা তালা, যার চাবি এখন দিল্লিতে। এই চাবি ফিরিয়ে আনতেই আমরা ভোটে লড়ছি।’
৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হওয়ার পর সাধারণ মানুষের যে দুর্দশা বেড়েছে, গরিব মানুষের ঘরে ঘরেও এক-দেড় লাখ টাকার বিদ্যুতের বিল বাকি বা তারা বাড়তি ট্যাক্স-পানির বিল দিতে হিমশিম- সে কথাও মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না পীরসাহেব।
বস্তুত দিল্লির হাত থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে এনে কাশ্মিরিদের হাতেই আবার কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে হবে- এই দাবিকে সামনে রেখে অনেকগুলো ছোটখাটো দলই এবারে ভোটের ময়দানে আছে।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইঞ্জিনিয়ার রশিদের আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টি, গুলাম নবি আজাদের ডিপিএপি, আলতাফ বুখারির আপনি পার্টি বা সাজ্জাদ গনি লোনের পিপলস কনফারেন্স।
এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দলের সাথে আঁতাত করে প্রার্থী হয়েছেন নিষিদ্ধ জামায়াত-ই-ইসলামীর জনাকয়েক নেতাও।
পিডিপি বা ন্যাশনাল কনফারেন্সের মতো পুরনো দলগুলো অবশ্য বারবার বলে যাচ্ছে, এই দলগুলোর সাথে বিজেপির গোপন সমঝোতা হয়েছে- এমনকি তাদের প্রচারের খরচও নাকি বহন করছে দিল্লিই!
গুলাম নবি আজাদের ডানহাত বলে পরিচিত, ডিপিএপির প্রধান মুখপাত্র সালমান নিজামী অবশ্য এই সব অভিযোগ নস্যাৎ করে বললেন, ‘আমরা কখনোই বিজেপির প্রক্সি নই। পিডিপি বা এনসির মতো যে সব দল আগে বিজেপির সাথে মিলে সরকার গড়েছে, তাদের মুখে অন্তত এসব অভিযোগ মানায় না।’
সালমান নিজামীর বক্তব্য হলো, নতুন নতুন দলের হয়ে বা ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে যে সব প্রার্থীরা ভোটে লড়ছেন, তাদেরকে ‘বিজেপির দালাল’ বলে চিহ্নিত না করে বরং কাশ্মিরে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের প্রয়াসকেই সম্মান জানানো উচিত।
তিনি বলেন, হুরিয়তের সর্বোচ্চ নেতা মরহুম সৈয়দ আলি শাহ গিলানিও তো এক সময় বিধায়ক ছিলেন। মূল ধারার রাজনীতি করেছেন ইয়াসিন মালিকও। এখন যিনি পাকিস্তানে গিয়ে হিজবুল মুজাহিদিনের সর্বোচ্চ নেতা, সেই সৈয়দ সালাহউদ্দিনও তো ৮৭ সালে কাশ্মিরের ভোটে লড়েছিলেন! সেই ভোটে ব্যাপক রিগিং করে কংগ্রেস আর ন্যাশনাল কনফারেন্সকে জেতানোর পরই তো ভ্যালিতে উগ্রবাদের রমরমা শুরু! তো তখন এরাও কি দিল্লির দালাল ছিলেন?’
সালমান নিজামী কথাটা তখনো পুরো শেষ করেননি। উল্টাদিক থেকে চলে এলো মেহবুবা মুফতির দল পিডিপির বিশাল কনভয়!
সাথে সাথে স্লোগান-যুদ্ধে মেতে উঠল যুযুধান দু’পক্ষ। ১০ বছর আগে মেহবুবা মুফতিও যে বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছিলেন, সেই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ তুলে ডিপিএপির কর্মীরা আওয়াজ তুলতে লাগলেন, ‘মোদি কা যো ইয়ার হ্যায়, গদ্দার হ্যায় গদ্দার হ্যায়!’
কাশ্মির ভ্যালিতে বিজেপির একটি আসনেও জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু মজার ব্যাপার হলো, সেখানে কোন দল বিজেপির কতটা বন্ধু আর কতটা শত্রু, সেই মাপকাঠিতেই কিন্তু চড়ছে নির্বাচনী উত্তেজনার পারদ!
কাশ্মিরিদের কথা
৩৭০ ধারা বিলোপের পর গত পাঁচ বছরে ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, সরাসরি এই প্রশ্নটাই করেছিলাম শ্রীনগরের পথেঘাটে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষজনকে। তারা কী উত্তর দিলেন, নিচে হুবুহু সেটাই তুলে ধরলাম।
শেখ বশির (ডাল লেকের শিকারাচালক) :
এটা ঠিকই যে পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে, ট্যুরিস্টরাও আসায় আমাদের ব্যবসাপাতিও ভালই চলছে। কিন্তু মুশকিল হল, তরুণদের হাতে কাজকর্ম নেই, চাকরি-বাকরি নেই। তারা খাবে কী? দিল্লির শাসকদের তো ছোটখাটো বিষয়গুলোতে মন দেয়ার সময় নেই ...এদিকে আমাদের ডাল লেক শুকিয়ে যাচ্ছে, মোদি রোজ ‘স্বচ্ছ ভারত স্বচ্ছ ভারত’ করে গলা ফাটান। অথচ এই গোটা এলাকায় পর্যটকদের জন্য একটা শৌচাগার পর্যন্ত নেই!
বিলাল ভাট (শ্রীনগরে একটি স্টার্ট-আপের প্রতিষ্ঠাতা) :
‘পাত্থরবাজি’যাকে বলে, মানে তরুণদের কথায় কথায় পাথর ছোঁড়ার ঘটনা কমেছে। কিন্তু তারা এখন পাথর ছেড়ে ড্রাগস ধরেছে। কাশ্মিরে এই সমস্যা আগে কখনও ছিল না, এখন কিন্তু সর্বত্র মাদকের সমস্যা ছেয়ে যাচ্ছে। উগ্রবাদের রাস্তা ছেড়ে তারা যদি ড্রাগসের রাস্তা ধরে, তাহলে আর কী লাভ হলো?
ইজাজ আহমেদ (নিরাপত্তাকর্মী) :
জম্মু ও কাশ্মির পুলিশ আমি বলব খুবই ভালো কাজ করছে। আগে কারণে অকারণে যুবকদের থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, নির্যাতন করা হতো। পিএসি (সন্ত্রাস-বিরোধী আইন) লাগিয়ে দেয়া হবে, কোনো দিন আর চাকরি-বাকরি মিলবে না, এই ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে থাকত। বাহিনীর নতুন ডিজি সাহেব এসে এগুলো বন্ধ করেছেন।
মুনাজাহ কানওয়াল (নারী সাংবাদিক, ইউটিউবার) :
অনেকদিন পরে যারা কাশ্মিরে আসছেন, তাদের চোখে অবশ্যই বেশ কিছু উন্নতি চোখে পড়বে। সরকার অনেক ভালো ভালো কাজও করেছে। শ্রীনগর এখন স্মার্ট সিটি হয়েছে, শহরের গণপরিবহনও অনেক ভালো। আমাদের যাতায়াত, যোগাযোগ সহজ হয়েছে। তবে বেকারত্ব এখনো খুব বড় একটা সমস্যা। যে কারণে কাশ্মির ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা ছাত্ররাও ড্রাই ফ্রুটস বেচতে বাধ্য হচ্ছেন!
মহম্মদ শওকত ও পরিবার (রাজৌরি থেকে শ্রীনগরে বেড়াতে এসেছেন) :
আমি তো বলব বিজেপি সরকার খুব ভালো কাজ করছে, নিশ্চিন্তে আমরা ঘুরতে পারছি, পরিস্থিতিও একেবারে শান্ত। তার স্ত্রী পাশ থেকে যোগ করেন : মোদিজি বিনা পয়সায় হেঁশেলে রান্নার গ্যাস দিচ্ছেন, বাচ্চাদের স্কুলেরও কত উন্নতি হয়েছে। আমার তো অন্তত কোনো অভিযোগ নেই!
মনজুর আহমেদ পাঠান (সেনাবাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুক) :
আমাদের গ্রাম একেবারে বর্ডার ঘেঁষে, এলওসি বা নিয়ন্ত্রণরেখার পাশেই। সেনাবাহিনীর সাথে গ্রামবাসীদের সম্পর্ক খুব ভালো, আমরা আর্মি ক্যাম্প থেকে সব ধরনের সাহায্য পাই! ফ্রি রেশন, ফ্রি মেডিক্যাল, বিপদে- আপদে আমাদের শহরে পৌঁছে দেয়া, সেনা আর কমান্ডাররা সব সময় সাহায্য করতে প্রস্তুত। তাদের প্রশংসা তো করতেই হবে!
মমিনুল মোল্লা ও লতিফ মল্লিক (কলকাতার কাছে বারাসাত থেকে আসা পর্যটক) :
এখানে আসার আগে কত কী গণ্ডগোল হতে পারে শুনেছিলাম! তারপর এখন আবার ভোট, সে সব না জেনেই টিকিট বুক করে ফেলি। এসে অবশ্য দেখছি দারুণ পরিবেশ, গুলমার্গ-সোনমার্গ-পহেলগাম সব দারুণ ঘুরে এলাম। কাশ্মির এখন সত্যিই ভূস্বর্গ, আমরা তো আবার বেড়াতে আসব।
শেখ ইরফান (হাউসবোট মালিক) :
আমাদের ডাল লেক না কি ‘হিন্দুস্তানের তাজ’ (মুকুট)- সেই লেকের আজ কী দুর্দশা! সামনের ভিআইপি রো ছেড়ে একটু পেছনে গেলেই দেখবেন দুর্গন্ধে টেকা দায়। কয়েক লাখ মানুষ লেকের বুকে বাস করেন, তাদের জন্য হাসপাতাল নেই, স্কুল নেই- দিল্লির গভর্নরের কি এসব দেখার সময় আছে? এই তল্লাটে এখন তিন-তিনটে ওয়াইন শপ খুলে গেছে, আগে একটাও ছিল না! একেই কী উন্নতি বলে?
এই ধরনের টুকরো টুকরো ছবি বা ‘স্ন্যাপশট’ থেকে অবশ্যই কোনো সুনির্দিষ্ট উপসংহারে আসা সম্ভব নয়।
তবে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে কাশ্মিরে যে নানা ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, সে কথা সবাই একবাক্যে মানছেন।
কিন্তু সে পরিবর্তন ভালোর দিকে না কি খারাপের, তা নিয়েও উপত্যকা জুড়ে খুব স্পষ্ট ও তীব্র মতভেদ আছে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা