২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

‘হিন্দুপ্রধান’ জম্মু দিয়ে বিজেপির পক্ষে ‘মুসলিম’ কাশ্মির জেতা কি সম্ভব?

শের-ই-কাশ্মির ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নরেন্দ্র মোদির জনসভা - সংগৃহীত

তখন বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা নাগাদ হবে। শ্রীনগরে শের-ই-কাশ্মির ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বিজেপির হয়ে নির্বাচনী জনসভা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবেমাত্র হেলিকপ্টারে জম্মুর উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন, রাজ্যের ক্রিকেট কর্মকর্তারা ভেতরে ঢুকে মাঠের হাল দেখে রীতিমতো গজগজ করতে শুরু করে দিলেন!

তাদের আক্ষেপের কারণ, বিজেপি কি গোটা কাশ্মিরে এই স্টেডিয়াম ছাড়া আর কোথাও জনসভা করার জায়গা পেল না? সামনের মাসেই এই মাঠে রঞ্জি ট্রফির গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হওয়ার কথা, চলছিল ট্রেনিং সেশনও ... অথচ সভার জন্য পিচ আর আউটফিল্ডে যে পরিমাণ খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে তাতে আগামী অন্তত ছ’মাস এ মাঠে কোনো খেলার আয়োজন করা যাবে কিনা সন্দেহ।

এই মাঠে এক সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও হয়েছে, চার দশক আগে এখানেই ভারতের বিরুদ্ধে ওয়ান-ডে ম্যাচ খেলে গেছে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা অ্যালান বর্ডারের অস্ট্রেলিয়া- আর সেই স্টেডিয়ামই এখন কিনা ব্যবহৃত হচ্ছে কাশ্মিরে প্রধানমন্ত্রীর জনসভার জন্য!

কারণ অবশ্য জায়গাটা চারদিক দিয়ে ঘেরা ও সুরক্ষিত, ফলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাও সোজা। কিন্তু এতে যে কাশ্মিরের ক্রিকেটে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে কর্মকর্তাদের সবাই তা নিয়ে একমত।

জম্মু ও কাশ্মির ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের এক সিনিয়র সদস্য তো বলেই ফেললেন, ‘ভ্যালিতে যে দল একটাও সিট পাবে না, তাদের এখানে এসে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে সভা করার দরকার কী বুঝি না বাপু!’

কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়- ইতিহাস বলে বিজেপি কোনো দিনই কাশ্মির উপত্যকার কোনো বিধানসভা আসনে জেতেনি।

এমনকি ‘ভ্যালি’র মোট ৪৭টি বিধানসভা আসনের মধ্যে তারা এবার মেরেকেটে প্রার্থী দিয়েছে মাত্র ১৯টিতে। আর শ্রীনগরের একটি আসন ছাড়া বিজেপি যে কোথাও সেভাবে লড়াইতেই নেই, সেটাও সবারই জানা।

এমনকি, মাস চারেক আগে ভারতে যখন সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তখন কাশ্মির উপত্যকার তিনটি আসনের কোনোটিতেই বিজেপি প্রার্থী পর্যন্ত দেয়নি।

সোজা কথায়, নির্বাচনী হিসাব-নিকেশের অঙ্কে কাশ্মির ভ্যালি তাদের জন্য একরকম ‘খরচের খাতা’তেই ধরা!

তাহলে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এত ‘ঝুঁকি’ নিয়ে শ্রীনগরে ভোটের জন্য জনসভা করতে এলেন কেন? কী বার্তা দেয়া তার লক্ষ্য ছিল?

এর উত্তর হলো, কাশ্মিরে বিজেপি কোনো আসন না-ই পেতে পারে, কিন্তু লাগোয়া জম্মুতে সবচেয়ে বেশি আসন জিতে জম্মু ও কাশ্মির বিধানসভায় এককভাবে বৃহত্তম দল তারা হতেই পারে।

সেক্ষেত্রে কাশ্মির উপত্যকার আরো ছোটখাটো কিছু দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন নিয়ে তারা সরকার গড়ার চেষ্টা চালাবে- রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এখন থেকেই সে কথা জানাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী মোদিও শ্রীনগরে গিয়ে সম্ভবত সেটাই বুঝিয়ে গেলেন যে কাশ্মিরে তাদের প্রভাব সীমিত হতে পারে, তবে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে বিজেপি খুবই সিরিয়াস!

নির্বাচনী ভূগোল
আসলে ‘ভারত শাসিত কাশ্মির’- যেটাকে ভারতে ‘জম্মু ও কাশ্মির’ নামে অভিহিত করা হয়। সেটা মূলত দুটি অংশে বিভক্ত, হিন্দু-প্রধান জম্মু ও মুসলিম-প্রধান কাশ্মির (যাকে ‘ভ্যালি’ নামেও ডাকা হয়)।

হিমালয়ের পীরপাঞ্জাল রেঞ্জ এই দুটি অঞ্চলকে মূলত পৃথক করেছে। পীরপাঞ্জালের উত্তরে ঝিলম অববাহিকার কাশ্মির, আর দক্ষিণে চেনাব বা চন্দ্রভাগা নদী-স্নাত জম্মু- মোটামুটিভাবে এটাই হলো এই অঞ্চলের ভূগোল।

ওই রাজ্যের বিধানসভায় এই দুটি অঞ্চলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকে, ফলে কাশ্মিরে সরকার কারা গড়বে সেটা স্থির হয় এই দুটি অঞ্চল মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি বিধায়ক কাদের তার ভিত্তিতে। এর আগে বৌদ্ধ-অধ্যুষিত লাদাখও এই রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল, তবে বছর পাঁচেক হলো লাদাখকে একটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

এখন জম্মু অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির প্রভাব আছে দীর্ঘকাল ধরেই, কিন্তু জম্মুর সব আসনে জিতলেও শুধু তার ভিত্তিতে পুরো রাজ্যর ক্ষমতা দখল সম্ভব নয়।

কিন্তু গত কয়েক বছরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপি এই অঞ্চলে এমন কিছু সাংবিধানিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে মনে করা হচ্ছে তাদের পক্ষে জম্মু ও কাশ্মির বিধানসভায় ক্ষমতা দখল করা একেবারে অসম্ভব নয়!

যেমন সম্প্রতি বিতর্কিত ‘ডিলিমিটেশন’ পদ্ধতির মাধ্যমে পুরো রাজ্যের আসনগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, যার ফলে জ্ম্মুতে আসন বেড়েছে ছয়টি, সে জায়গায় কাশ্মিরে আসন বেড়েছে মাত্র একটি।

গত তিনবারের মতো এবারেও জম্মু ও কাশ্মিরের ভোটে কোনো দল বা জোটই এককগরিষ্ঠতা পাবে না (‘হাং অ্যাসেম্বলি’), এটা অনেক জরিপেই আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।

সেক্ষেত্রে জম্মুর বেশিভাগ আসন জিতে ও কাশ্মিরের দু-একটি ছোটখাটো দলের সাথে সমঝোতা করে বা দরকারে অন্য দল থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে এনে বিজেপি পুরো রাজ্যেই ক্ষমতায় আসতে চাইছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছেন।

কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতি আর পাটিগণিতের দিক থেকে সেটা কি আদৌ সম্ভব?

এই প্রতিবেদনে এমনই কতগুলো ফ্যাক্টরের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে, যা এই জটিল প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে সাহায্য করতে পারে!

ডিলিমিটেশন বা আসন পুনর্বিন্যাস
জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতি বাতিল করে যখন পুরো অঞ্চলটিকে পাঁচ বছর আগে পুনর্গঠিত করা হয়, তখন থেকেই সেখানকার লোকসভা (পার্লামেন্ট) ও বিধানসভা আসনগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।

জনসংখ্যা ও ডেমোগ্রাফির সর্বশেষ তথ্যর ভিত্তিতে নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোর সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করে দরকারে আসন সংখ্যা কমানোর বা বাড়ানোর এই পদ্ধতিকেই বলে ডিলিমিটিশেন- যা একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও বটে।

কিন্তু পুনর্গঠিত জম্মু ও কাশ্মিরে যেভাবে এই ডিলিমিটেশন পদ্ধতিটি রূপায়িত হয়েছে, তা প্রথম থেকেই তীব্র বিতর্কের মুখে পড়ে।

২০২০ সালের মার্চে সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি রঞ্জনা প্রকাশ দেশাইয়ের নেতৃত্বে জম্মু ও কাশ্মিরের জন্য ডিলিমিটেশন কমিশন গঠন করা হয়।

কিন্তু কাশ্মিরের একাধিক দল অভিযোগ করতে থাকে, এই কমিশন শুধু বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই কাজ করছে!

ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাহ বলেন, এই কমিশন ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’র পরিবর্তে ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে কাজ করছে।

প্রায় সুরে সুর মিলিয়ে পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতিও মন্তব্য করেন, এই ডিলিমিটেশন কমিশন রাজ্যের মানুষকে ধর্মীয় ও আঞ্চলিক-ভিত্তিতে বিভাজিত করে দিচ্ছে।

এমনকি বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত পিপলস কনফারেন্স নেতা সাজ্জাদ গনি লোনও জানান, ডিলিমিটেশনের কাজ যেভাবে হচ্ছে তা ‘সন্দেহ উদ্রেক করতে বাধ্য’!

অবশেষে ২০২২ সালের মে মাসে যখন কমিশন তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে, দেখা যায় হিন্দু-প্রধান কাশ্মিরে আসন সংখ্যা ৩৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩টি।

আর মুসলিম-প্রধান কাশ্মিরে আসন ৪৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৭টি। ফলে জম্মুর আসন এক ধাক্কায় ছয়টি বাড়লেও কাশ্মিরের আসন বাড়ে মাত্র একটি।

তাই (২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে) রাজ্যের ৪৫ শতাংশ মানুষ যেখানে থাকেন, সেই জম্মুর ভাগে এখন পড়ছে প্রায় ৪৮ শতাংশ আসন- আর রাজ্যের ৫৫ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়েও কাশ্মির পাচ্ছে ৫২ শতাংশের মতো আসন।

ফলে এই ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া রাজ্যের প্রকৃত ডেমোগ্রাফির আনুপতিক প্রতিফলন নয়, কাশ্মিরের দলগুলো এই যুক্তিতে প্রতিবাদ জানালেও এখন এই নতুন নির্বাচনী বাস্তবতা মেনে নিয়েই কিন্তু তাদের ভোটে লড়তে হচ্ছে।

জম্মু ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেখা চৌধুরীর স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, জম্মুতে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াটা অবশ্যই বিজেপির জন্য সুবিধাজনক হবে।

তিনি বলছিলেন, ‘জম্মুতে ২০০২ সাল থেকেই বিজেপির ভোটের হার ক্রমশ বেড়েছে। সেই ধারা অব্যাহত থাকলে এই ডিলিমিটেশন তাদের জন্য বাড়তি সুবিধে বয়ে আনবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই!’

জম্মু অঞ্চলেও কিন্তু পাঁচটি জেলা আছে, যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই জেলাগুলো হলো ডোডা, পুঞ্চ, রাজৌরি, কিশতওয়ার ও রামবান।

রেখা চৌধুরী বলেন, ‘জুম্মুর এই পাঁচটি জেলাতে বিজেপি আগে তেমন সুবিধে করতে না পারলেও সম্প্রতি তাদের পারফরমেন্স গ্রাফ উন্নতি করেছে। গত নির্বাচনে তারা এখানেও ছয়টি আসন জিতেছিল, এখন আছে নতুন তিনটি আসন, ফলে সব মিলিয়ে জম্মুতে বিজেপির মোট আসন বাড়তেই পারে।’

তফসিলি উপজাতির মর্যাদা ও আসন সংরক্ষণ
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পার্লামেন্টে জম্মু ও কাশ্মিরের জন্য একটি ‘শিডিউলড ট্রাইব (এসটি) অর্ডার অ্যামেন্ডমেন্ট বিল’ পাস করে।

এতে ওই অঞ্চলের নতুন কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীকে তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতি দেয়া হয়।

নতুন আইনে পাহাড়ি, পাদাডি, কোলি ও গাড্ডা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুরা এই বিশেষ সুবিধা পান, যারা মূলত জম্মু অঞ্চলেরই বাসিন্দা।

এর কিছুদিন পরেই প্রায় ১৬ লাখ পাহাড়ি জনজাতির সংগঠন ‘জম্মু ও কাশ্মির পাহাড়ি কালচারাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ফোরাম’ রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করে, তারা বারামুলা লোকসভা আসনে সাজ্জাদ গনি লোনকে সমর্থন করবে।

বারামুলার উরি ও কারনাহের মতো এলাকায় পাহাড়িদের ভালো প্রভাব আছে, যে কারণে তাদের এই ঘোষণা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সাজ্জাদ গনি লোন এখন অনেক ইস্যুতেই বিজেপির বক্তব্যকে সমর্থন করেন, ভ্যালিতে তাকে মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই দেখা হয়।

ফলে তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতি পাওয়ার পর পাহাড়িরা যে বিজেপির দিকে ঝুঁকছে, সেই আভাস ছিল পরিষ্কার।

জম্মু ও কাশ্মিরের নতুন বিধানসভায় ৯০টি আসনের মধ্যে নয়টিকেও তফসিলি উপজাতি বা এসটিদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ফলে বিগত ভোটগুলোর চেয়ে এবারের ভোটে তাদের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি থাকবে বলেও ধরে নেয়া হচ্ছে।

তাছাড়া নতুন একটি আইনে জম্মু ও কাশ্মিরে কেন্দ্রের নিযুক্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নরকেও বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যার ফলে ৯০ সদস্যের বিধানসভায় তিনি পাঁচজন অতিরিক্ত সদস্যকেও মনোনীত করতে পারবেন, যাদের সভায় ভোটাধিকার পর্যন্ত থাকবে।

ফলে বিজেপি যদি ওই রাজ্যে একটি সংখ্যালঘু সরকারও গঠন করতে পারে, তাহলে লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহার নিযুক্ত পাঁচজন মনোনীত সদস্য তাদের আস্থা ভোটে জিতিয়ে দিতে পারবেন বলেও সম্ভাবনা থাকছে।

কাশ্মিরি গবেষক ও লেখক তৌসিফ আহমেদ এই পটভূমিতেই বলেন, ‘আসলে এমনভাবে বিজেপি একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে, যাতে কাশ্মিরে মুসলিম ইলেকটোরাল ইনফ্লূয়েন্স বা মুসলিমদের নির্বাচনি প্রভাবটা যতটা সম্ভব সঙ্কুচিত করে ফেলা যায়!’

তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, ‘এই যেমন ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে আরো বেশি সংখ্যায় আসন সৃষ্টি করা হলো, যেখানে হিন্দু ভোট নির্ণায়ক ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। কিংবা লোকসভা নির্বাচনের দু’মাস আগে নতুন আইন করে তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের নতুন নতুন পকেট বানিয়ে নির্বাচনি ল্যান্ডস্কেপ বদলে দেয়া হলো- এগুলো আসলে সবই বিজেপির সেই বৃহত্তর গেমপ্ল্যানের অংশ।’

ফলে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকার সুবাদে দেশের আইন বানানোর যে ক্ষমতা বিজেপির আছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে এখনকার কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মিরে তারা ভোটে জেতার কোনও চেষ্টাই বাদ রাখছে না বলেই শ্রীনগরে বহু পর্যবেক্ষকের অভিমত।

বিজেপির ‘মিশন কাশ্মির’
যে রাজনৈতিক ফমু‍র্লার ভিত্তিতে বিজেপি এবার রাজ্যে সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখছে, সেটাকে অনেক পর্যবেক্ষকই বিজেপির ‘মিশন কাশ্মির’ বলে বর্ণনা করছেন। আর তার অনেকগুলো পরতও আছে।

কাশ্মিরের অনন্তনাগ আসনে বিজেপির প্রার্থী ও দলের পুরনো নেতা রফিক ওয়ানি দিনকয়েক আগে দিল্লির এক গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় চমকপ্রদ এক ‘স্বীকারোক্তি’ করেছিলেন।

ভ্যালিতে একটিও আসন না পেলে বিজেপি কিভাবে রাজ্যে সরকার গড়বে, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেই ফেলেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এখানেও অনেক লোকই আসলে আমাদের।’

তারপর একে একে নাম ধরে ধরে তিনি বলতে থাকেন, ‘যেমন ধরুন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ আমাদের, আলতাফ বুখারিও তাই, সাজ্জাদ লোন তো কবে থেকেই আমাদের, গুলাম নবি আজাদও আমাদেরই!’

সোজা কথায়, বিজেপির আসন সংখ্যা কম পড়লে এই সব ছোটখাটো আঞ্চলিক দলের নেতারা বা বিভিন্ন আসনে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই তাদের উতরে দেবেন- এটাই ছিল উপত্যকায় বিজেপির এই প্রবীণ নেতার দাবি।

বারামুলার বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার রশিদ আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির প্রধান। আলতাফ বুখারির দলের নাম আপনি পার্টি, এছাড়া গুলাম নবি আজাদ ও সাজ্জাদ লোন যথাক্রমে ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেস আজাদ পার্টি ও পিপলস কনফারেন্সের সর্বোচ্চ নেতা।

সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগ তিহার জেলে আটক ইঞ্জিনিয়ার রশিদ দিনকয়েক আগে যেভাবে জামিন পেয়েছেন এবং ভোটের প্রচারে নেমেছেন, তার পেছনেও অনেকে বিজেপিরই হাত দেখছেন।

আসলে জম্মু থেকে অন্তত ৩০টির মতো আসন জিতে বিধানসভায় একক গরিষ্ঠ দল হওয়া এবং তারপর কাশ্মিরের ছোট আঞ্চলিক দলগুলো ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সহায়তায় সরকার গঠন, এটাকেই এই নির্বাচনে বিজেপির ‘ব্লু প্রিন্ট’ বলে অভিহিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সেফোলজিস্ট অমিতাভ তিওয়ারি।

তবে কাশ্মির ভ্যালিতে ছোটখাটো আঞ্চলিক দলগুলিকে সফল হতে হলে ও বেশ কয়েকটি আসন জিততে হলে উপত্যকার পুরনো বা প্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে তুলনায় খারাপ ফল করতে হবে। বিজেপির সরকার গড়ার ফমু‍র্লা বা ‘মিশন কাশ্মির’ সফল হওয়ার এটাও অন্যতম প্রধান শর্ত!

এই কারণেই শ্রীনগরে বা জম্মুর কাটরায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদিও লাগাতার ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছেন।

এদের সাথে কংগ্রেসকেও জুড়ে নিয়ে তিনি বলছেন, ‘এই তিনটে খানদান বা পরিবারই কাশ্মিরকে বছরের পর বছর ধরে লুটে চলেছে। কিন্তু এবার তাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা আসার পালা!’

১০ বছর আগে বিজেপি যখন প্রথমবারের মতো জম্মু ও কাশ্মির সরকারের শরিক হয়েছিল, তারা কিন্তু ক্ষমতায় এসেছিল মুফতি পরিবারের নেতৃত্বাধীন পিডিপির হাত ধরেই।

তবে সেই সরকারে তারা ছিল ছোট শরিক বা জুনিয়র পার্টনার, পেয়েছিল উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ। কিন্তু এবারে তারা চাইছে ‘সিনিয়র পার্টনার’ হিসেবে ক্ষমতায় যেতে।

ভারতে এই মুহূর্তে মোট ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আছে, যার মধ্যে ক্ষুদ্র লাক্ষাদ্বীপ ছাড়া একমাত্র মুসলিম-প্রধান অঞ্চল হল জম্মু ও কাশ্মির।

আগামী মাসে সত্যিই যদি কোনো বিজেপি নেতা শ্রীনগরে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তবে তা হবে মুসলিম-প্রধান কাশ্মিরের জন্য সত্যিই এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

কিন্তু বিজেপির জন্য সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর রাস্তা যাবে হিন্দুপ্রধান জম্মুর ভেতরে দিয়েই!
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement