মুসলিম বিশ্বে আখলাকি সঙ্কটের স্বরূপ
- মুসা আল হাফিজ
- ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:১৮
আখলাকি সঙ্কট মুসলিম দুনিয়ার মর্মমূলে গভীর ও বহুবিস্তারি ক্ষত ও পচন তৈরি করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় যেমন তা প্রতিফলিত, তেমনি সামাজিক চ্যালেঞ্জ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সমস্যাতেও তা পরিব্যাপ্ত।
সমস্যাটা বহুমুখী। এর আওতায় আছে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মাত্রা। মুসলিম উম্মাহের নানা অংশের বৈচিত্র্য এবং এর সাথে জড়িত জটিলতাগুলো এই সঙ্কটকে বিশেষ আকার দিয়েছে। সংবেদনশীলতার গভীর স্থরে তা প্রভাব বিস্তার করেছে।
কোনো কোনো দেশে শাসন ও মানবাধিকার আখলাকশূন্যতায় ভুগছে কিংবা আখলাকের দারিদ্র্যে মৃতপ্রায়। কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব ব্যাপক অন্যায় ও নিপীড়নকে স্থায়ী বাস্তবতায় পরিণত করতে প্রয়াসী। যা সমাজের নৈতিক কাঠামোকে ক্ষুণ্ণ করছে।
নৈতিক সঙ্কটের বড় এক বিষয় হলো, ইসলামী শিক্ষার ব্যাখ্যা এবং সমসাময়িক সমাজে তাদের প্রয়োগ। ইসলাম উপলব্ধির প্রান্তিক ধারা ও চর্চাগুলো সমাজের মনস্তত্ত্ব শাসন করছে এবং ইসলাম প্রায়ই খণ্ডিত বা বিকৃত বয়ানে ও অনুশীলনে উপস্থিত হয়। এর সাথে যুক্ত থাকে গতিহীনতা ও দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার দীর্ঘ ধারাবাহিকতা। বিভিন্ন গোষ্ঠীর অভ্যস্ত অনুশীলনের ফলে যে বাস্তবতা নিজেদের মনে ও আচরণে স্থির হয়ে আছে, তাকে ইসলাম হিসেবে জাহির ও কায়েম করার জবরদস্তি একধরনের নিয়মে পরিণত হয়েছে। যা আখলাকি সঙ্কটের ভয়াবহতা বাড়িয়ে চলছে।
তা এক দিকে বাধা দিচ্ছে বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতাকে, অন্য দিকে বিচ্ছিন্নতা ও মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মধ্যে উত্তেজনা এবং দ্বন্দ্বের আগুন বাড়িয়ে চলছে।
মুসলিম দুনিয়ার বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। সুবিধা ও অধিকারের জায়গায় তাদের এক্সেস চরমভাবে সঙ্কুচিত, যা সামাজিক সমস্যাগুলো বাড়িয়ে তুলছে। এটি এক দিকে নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে ঘটছে, অন্য দিকে নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য শুধু রাজনৈতিক সংস্কার নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার প্রসারের প্রয়োজন ছিল; কিন্তু এর কোনোটিই কাক্সিক্ষত মানে নেই।
চারিত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার দুর্গতি এবং মানবীয় গুণাবলির তীব্র অভাব এখানে ইসলামের প্রান্তিকীকরণের ফলে ভয়াবহ রূপ নিতে পেরেছে। সেক্যুলারিজম শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতি থেকে ইসলামের অবস্থান ও ভূমিকাকে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ ও বিতাড়নের চেষ্টা করেছে। ইসলামকে ব্যক্তিক পরিসরের সবচেয়ে ক্ষুদ্র কারাগারে বন্দী করার জন্য যুদ্ধ করছে এবং মানবমনে তার প্রভাবকেও ক্রিয়াহীন বানানোর পথ সন্ধান করেছে। এর সাথে প্রবলভাবে যুক্ত হয়েছে উপনিবেশবাহিত সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্তি¡ক, জ্ঞানীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। বিশ্বায়ন ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবের প্রেক্ষিতে যা এসব ক্ষেত্রে পশ্চিমা আগ্রাসনকে সর্বব্যাপী করেছে। এর ফলে নৈতিক দূষণ মুসলিম দুনিয়াকে গভীরভাবে কলুষিত করতে পারছে।
মুসলিম দুনিয়ায় আখলাকি সঙ্কটের কারণগুলোকে আমরা দুই স্তরে করতে পারি- ১. Cause of cause বা কারণের কারণ। ২. common cause বা সাধারণ কারণ।
দ্বিতীয় স্তরে আমরা নানা রকমের কারণ দেখতে পাবো। সেগুলো প্রথমত জন্ম নিয়েছে প্রথম স্তরের কারণ থেকে। সেগুলো প্রধানত- ১. দ্বীন ও আখলাকের পারস্পরিক ঐক্য সত্ত্বেও আমরা তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। এই ফাটলরেখা থেকে আখলাকি সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নেয়।
২. কুরআনের মুখ্য প্রবণতার মধ্যে আমরা ইবাদত ও আহকামাতকে অবলোকন করলেও আখলাককে তার কেন্দ্রে আমরা সাধারণত দেখি না বা দেখাই না। এর ফলে আখলাকের প্রতি উচিত মনোযোগ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং জোরদানের সামাজিক মন তৈরি হয় না।
৩. সিরাতে রাসূল সা: হাদিসের ভাণ্ডারে আমাদের দৃষ্টি আহকামাত ও ইবাদত দেখতে পায়। কিন্তু সেখানে কত বিপুল ও ব্যাপকভাবে আখলাকের শিক্ষা প্রতিনিয়ত আমাদের কিসের আহ্বান জানাচ্ছে, তার প্রতি আমাদের মনোযোগ নিতান্তই কম।
৪. দ্বীনের মধ্যে আখলাকের অবস্থানকে আমরা ভুল বুঝি। ইবাদত, তাকওয়া ও তাজকিয়ার উদ্দেশ্যের সাথে আখলাকের সম্পর্ক স্পষ্ট না থাকায় আমরা একে দ্বীনের কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ করি না।
৫. মানুষের ফিতরাতের স্বরূপ কিভাবে আখলাককে কামনা করে এবং মানুষের জীবনের উদ্দশ্যের সাথে কিভাবে আখলাক যুক্ত, তা যেমন আমাদের তত্ত¡ ও চর্চায় অস্পষ্ট, তেমনি আমাদের বৃহত্তর সাফল্যের কেন্দ্রে আখলাক কিভাবে শর্ত ও ভিত্তি হিসেবে হাজির, তাও আমাদের বোধে ও আচরণে গরহাজির।
৬. আল্লাহর ইরাদা একই সাথে আমাদের খালক বা দেহগত গঠন এবং খুলুক বা আখলাকি গঠনের বিকাশ চায়। সেই বিকাশ হবে আশরাফুল মাখলুকাতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। মানুষের খালককে তিনি আহসানে তাকবিম বা সর্বোত্তম অবয়ব হিসেবে জানিয়ে দিয়েছেন, আর খুলুকের পরিশুদ্ধির জন্য উসওয়াতুন হাসানাহ হিসেবে নবীজী সা:-কে উপস্থাপন করেছেন। ফলে খালকের (দেহজাত) বিকাশ মানুষ হিসেবে যথেষ্ট নয়, খুলুক (আখালাকি) বিকাশ এ জন্য জরুরি।
৭. ব্যক্তি মানুষের জন্য যেমন আখলাকি বিকাশ জরুরি, বৃহত্তর সমাজ-মানুষের ও সামষ্ঠিক সত্তারও আখলাকের বিনির্মাণ জরুরি। তা না হলে দ্বীন যে সমাজ কামনা করে, তা প্রতিষ্ঠিত হয় না। অন্য কোনো উপাদানই আখলাকি অধঃপতনের প্রতিকার নয়। আখলাকের দুর্বলতার একমাত্র প্রতিকার আখলাকি সবলতা নিশ্চিত করা। যা না হলে সভ্যতা ও সংস্কৃতি হিসেবে আপন অবয়বে দাঁড়ানো যাবে না।
আমরা যদি সাধারণ অর্থে আখলাকি সঙ্কটের ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করতে চাই, তাহলে তাকে এভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে :
১. পশ্চিমা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং নিয়মের সাম্রাজ্যবাদী বিস্তার মুসলিম দুনিয়ার ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং স্বকীয়তাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। যা রাজনীতিতে যেমন ম্যাকিয়াভেলিয়ান প্রবণতাকে প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি অর্থনীতিতে স্বার্থসর্বস্বতা, জীবনদৃষ্টিতে ভোগবাদ এবং নৈতিক বিচারে উপযোগবাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি আখলাকি বিনষ্টিকে ভয়াবহতা দিয়েছে।
২. সম্পদ এবং আয় বণ্টনের বৈষম্য সামাজিক উত্তেজনাকে ভয়াবহ করে তোলে এবং এর বহুমুখী ক্ষতিকর প্রভাব চারিত্রিক বাস্তবতাকে প্রভাবিত করে।
৩. স্বৈরাচারী শাসনের কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। কুশাসন, ইনসাফ, জবাবদিহি ও প্রতিনিধিত্বের অভাব।
৪. ধর্মের প্রান্তিকীকরণ; এক দিকে চরমপন্থা, অপর দিকে ধর্মের পরিসর সঙ্কোচিত করার নানা প্রয়াস।
৫. উম্মাহর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব।
৬. আল্লাহর হকগুলোর তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক লঙ্ঘন।
৭. মানুষ ও অন্যান্য প্রাণ-প্রকৃতির হকসমূহের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক লঙ্ঘন।
৮. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য।
৯. বেকারত্ব, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে।
১০. মানসম্মত ও যথার্থ শিক্ষার অভাব, শিক্ষার অবারিত সুযোগের অভাব।
১১. নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইসলামের দ্বারা নির্ধারিত নয়।
১২. অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো।
১৩. খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টি।
১৪. পানির অভাব ও পরিবেশের অবনতি।
১৫. অপর্যাপ্ত রাস্তা ও গণপরিবহনসহ অবকাঠামোগত ঘাটতি।
১৬. নৈতিক-আদর্শিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধের গঠন ও বিকাশে অপর্যাপ্ত মেধা, কর্মকৌশল ও অর্থবিনিয়োগ।
১৭. রাজনৈতিক মেরুকরণ ও জাতীয় ঐক্যের অভাব।
১৮. মসলকি দ্ব›দ্ব, আঞ্চলিক সঙ্ঘাত এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা।
১৯. উদ্বাস্তু সঙ্কট এবং জনসংখ্যার বাস্তুচ্যুতি।
২০. অকার্যকর বা দুর্নীতিগ্রস্ত বিচার ব্যবস্থা।
২১. সেন্সরশিপ এবং প্রকৃত সত্য ও তথ্যের ওপর বিধিনিষেধ।
২২. মিডিয়ার পক্ষপাতিত্ব ও অপপ্রচার।
২৩. ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সংলাপের পরিবেশের বিনাশ এবং চারিত্রিক নীতিমালার উসুলের অনুশীলনহীনতা।
২৪. আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন, যৌন বিকৃতির বিস্তার, পারিবারিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হতে থাকা।
২৫. সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছ ও যথাযথ সম্পর্কের অভাব ও দূরত্ব এবং সহযোগিতার সঠিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতি।
২৬. অপর্যাপ্ত তালিম-তারবিয়ত ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি, ব্যাপক অপরাধ ও সংগঠিত অপরাধ নেটওয়ার্ক।
২৭. ব্যাপক দুর্নীতি, অস্থিতিশীল মুদ্রা, মুদ্রাস্ফীতির চাপ, বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা এবং সরকারি ঋণ এবং রাজস্ব অব্যবস্থাপনা, সামাজিক কাঠামোকে যা নষ্ট করে।
২৮. ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার অনেক মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জটিলতার এমন চক্রে ফেলে দিয়েছে, যেখান থেকে তাদের মুক্তি ঘটেনি।
২৯. মুসলিম দেশ ও সমাজগুলোতে বহিরাগত হস্তক্ষেপ বহুমুখী জটিলতা তৈরি করে, যা উত্তেজনাকর, সংঘর্ষ ও অস্থিতিশীলতার চক্রকে স্থায়ী করে।
৩০. দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন এবং বিশ্বায়নের ফলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষয় হয়েছে এবং মূল্যবোধ ও বিশ্বাস থেকে পরবর্তী প্রজন্মের বিচ্ছিন্নতা ঘটছে। সামাজিক বিভক্তি এবং অনৈক্য মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্মিলিত শক্তিকে দুর্বল করে এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে।
৩১. ধর্মীয় শিক্ষার অভাব যেমন লক্ষণীয়, তেমনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জীবনবিমুখতা এবং বিতর্ক ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতি আস্থা নষ্ট করে।
৩২. মিডিয়া ম্যানিপুলেশন : পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া কভারেজ মুসলিম সমাজ সম্পর্কে নেতিবাচক স্টিরিওটাইপকে স্থায়ী করে এবং মুসলিম সমাজের মধ্যে বিভাজন বৃদ্ধি করে।
এমন আরো সমস্যা আছে। যেমন- সোস্যাল মিডিয়ার প্রভাব, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি গুরুতর সমস্যা হিসেবে সামনে রয়েছে।
এমতাবস্থায় চারিত্রিক সঙ্কটের তীব্র তরঙ্গ আমাদের জীবনবাস্তবতাকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। চরিত্রের রূপ ও প্রকৃতি বদলাচ্ছে ব্যাপকভাবে। চরিত্রের এই পরিবর্তনমুখী বাস্তবতাকে ইসলাম অধ্যয়ন করে এবং এর ইতিবাচক রূপান্তরের পথকে হাজির করে।
ইমাম গাযালি রহ. লিখেন, চরিত্র পরিবর্তনশীল। যদি চরিত্রে পরিবর্তন না হতো, তবে উপদেশ, মোটিভেশন, শাসন ইত্যাদি সবই পণ্ডশ্রম হতো এবং রাসূলুল্লাহ সা: কেন বলতেন যে, ‘তোমরা তোমাদের চরিত্র সুন্দর করো।’ মানুষের মধ্যে চরিত্রের পরিবর্তন তো ঘটেই, এমনকি এই পরিবর্তন পশু-পাখির মধ্যেও সম্ভব। যেমন বাজপাখির শিকারি ও ঊর্র্ধ্বচারী স্বভাব মানুষের সাথে মেশার কারণে বদলে যায়। প্রশিক্ষণের কারণে শিকারি কুকুর কতই না সুশিক্ষিত হয়ে যায়। সে শিকার ধরে, কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে তা আহার করে না। ...যখন চেষ্টা-সাধনায় পশু-পাখির ভেতর পরিবর্তন আসে, তখন মানুষের স্বভাব-চরিত্রে পরিবর্তন আসা অসম্ভব নয়। মানবপ্রকৃতি ও স্বভাবের মূলোৎপাটন করা আমাদের সাধ্যাতীত। কিন্তু এগুলোকে দমন করা এবং অধ্যবসায় ও সাধনা দ্বারা বশে রাখা সম্ভব। আমাদের প্রতি এরই আদেশ করা হয়েছে। এই চেষ্টা জারি রাখা আমাদের মুক্তি ও আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার উপায়।’ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/২৪৭)
তাহলে আমাদের করণীয় পরিষ্কার। চরিত্রের পরিবর্তনশীল বাস্তবতার কারণে তাকে যেভাবে নেতিবাচক দিক থেকে পরিবর্তিত করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি ইতিবাচক দিকেও এর মোড় ঘোরানো যায় এবং এ পথে তার বিকাশ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়। এ জন্য ইসলামের আলোকে আখলাকের বিনির্মাণের রূপকল্পকে অবলম্বন করতে হবে। এই রূপকল্পের মূলে আছে ইসলামী আখলাকি ব্যবস্থাপনার দর্শন। যার দাবি হলো- মানুষের জীবসুলভ (হায়ওয়ানি) সত্তার ওপর মানবীয় (ইনসানি) সত্তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। এটি ঘটবে মানবিক গুণাবলির বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে। এই বিকাশ নিশ্চিত হবে মানুষের তিনটি বৈশিষ্ট ধারাকে বিকশিত, পরিপুষ্ট করা এবং প্রাধান্যদানের মধ্য দিয়ে। সেগুলো হচ্ছে :
১. বাশারিয়্যাত : যা মানবসৃষ্টির প্রথম ধাপ। এই ধাপে দেহ ও দেহগঠনের উপাদান হাজির থাকে। মানুষের মানবাকৃতি ও সেই আকার গঠনের আদি উপাদানগুলো এবং মানবচরিত্রে তার প্রভাব এই ধাপের লক্ষ্যণীয় বিষয়।
২. আদামিয়্যাত : এটি দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপে আল্লাহর তরফে নাফখে রুহ বা রুহ ফুঁকে দেয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহর খলিফা হওয়ার যোগ্য হয়। বাশার থেকে সে আদমে রূপান্তরিত হয়।
৩. ইনসানিয়্যাত : এটি হচ্ছে তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপ। যেখানে মানুষ আল্লাহর আদেশ-নিষেধের অনুবর্তী হওয়ার জন্য তাকলিফ (সামর্থ্য) অর্জন করে। বিবেক, মূল্যবোধ, বিবেচনাশক্তি ও ভালো-মন্দ যাচাইয়ের সহজাত সক্ষমতায় ঋদ্ধ হয়। মানবসুলভ ফিতরাত বা প্রকৃতি দ্বারা সজ্জিত হয়। এই ফিতরাত তার মানসজগতে ভালোর অবকাঠামো দেয়, যার সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ হলো ইসলাম।
এই তিন ধাপই আখলাকের বিকাশের মাধ্যমে জগতে ক্রিয়াশীল হয়। আখলাক বিনষ্ট হলে বাশারিয়্যাতের ভেতর থেকে লোভ, ক্রোধ, মিথ্যা, প্রতারণা, কাম, ঋপুসেবা ইত্যাদির দাপটে জীবন বিপন্ন হয়। দ্বিতীয় ধাপে আখলাক বিনষ্ট হলে জীবনের উদ্দেশ্য, দায়িত্ব, লক্ষ্য, করণীয় ও গন্তব্য সম্পর্কে মানুষ চরম অন্ধকারে ডুবে যায়। খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব) ও আবদিয়্যতের (দাসত্ব) দায়িত্ব থেকে বিমুখ হয়ে থাকে। তৃতীয় পর্যায়ে আখলাক বিনষ্ট হলে মানুষ ভালো-মন্দের বোধ হারিয়ে বুদ্ধিমান পশুতে পরিণত হয়। তার মধ্যে ফিতরাতের (প্রকৃতির) মৃত্যুদশা ঘটে, আর খাহেশাত (প্রবৃত্তির ) রাজত্ব চলতে থাকে। সে হায়ওয়ানি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
এই ধারায় সে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে অজস্র বিনষ্টি, দূষণ ও সর্বনাশের জন্ম দেয়। যার কবলে পিষ্ট হচ্ছে আজকের পৃথিবী। মুসলিম দুনিয়াও ভয়াবহভাবে এর শিকার ।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামের আখলাকি দর্শন ও আখলাকি নেজামের (ব্যবস্থাপনা) পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বৃহত্তর, বহুমুখী ও বহুস্তরী কর্মপ্রয়াসের বিকল্প নেই।
লেখক : কবি, গবেষক
72.alhafij@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা