২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সুশাসন

সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন

সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তার নামে পরিচালিত হয়েছিল। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের ইতঃপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদনের কথা ব্যক্ত করা হলেও তিনি কবে, কখন এবং কোথা থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তার উল্লেখ নেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। পরবর্তী দিন ১১ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে উদ্ভূত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করেন। অস্থায়ী সংবিধানের মাধ্যমে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ থেকে নির্বাচিত সদস্য সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। গণপরিষদ গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন। গণপরিষদ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সংবিধান রচনা করে যা ৪ নভেম্বর ১৯৭২ গণপরিষদে গৃহীত হয়। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।
স্বাধীনতা-উত্তর দীর্ঘ প্রায় ৫৩ বছরের পথচলায় সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়। এসব সংশোধনীর অধিকাংশ সংশোধনী আনার সময় যারা ক্ষমতাসীন ছিল তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে কার্যকর করা হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নকালীন শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। সংবিধান প্রণয়নকালীন শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হবেন সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে এককভাবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রী একাধারে মেয়াদের সীমাবদ্ধতা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় দলের নেতা এবং দলের প্রধান ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে একদলীয় বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করে প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। সংশোধনীটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদে দ্বাদশ সংশোধনী অবধি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের বিধান বহাল থাকাবস্থায় পদের মেয়াদের বিষয়টি অবারিত ছিল।

দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমঝোতার ভিত্তিতে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ প্রণীত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় প্রবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীকে বাহাত্তরের সংবিধানে প্রদত্ত অনুরূপ ক্ষমতা দেয়া হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার বিধান ছিল। পদটি আলঙ্কারিক হওয়া সত্ত্বেও একজন ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকার অযোগ্য করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে কে তার দায়িত্ব পালন করবেন; সে বিষয়ে বাহাত্তরের সংবিধান যেমন নিশ্চুপ ঠিক তেমন সংবিধানের চতুর্থ ও দ্বাদশ সংশোধনী দ্বারা যথাক্রমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করা হলেও এ বিষয়ে কোনো বিধান করা হয়নি। এটি সংবিধানের এক ধরনের সীমাবদ্ধতা। রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের ক্ষেত্রে এ সীমাবদ্ধতা নেই।

বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিতে রচিত। সংবিধান রচনাকালে জনগণের যে অভিপ্রায় ছিল এর চার যুগেরও বেশি সময় পর সে অভিপ্রায় যে ভিন্নতর হবে এ প্রশ্নে কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। সংবিধান অন্যান্য আইনের মতো একটি আইন হলেও অন্যান্য আইনের তুলনায় এর অবস্থান উচ্চে। পৃথিবীর সর্বত্র সমাজ গতিশীল। গতিশীল সমাজে সংবিধান বা আইন স্থবির হলে সে সংবিধান বা আইন সময় ও যুগের চাহিদা মেটাতে পারে না। আর তাই সময় ও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে জনআকাক্সক্ষা পূরণে সংবিধান বা আইনের সংশোধন বা ক্ষেত্রবিশেষে নতুন সংবিধান বা আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দেয়।
অভ্যুদ্বয়-পরবর্তী এ যাবৎকাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পাঁচবার অসাংবিধানিক শাসনের কবলে পড়ে। প্রথম ও দ্বিতীয়বারের অসাংবিধানিক শাসক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ সামরিক ফরমানবলে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনাকালীন সংবিধান স্থগিত করে ধাপে ধাপে আংশিক পুনর্জীবিত করেন। তারা উভয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালীন রাজনৈতিক দল গঠনপূর্বক যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিতের মাধ্যমে যথাক্রমে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী দ্বারা তাদের অসাংবিধানিক শাসনকে বৈধতা দান করেন।

গণ-অভ্যুত্থান বা সামরিক অভ্যুত্থান- উভয় ক্ষেত্রে সংবিধান স্থগিত বা রহিত করা হলে ফরমান বা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা পরিচালিত হয়। গণ-অভ্যুত্থান বা সামরিক অভ্যুত্থানে পেছনের জনসমর্থন থেকে ফরমান বা ঘোষণাপত্রের ক্ষমতা উদ্ভূত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ১০ এপ্রিল ১০৭১ যে ফরমান বা ঘোষণাপত্র জারি করা হয় তাতে উল্লেখ ছিল- বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তারা গণপরিষদ গঠন করলেন। অতঃপর ১১ জানুয়ারি ১০৭২ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক যে অস্থায়ী সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হতো তার ভিত্তি ছিল ১০ এপ্রিল ১০৭১ সালের স্বাধীনতার ফরমান বা ঘোষণাপত্র। পরবর্তীতে গণপরিষদ কর্তৃক ৪ নভেম্বর ১০৭২ সংবিধান গৃহীত হয় এবং একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকরের মধ্য দিয়ে অস্থায়ী সংবিধান রহিত করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সময়কালে সামরিক শাসন কার্যকর থাকাকালীন উভয় ক্ষেত্রে সামরিক শাসন কার্যকর হওয়ার দিবস হতে সংবিধান স্থগিত ছিল।। এটিকে ধাপে ধাপে পুনর্জীবিত করা হয়। উভয় সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে ফরমান বা ঘোষণাপত্র থেকে উদ্ভূত ক্ষমতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয়।

তৃতীয় অসাংবিধানিক শাসক কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এরশাদের পদত্যাগ-পরবর্তী জনআকাক্সক্ষায় তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রের শাসনকার্য গ্রহণ করায় সংবিধান স্থগিতের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হলেও সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমর্থনে সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তার অস্থায়ী সরকারের কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়া হয়।

চতুর্থ অসাংবিধানিক শাসনকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান বহাল রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এই সরকার সংবিধানের কোনো বিধিবিধানের আলোকে গঠিত হয়নি। এ সরকারটি সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের আন্দোলনের ফসল এবং তিনি সরকারটির কার্যকলাপকে বৈধতা দান করবেন মর্মে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে তিনি অবস্থান থেকে বিচ্যুত হন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় দলটির পক্ষে এ সরকারটির কার্যকলাপকে সাংবিধানিক বৈধতাদানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা ছিল না। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে পথে না গিয়ে উচ্চাদালতের আপিল বিভাগের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল বিষয়ক রিট মামলার আপিলের রায়ে তৎকালীন ১৯তম প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের মাধ্যমে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার অবতারণায় এ সরকারকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস নেন। সংসদীয় বৈধতার অনুপস্থিতিতে এ ধরনের বৈধতা আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিক বৈধতা না পাওয়ায় এর অধীন অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনও অবৈধ এবং তদধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সংবিধান ও আইন উভয়ের আলোকে অবৈধ।

ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ লাভ করলে দীর্ঘদিন অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে বিপুল প্রাণহানির পর ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হলে জনআকাক্সক্ষায় নোবেলবিজয়ী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি অন্তর্বর্তী সরকারের আগমন ঘটে। এ ধরনের অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ দীর্ঘ অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুঃশাসন নিবারণে রাষ্ট্র মেরামতের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জনআকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন।

আমাদের বর্তমান সংবিধান থেকে জনআকাক্সক্ষায় প্রবর্তিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল এবং জনআকাক্সক্ষার বিপরীতে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর সন্নিবেশন সংবিধানকে একটি দলের অবৈধ ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার দলিলে পরিণত করেছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কালানুক্রমিক অবৈধ সরকারের অবসানে জনআকাক্সক্ষায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এটি আইনানুগ ও বাস্তবানুগ নয় কথাটি বলার অবকাশ ক্ষীণ। এর পরও প্রশ্ন জাগে এ সরকারের কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়ার পদ্ধতি কী হবে।

সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত অনুচ্ছেদ ৭ক, ৭খ এবং সংশোধিত অনুচ্ছেদ ১৫০ এর বিধানাবলি পর্যালোচনায় স্পষ্ট প্রতিভাত যে, প্রথমত সংবিধান রদ, রহিত, বাতিল বা স্থগিত বা সংবিধানের নির্দেশনার ব্যত্যয়ে পরিচালিত যেকোনো কাজ রাষ্ট্রদ্রোহসম অপরাধ এবং প্রচলিত আইনের নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডনীয়; দ্বিতীয়ত, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য। তৃতীয়ত, যেকোনো অসাংবিধানিক শাসনকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে সন্নিবেশনের মাধ্যমে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে অনুচ্ছেদ ১৫০ এর বিধানাবলির আলোকে সংশোধনের পথ রুদ্ধ।
আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী এককভাবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য না থাকায়, সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট না হওয়ায় উচ্চকক্ষে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী পদধারীর মেয়াদহীন একচ্ছত্র স্বেচ্ছাচারী শাসকে পরিণত হওয়ার সব দ্বার উন্মোচিত থাকায় বিদ্যমান সংবিধানটির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন : পরিবর্তনটি কোন পথে- সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নাকি পুনর্লিখনের মাধ্যমে?

সংবিধান সংশোধন অথবা পুনর্লিখন যে মাধ্যমে পরিবর্তনের সূচনা করা হোক না কেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দু’টি পথ খোলা রয়েছে। এর একটি হলো- রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ যে পথে অগ্রসর হয়ে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে তাদের শাসনকালকে বৈধতা দিয়েছিলেন তার অনুসরণ, যদিও তা সামরিক আইন জারি ছাড়াই সম্ভব। অন্যটি হলো- সংবিধান পুনর্লিখনের মাধ্যমে। শেষোক্তটির ক্ষেত্রে গণপরিষদ গঠনের আবশ্যকতা দেখা দেবে এবং সে ক্ষেত্রে কাদের নিয়ে বা কিভাবে গণপরিষদ গঠিত হবে সেটি একটি জটিল প্রশ্ন। জটিল প্রশ্নটি সুরাহার ক্ষেত্রে আইন কমিশনে সংবিধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এর পরিধি বিস্তৃতকরত সংবিধানের সংশোধন বা পুনর্লিখনের প্রাথমিক কাজটি করা যেতে পারে; তবে উভয়ক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে উপনীত হয়ে জাতীয় সংসদ বা গণপরিষদ নির্বাচন-পরবর্তী সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সাংবিধানিক অনুমোদন বা সংবিধান গৃহীত হওয়ার কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। সুতরাং বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তারা সংবিধান স্থগিত করে ফরমান বা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে নাকি বহাল রেখে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করবেন একান্তভাবে এটি তাদের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার বিপ্লব থেকে উদ্ভূত জনআকাক্সক্ষা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার উৎস।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement