সংস্কার ও ষড়যন্ত্র এখনো সমান্তরালেই
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৪
প্রায় ১৬ বছর অব্যাহতভাবে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছিল। আজীবন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার যাবতীয় নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা নিজে এবং তার দল দিনরাত কাজ করেছে। নিজের ষড়যন্ত্র ঢাকতে তিনি ও তার লেসপেন্সাররা সারাক্ষণ উচ্চকণ্ঠ ছিলেন এই বয়ান নিয়ে যে, তার সরকারের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জঙ্গিনাটক সাজানোসহ সিরিজের পর সিরিজ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে।
তাদের এসব বয়ান সত্য থেকে বহু দূরে ছিল বলে কোনো ফল দেয়নি। জনগণ এই অভিযোগ শুধু উপেক্ষা করেনি, ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু তার ও তার অলিগার্কদের বিরামহীন প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল বটে; তবে এ সময়ে দেশকে অপরিসীম মূল্য গুনতে হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে টেলে দেয়া হয়েছে। দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিকসহ সব মৌলিক মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে, এ জনপদের মানুষের চিরায়ত নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধকে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। দেশের টাকা লুটপাট, পাচার ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়ে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সেই শেখ হাসিনা ও তার দলের পতন ঘটেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের জাতিবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত এখনো ভাঙেনি। নানা রূপে নানা রঙ্গে ঢঙ্গে ষড়যন্ত্র ফিরে আসছে।
পতিত সেই সরকারের নেত্রী এবং তার দলের অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। আত্মগোপনে আছেন। কিন্তু তারা বসে নেই; বিরামহীনভাবে দেশ ধ্বংসের চক্রান্ত তাদের মন-মগজে ঘুরছে। সেই নেত্রী যখন তার স্বনির্বাসন শেষে দেশে পা রেখেছিলেন তখন তিনি প্রকাশ্যেই দেশ ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে কারণে তাকে দেশ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারীর তকমা দেয়া ভুল হবে না।
১৯৮১ সালে দেশে ফেরার সাথে সাথেই তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করেন। হয়তো সেই ষড়যন্ত্রের প্রথম শিকার হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনা স্বনির্বাসন থেকে দেশে ফেরার মাত্র ক’দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শাহাদতবরণ করেন। কেউ কেউ একে কাকতলীয় ঘটনা মনে করেন। সেটি ভাবার স্বাধীনতা তাদের আছে। তবে, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা লন্ডন গেলে বিবিসি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। তখন শেখ হাসিনা সবেমাত্র আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। বিবিসি তাকে প্রশ্ন করেছিল- দলনেত্রী হয়ে আপনার কি ভালো লাগছে? তার উত্তর ছিল- ‘না মোটেও ভালো লাগছে না। আমি রাজনীতিকে ঘৃণা করি।’ প্রশ্নকারী বিস্মিত হয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনি কেন রাজনীতিতে এলেন, কেন দলনেত্রী হতে গেলেন? শেখ হাসিনা ক্রুদ্ধ হয়ে উত্তর দেন, ‘ওরা আমার বাবাকে খুন করেছে, আমার মাকে খুন করেছে, আমার ভাইদের খুন করেছে, তাদের জন্য কেউ একফোঁটা চোখের পানি ফেলেনি। আমি তার প্রতিশোধ নেবো। প্রতিশোধ নেবো বলেই রাজনীতিতে এসেছি।’ এটাই হচ্ছে তার দেশ ধ্বংসের অন্যতম স্বীকৃতি।
এই প্রতিশোধ নিতেই তিনি দেশের বহু মানুষকে গুম-খুন করিয়েছেন।
তার সেই প্রতিশোধস্পৃহা এতটা ভয়ঙ্কর ছিল যে, দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার পরও বিদেশের মাটিতে বসে তিনি এখনো ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছেন। সেখান থেকে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের যত পরিকল্পনা দিয়ে তার উচ্ছিষ্টভোগীদের দ্বারা সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ফলেই দেখা যায় রাজধানীসহ সারা দেশে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা একের পর এক ঘটছে। এসব ঘটিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা হয়তো উদ্দেশ্য। সরকারের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটানো এবং তাদের মনোযোগ বিনষ্ট করা। এ অবস্থায় আগস্ট বিপ্লবের সব সৈনিক, সহযোগী, সহায়তাকারী ও শুভাকাক্সক্ষীদের এখন সতর্ক থাকতে হবে বলে বিভিন্ন মহল মনে করে। বিপ্লববিরোধী সব তৎপরতার যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
সে ব্যবস্থা নেয়ার সময় সতর্কভাবে চিন্তাভাবনা করা, পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন করে তারপর উপযুক্ত পথ-পন্থা বের করাই এখন জরুরি। সতর্কতা প্রয়োজন এ জন্য যে, দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শেষ করে দিয়ে গেছে পতিত সরকার। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর যে দায়িত্ব ছিল, সে কাজে এখন শূন্যের কোঠায় রয়েছে। আর এখন যেসব প্রতিষ্ঠান টিম টিম করে জ্বলছে, সেসব প্রদীপের নিচে এখন আরো বেশি অন্ধকার। সেখানে প্রদীপের অন্ধকারে বসে তারা কী অপকর্ম করছে, সেটি এই মুহূর্তে অস্বচ্ছ। প্রশাসনসহ বহু ক্ষেত্রে পতিত সরকারের প্রেতাত্মারা অনবরত ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দিকে নজর দেয়া জরুরি হবে। পতিত সরকার গত ১৬ বছরে বহু জঞ্জাল সৃষ্টি করে গেছে, আবর্জনার স্তূপ রেখে গেছে। এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করা এই মুহূর্তে খুব সহজ নয়।
গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের ধ্বংস করা সব প্রতিষ্ঠান সংস্কার মেরামতের কাজ শুরু করেছে প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। এসব নিয়ে পতিত আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের ইতোমধ্যে গা-জ্বালা শুরু হয়েছে। তাদের গা-জ্বালার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
তবে এটিও সত্য, সবকিছু মেরামতে অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন। মনে রাখাতে হবে, যেকোনো রাজনৈতিক সরকারকে দায়িত্ব পালনের সময় অনেকের সাথেই আপস ও বোঝাপড়া করতে হয়। দেয়া-নেয়ার প্রশ্ন থাকে। ফলে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে বহু সময় ক্ষেপণ হয়। বর্তমানে জনগণ যে সরকারের কাঁধে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তাদের পিছুটান নেই, তাদের এ জন্য কারো সাথে তেমন বোঝাপড়াও করতে হয় না। আর এসব বিষয়ে তাদের ভ্রুক্ষেপ করারও দরকার হয় না। সে জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণে তাদের তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়, তারা এখন দ্রুত একটা জায়গায় পৌঁছতে ‘ডন টু ডাস্ক’ কাজ করছে। সুপ্রিম কোর্টসহ বহু স্পর্শকাতর জায়গায় সংস্কার মেরামত চলছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটি কারো অজানা নয়। সেখানে দ্রুত নতুন বিন্যাস করা সম্ভব হয়েছে। এই বিন্যাস সবাইকে বিশেষ করে আইনাঙ্গনের মানুষজন এর ভূয়সী প্রশংসা করছে। এখানে একটা কথা মনে রাখা জরুরি, আর তা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে পুলিশ বাহিনী যে নির্মমতা দেখিয়েছে সেটি কোনোভাবে সভ্যতার মাপকাঠিতে পড়ে না। সে জন্য একে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
একই সাথে পুলিশের অসভ্য আচরণে যারা হতাহত হয়েছে, সেটি দ্রুত দেখা দরকার। অনেকেই বলেন, ‘স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইন দ্য রেস’। এটিও সত্য; কিন্তু বর্তমান সরকার ফাস্ট অ্যান্ড স্লোর সমন্বয়ের অপূর্ব একটি সুন্দর রসায়ন তৈরি করে কাজ করছে। তাদের ভালোভাবে কাজ করার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব এখন অনেকের ঘাড়ে। মনে রাখতে হবে, তারা ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন’ যে তাদের কোনো ক্যাডার আছে। তা ছাড়া তাদের কোনো উচ্চাভিলাষও নেই। তারা কেবল নির্ঝঞ্ঝাটভাবে কাজ করে জনগণের পছন্দের একটি রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বাড়ি ফিরবেন। তাদের বাড়ি ফেরার সময়টা অবশ্যই জনগণই ঠিক করে দেবে।
এ দিকে সরকারের সংস্কারের ক্যারাভান এগিয়ে যাচ্ছে বটে; কিন্তু ষড়যন্ত্রের তীর ছোড়া হচ্ছে, কেউ আবার দূর থেকে ভ্রুকুটিও করছে। অর্থাৎ সংস্কার আর ষড়যন্ত্র এখন সমান্তরালভাবে চলছে। ষড়যন্ত্র নানারূপে আত্মপ্রকাশ করছে। মিথ্যার চেয়ে অর্ধসত্য আরো বেশি ভয়ঙ্কর। অর্ধসত্য নিয়ে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে হতাশ ও হতবিহ্বল করার চেষ্টা চলছে অনবরত।
এ ক্ষেত্রে পুরো সত্য নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত ছিল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার। তাদের অনেকেই উপকৃত হয়েছেন বর্তমান নতুন ব্যবস্থাপনার জন্য। তারা উপকৃত হয়েছেন বটে; কিন্তু পরিবর্তনের এ কারিগরদের যেভাবে স্বাগত ও সহযোগিতা করার জন্য যতটুকু হাত প্রসারিত করার প্রয়োজন ছিল সে ক্ষেত্রে অনেকেই মনে করছেন, হয়তো কিছু ঘাটতি আছে। নিজেদের বোধ-বিবেচনার আলোকে সব মিডিয়াকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে ধারণ করা এবং নিজেদের স্থানটি সংরক্ষিত করার এখনই মাহেন্দ্রক্ষণ। অবশ্যই এটি কেবল মিডিয়ার দায় নয়, সব অংশীজনকে এ জন্য অবদান রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। তবে এই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কে কতটুকু পিছিয়ে বা অগ্রসর রয়েছে অবশ্যই সেটিও প্রমাণ করতে হবে মিডিয়াকে। এটি দায় না ভেবে দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করে অবদান রাখতে হবে। এই নতুন স্বাধীনতার ইতিহাস আগামী দিনে অবশ্যই রচিত হবে। সেখানে মিডিয়া যদি তার যথার্থ স্থানটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়, সেটিই হবে সাফল্যের বিষয়। নতুন দিন ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে মিডিয়ার এই যে অবদান সেটি হবে ঐতিহাসিক। আগামীতে যাতে এই অবদান ম্লান না হয়; বরং আরো উচ্চকিত করা যায়, সবার ভাবনায় তা অক্ষুণ্ন থাকুক। এটাই কাম্য।
ndigantababar@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা