২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সংবিধান সংস্কারে মত-দ্বিমত

সংবিধান সংস্কারে মত-দ্বিমত - নয়া দিগন্ত

চারদিকে এখন আলাপ শুধু সংস্কার নিয়ে। সংস্কারের বাংলা অর্থ- মেরামত, শুধরানো । আরেক অর্থ- ভালো করা বা ভালো হয়ে যাওয়া। বাংলা প্রবাদে বলা হয়ে থাকে- ভালো হতে পয়সা লাগে না। তা হলে কী লাগে? লাগে ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে হয়ে যায়? না, কখনো কখনো ইচ্ছা থাকলেও ভালো হওয়া যায় না। ভালো হওয়ার আর সময় থাকে না। মানে সুযোগ থাকে না। বহু বছর পর সেই সময়-সুযোগটা ধরা দিয়েছে।

গত এক মাসে যা ঘটেছে, তা ধারণা করাও কঠিন কারো কারো জন্য। কী থেকে কী হয়ে গেল! কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি শুরুতে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ও শান্তিপূর্ণ। তাদের দাবিগুলো ছিল একদিকে যৌক্তিক, আরেকদিকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে। তারা ক্ষমতার প্রার্থী ছিলেন না। সরকারের বিদায়ও চাননি। তারা চেয়েছিলেন শুধু কোটাপদ্ধতির সংস্কার। কোটার বিলুপ্তি নয়। সরকারের পক্ষে ওই দাবি মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু, সরকার তা কেবল অগ্রাহ্য করেনি; মারমুখী হয়ে হত্যা-দমন-পীড়নে ছাত্রদের প্রতিপক্ষ করে দিয়েছে। আর গোটা সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এর পর যা হওয়ার তাই হলো। নতুন করে বলার কিছু নেই।

বাংলাদেশের ইতিহাসে গণ আন্দোলন ও গণবিক্ষোভ অনেক হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো বলপ্রয়োগ ও মৃত্যু আগে কখনো ঘটেনি। এবার কেবল আন্দোলন সফল হয়নি, পুলিশ-সিভিল-আইনসহ প্রশাসনের দলবাজিসহ করুণ দুর্গতিও ধরা পড়েছে। ভয়াবহসব ঘটনা লুকানো বা আড়াল করা বা কোনো দোহাই দেয়ার সুযোগ নেই; বরং সুযোগ আছে শুধরানোর।
ছাত্ররা সুযোগটি এনে দিয়েছেন। গত ১৫ বছরে বিএনপিসহ বিরোধীরা বহু আন্দোলন করেও ক্ষমতাসীনদের টলাতে না পারলেও ছাত্ররা একটি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গও দাবানল সৃষ্টির মাধ্যমে তা পেরেছেন। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে ছাত্রদের আন্দোলনকে মূলধন করে। ছাত্ররা নিরপেক্ষ লোক হিসেবে বিশ্ববরেণ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে এসেছে। তার সামনে এখন অনেক দায়িত্ব।

গণ অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারা বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে শপথ নিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তী, মধ্যবর্তী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান না থাকলেও রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে এরকম একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ এমনকি সর্বোচ্চ আদালতও স্বীকৃতি দিয়েছেন। সদ্য পতিত হাসিনা দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছেন। এখন, সরকারে, শাসনে, ক্ষমতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্তূপীকৃত বিশাল জঞ্জাল সাফ করাই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব। এটি বিশাল সংস্কারকাজ। সেই সাথে নতুন কিছু গড়ার বিষয়ও আছে।

অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, শেখ হাসিনা পালিয়েছেন এবং জনগণ ছাত্রদের বৈধতা দিয়েছেন। এটি নির্বাচনের বিকল্প। এই বিকল্প সাময়িক। সময়টা কত দীর্ঘ হবে, তাও জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বেশির ভাগ জনগণের ইচ্ছা, আগের সরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, সেগুলোর ন্যূনতম মেরামত না হওয়া পর্যন্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না। নির্বাচনব্যবস্থা পরিপক্ব হওয়ার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। আবার ব্যবস্থা ঠিক হওয়ার পর অনেক দিন পর্যন্ত নির্বাচন করা না গেলে তার ফল শুভ হওয়ার লক্ষণ কম।

নির্বাচনের আগে কতটুকু সংস্কার করা যাবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নির্বাচন ও সংস্কার পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। সংস্কার না করলে নির্বাচন হবে না, আবার নির্বাচন না করলে সংস্কারের কর্তৃত্ব পাওয়া যাবে না। এখন তাহলে শুরুটা হবে কোত্থেকে? সংস্কারের শুরুটা আসলে হয়ে গেছে। আর সেটি হচ্ছে অনেকটা প্রশাসনকেন্দ্রিক। তাও অদলবদল। চিহ্নিত দুষ্টদের বাড়ি পাঠানো, আর নির্যাতিতদের দায়িত্বে বসানো। এটি আংশিক সংস্কার। গোটা রাষ্ট্রে সংস্কার দরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি সব জায়গায় জোরালোভাবে উঠছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সংবিধান সংস্কার। কয়েক দিন ধরে সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন করে লেখার বিষয়টি নিয়ে অ্যাকাডেমিক পরিসরে আলোচনা হচ্ছে।

মোটা দাগে কয়েকটি প্রশ্ন- সংবিধান কি চাইলে নতুন করে লেখা যায়? মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছিল, সেই সংবিধান এখন পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে কেন? দেশের মানুষ কি মনে করেন যে সংবিধান নতুন করে লেখা প্রয়োজন? সংবিধানের ঠিক কোথায় কোথায় পরিবর্তন প্রয়োজন এবং সেই পরিবর্তন বা সংশোধনে কি গণপরিষদ গঠন জরুরি? জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদে কি সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা সম্ভব নয়? এরকম হাজারো প্রশ্ন এখন জনমনে।

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারী তিন জোট সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্ত নেয় ভবিষ্যতে যতদিন প্রয়োজন নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যস্থতায় হবে। ১৯৯৬ সালে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান সংযোজন করা হয়। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের ওই সাংবিধানিক পরিবর্তন যত নষ্টের গোড়া। শেখ হাসিনার সর্বশেষ অপকর্ম ছিল নির্বাহী আদেশবলে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা। অবশ্য সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার সে প্রজ্ঞাপন বাতিল করেছে। আবার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তারা আমলে নেয়নি।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুধু সংবিধান বা এর সংস্কার নিয়ে বসে থাকার অবস্থা নেই। ভঙ্গুর অর্থনীতি, হাটবাজার, শিক্ষা, সব দিকেই কাজ করতে হচ্ছে। এ কাজগুলোও একেকটি সংস্কার। কিন্তু সংবিধান সংস্কার অনেকটা অ্যাকাডেমিক বিষয়। তার ওপর সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি জোরালো হচ্ছে কয়েকটি মহল থেকে। সংবিধানের পুনর্লিখন না করলে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সাফ করা যাবে না বলে মত তাদের।

রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের কাজ অবশ্যই জরুরি। নইলে রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঠাণ্ডা মাথায় ধ্বংস করা হয়েছে, সেগুলোকে কার্যকর করা খুব কঠিন কাজ। শুধু অন্তর্বর্তী সরকার সবকিছু করতে পারবে না। সেখানে আন্দোলনকারী, আন্দোলনের সমর্থকদের ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারপ্রধান হিসেবে একজন সর্বোচ্চ কত মেয়াদে থাকতে পারবেন, সে প্রশ্নও আছে। একই ব্যক্তি ‘দলীয় প্রধান, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়েও কথা আছে। ক্ষমতা যাতে এক হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সে তাগিদ অনেক দিনের। ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত করার এসব পথ সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে একজনের পর একজন স্বৈরাচার জন্মাতে থাকবে। সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া এ পথ বন্ধ করা যাবে না।’ এর বিপরীত মতে বলা হচ্ছে- সংবিধান পুনর্লিখন নয়; বরং দেশ ও জনগণের স্বার্থে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। এটি করবে নির্বাচিত সরকার।

খসড়ায় হোক আর পুনর্লিখনে হোক, সংবিধানের কয়েক জায়গায় পরিবর্তন-পরিমার্জন আনতে হবে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতিসহ আরো অনেক অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনা হলেও নতুন অনেক কিছু যুক্ত করা হয়। যেমন- ৭(ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ (৫০টির বেশি) অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণার এখতিয়ার কোনো সংসদের নেই। কেননা, পরবর্তী সংসদ যদি দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন করতে চায়, সে সুযোগ থাকা উচিত। একটি সংসদ আরেকটি সংসদের এখতিয়ার সীমিত বা সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে না।’

তা ছাড়া কোন সংশোধনীটি গৃহীত হবে কিংবা কোন সংশোধনীটি দেশ ও জনগণের জন্য প্রয়োজন- তা নিয়ে বিতর্ক করার মতো শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে থাকতে হয়। গত চার মেয়াদে সংসদে সেরকম কোনো বিরোধী দল ছিল না; বরং ছিল অনুগত বা আজ্ঞাবহ বিরোধী দল। আর সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে গঠিত সংসদের বিরোধী দল ছিল আরো বেশি দুর্বল। এরকম দুর্বল বিরোধী দলসংবলিত সংসদের সরকারি দল যা খুশি করতে পারে। সংবিধানকে নিজেদের ইচ্ছেমতো এবং নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষমতো সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারে। এসব করতে রাজনৈতিক বিরোধী দল জরুরি। এ সময়ে তার চেয়েও জরুরি প্রশাসন-পুলিশসহ বিভিন্ন সেক্টরে সময়োপযোগী মেরামত। সেই সাথে দেশে-দলে-সরকারে-সংসদে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার পথ বন্ধ করার একটি বন্দোবস্ত।

নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংবিধানের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন বা সংশোধন করা হবে, সে বিষয়ে একটি ঐকমত্য দরকার। সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যস্থতায় নির্বাচনের আগেও হতে পারে। কারণ সংস্কার বা মেরামত আরোপ করে হয় না। হওয়া উচিতও নয়। সঙ্গত কারণে আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক দিক থেকে জরুরি যে কাজ করা উচিত, তা হলো একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করা, যাতে কেউ পরবর্তীতে সরকার গঠন করে স্বৈরাচারী বা স্বেচ্ছাচারী হতে না পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement