১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
উৎসের উচ্চারণ

চীনা অর্থনীতি ও করব্যবস্থায় মুসলিম অবদান

চীনা অর্থনীতি ও করব্যবস্থায় মুসলিম অবদান - ছবি : সংগৃহীত

চীনের অর্থনীতি পুনর্গঠনে এবং কর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মুসলমানরা। ইসলামী বিশ্ব এবং চীনের মধ্যে অব্যাহত ঐতিহাসিক মিথস্ক্রিয়া সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বাণিজ্য সহজতর করে। জিনজিয়াং, নিংজিয়া, গানসুসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিকাশ ও ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলগুলো কৌশলগত অবস্থান এবং বাণিজ্য পথের কারণে চীনের অর্থনীতির কেন্দ্রও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মুসলিমদের অবদানের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলগুলো প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যা মৌলিকভাবে কয়েকটি বিশেষ খাতে প্রবাহিত হয়।

অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থা : সিল্ক রোড পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে পণ্য, ধারণা এবং প্রযুক্তির বাণিজ্যের চ্যানেল হিসেবে কাজ করেছিল। মুসলিম বণিকরা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছিলেন। প্রধানত চীন, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং এমনকি ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যের সুবিধা সম্প্রসারণে তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। তারা দূতের কাজ করতেন বিভিন্ন বাজারে ও ভাষায়। এ ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাণিজ্য নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপনে অবদান রাখে।

জিনজিয়াংয়ে ‘সুক’ নামে পরিচিত বাজারব্যবস্থার বিকাশ ঘটে মুসলিমদের হাতে। সুকগুলো মূলত আরবি সওক বা বাজারের অনুকরণ করত। যা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্রে পরিণত হয়। পোশাক, রেশম এবং চা থেকে শুরু করে মসলা এবং মূল্যবান ধাতুর মতো পণ্যের বিনিময়কে উৎসাহিত করে। মুসলিম ব্যবসায়ীরা চীনের বাজারকে সমৃদ্ধ করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে নতুন পণ্য ও উৎপাদন কৌশল প্রবর্তন করে।

বাণিজ্য নেটওয়ার্ক : ইসলামের আবির্ভাবের আগ থেকে আরব বণিকদের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন করে আসছিল চীন। ইসলামের আবির্ভাবের পরে সেই সম্পর্ক জোরদার হয়, প্রসারিত হয়। বিশেষ করে চীনের উপকূলীয় শহরগুলোতে বিপুল সংখ্যক আরব বণিকের আগমন নতুন গতি ও বিনিময়ধারা তৈরি করে। চীনে আরবদের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং তাদের দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা আস্থার পরিবেশ তৈরি করে। তাদের খ্যাতি কেবল জনসাধারণের মধ্যেই ছিল না; বরং ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। চীনের প্রশাসন তাদের বাণিজ্যিক দক্ষতা থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করেছিল এবং মুসলিম আইন অনুসারে মুসলিমদের পারস্পরিক অর্থনীতিকে বিকাশের অনুমতি দিয়েছিল। যা চীনে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বাণিজ্য নেটওয়ার্ককে প্রণোদিত করে। এই বৈশিষ্ট্যের যা কিছু চীনকে মুগ্ধ করল, তার আলোকে বাণিজ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হলো।

চীনা ঐতিহাসিকরা মুসলিমদের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য তৎকালীন চীনের ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টার বিবরণ দিয়েছেন। মুসলিম স্বর্ণযুগে আরবদের বাণিজ্য বহুজাতিক ও বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রক্রিয়াকে ড্রাইভিং করছিল। চীনের বাণিজ্য মুসলিমদের দূতিয়ালির মাধ্যমে সেকালের সবচেয়ে অগ্রসর বাণিজ্যধারাকে নিজের বাজারে নিয়ে আসে।

শ্রম ও শিল্প: চীনের মুসলমানরা দেশের শ্রমশক্তিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রেখেছেন, কৃষি, বস্ত্র, তাঁত এবং যন্ত্রনির্মাণ শিল্পের মতো নানা খাতে অংশগ্রহণ করেছেন। হুই মুসলিমরা ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের বিকাশকে পথ দেখান। তারা কার্পেট বুনন, মৃৎশিল্প এবং ধাতব কাজের সাথে জড়িত ছিলেন যুগ যুগ ধরে। এই শিল্পগুলো শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ভরণপোষণই দেয়নি; বরং চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। সমুদ্রতীরের বন্দরগুলোতে মুসলিম উদ্যোক্তারা জাহাজনির্মাণ শিল্পকে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি দিয়েছেন। সামুদ্রিক যাত্রার যন্ত্রপাতি ও শিল্পমান বৃদ্ধিতে আরব অভিজ্ঞতাকে তারা চীনে বিকশিত করেছেন।

জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমরা কৃষিকাজে নিয়োজিত থেকেছেন। বিশেষ করে তুলা উৎপাদনে তাদের অর্জন অগ্রগণ্য। চাষের কৌশলগুলোতে তাদের দক্ষতা এই অঞ্চলের কৃষি খাতের উন্নয়নে অবদান রেখেছে। শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে মুসলিমদের অব্যাহত অবদান তাদের বৃহত্তর চীনা অর্থনীতিতে আরও একীভূত করেছে। বাণিজ্য, অর্থ, শ্রম এবং শিল্পের মাধ্যমে মুসলিমরা যেমন চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন, তেমনি সামাজিক উন্নয়নে পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা।

ইসলামী অর্থ ও ব্যাংকিং : মুসলমানরা তাদের অর্থ ও ব্যাংকিং দক্ষতার মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিতে রাখেন মৌলিক অবদান। মুসলিমদের সাথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় লেনদেনে চীনের ব্যাংকব্যবস্থা নতুন যুগে প্রবেশ করে। আধুনিককালে ব্যাংক খাতে সেই প্রভাব নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থায় সুদমুক্ত ব্যাংকিং এবং নৈতিক বিনিয়োগে ইসলামী অর্থনৈতিক ধারা বরেণ্য অবস্থান লাভ করেছে। চীনে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো এই নীতিগুলো গ্রহণ করেছে, যার ফলে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিকল্প আর্থিক পরিষেবা দিয়েছে। যা সুদ পরিহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং অর্থনীতির ইসলামী নিয়মকে অঙ্গীকার করতে চায়।

চীনে ইসলামী অর্থের বিকাশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করেছে এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সামনে নৈতিক বিনিয়োগের জন্য নতুন উপায় উপস্থাপন করছে। এটি চীনের আর্থিক খাতের বহুমুখীকরণে অবদান রেখেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর আবেদন বাড়িয়েছে।

কর এবং রাজস্ব উৎপাদন : চীনা অর্থনীতিতে মুসলিমদের গভীর স্বাক্ষর দেখা যায় করব্যবস্থার সংস্কারে, বিদেশী বণিকদের ওপর আরোপিত শুল্ক রাজস্ব সংগ্রহে এবং বাণিজ্যিক ও আর্থিক বিষয়গুলোর সাথে সম্পর্কিত সংগঠন ও প্রশাসনে। যা প্রথমে ক্যান্টন শহরে বাস্তবায়িত হয় এবং তারপর কোয়ানঝো, ইয়াংজু, হাঙজুয়ের মতো অন্য শহরগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই বিভাগের কাজ ছিল আগত এবং বহির্গামী জাহাজগুলো পরিদর্শন করা। সব ধরনের আগত পণ্যের ওপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আদায় করা, পণ্যের ধরন ও মানের বিচারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা। সামুদ্রিক বাণিজ্যের অবস্থা ও রহস্য সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানসম্পন্ন একজন আরব বা ইরানি বণিক এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করতেন। অন্তত এ কাজের জন্য এমন কাউকে খোঁজা হতো, আরবদের সাথে যার ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘ ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা রয়েছে।

চীনের কর প্রশাসনে প্রভাবশালী ভূমিকার জন্য বিখ্যাত ছিলেন আবু আলি ইবরাহিম, যাকে চীনা সূত্রে ‘পু শো গিং’ বলা হয়। সম্ভবত তার হাত দিয়ে চীনে দু’টি শহরের জন্ম হয়।
কর প্রশাসনের ক্ষেত্রে ‘ইউয়ান’ রাজবংশের সময়কালে বহু মুসলিম নেতার নাম প্রসিদ্ধ হয়। রাজকীয় কোষাগারের প্রধান আবদুর রহমানের সততা ও দক্ষতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। সেকালের কোষাগারের প্রভাবশালী মুসলিম নামগুলো বিভিন্ন বই ও ঐতিহাসিক গবেষণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

১৩০২ খ্রিষ্টাব্দে ইউতেংয়ে রানীর মন্ত্রী হন কুতুব উদ্দীন। সাদুল্লাহ ছিলেন বিখ্যাত কবি, চীনে যিনি ‘তিয়ান শি’ বা ‘চি চাই’ বলে বিখ্যাত। তাকে জিনকাউ (বর্তমানে জিনজিয়াং) শহরের আবাসন ও পৌরসভার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং চীনা সূত্রগুলো তাকে সেই ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে, যিনি ‘বাজারগুলোকে সংগঠিত করেন এবং মান, পরিমাপ এবং স্কেল সেট করেন। ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থাপনাকে সংস্কার করেন এবং পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার আদর্শ হিসেবে বাজারগুলোকে গড়ে তোলেন।’ উন্নয়ন ও জনকল্যাণের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করেন তিনি। ১৩২৯ সালে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে, তখন সাদুল্লাহ শহরের গভর্নরকে গুদামে সব শস্য দিয়ে দেন। তার প্রদত্ত সাহায্যে আট লাখ মানুষকে অনাহার থেকে সুরক্ষা দেয়া হয়।
বস্তুত চীনের মুসলিম সম্প্রদায়গুলো সেখানকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মৌলিক অবদান রেখেছে। নাগরিক জীবন এবং অর্থনীতিতে অভিনেতা হিসেবে ভূমিকা রাখার শতাব্দীগুলোতে মুসলমানরা বাণিজ্যব্যবস্থাকে বহুমাত্রিকতা দেন। আয়কর, মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পত্তি করসহ বিভিন্ন করব্যবস্থার পুনর্গঠন করেন। তাদের অবদানগুলো সমাজের নানা ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বাক্ষর রাখে। সরকারি উদ্যোগ এবং জনসেবাগুলোকে গতিদান করে। যা সমগ্র জনগণের জন্য উপকার বয়ে আনে।

মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং ব্যবসায় থেকে জন্ম নেয় স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে বিপুল কর রাজস্ব। মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিনিয়োগের দ্বারা অবকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের অর্থায়ন সুগম হয়। একে সংগঠিত ও কল্যাণী প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নেয়ার পথ রচনায় কয়েকটি রাজবংশে মুসলিমরা রাখেন পথিকৃতের ভূমিকা।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement