১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩১ ভাদ্র ১৪৩১, ১১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

আন্দোলনে আগুন জ্বালানো সেই ঘোষণা

আন্দোলনে আগুন জ্বালানো সেই ঘোষণা - ছবি : সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নৃশংস পুলিশ যখন নিষ্ঠুর ও নির্মম কায়দায় নিরীহ নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সামরিক বাহিনী নামানো হলো হাসিনার নির্দেশে; দেশের সর্বত্র যখন চলছে লীগ নামক গুণ্ডা বাহিনীর নির্মমতা, ঠিক সে সময়ে সামরিক বাহিনীর অকুতোভয় নির্ভিক দেশপ্রেমিক কিছু অফিসারকে সাথে নিয়ে কর্নেল এম এ হক সামরিক বাহিনী ও অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে যে ঘোষণাটি পাঠ করলেন তা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। সামরিক বাহিনী ঘুরে দাঁড়াল মাফিয়া হাসিনার বিরুদ্ধে এবং অর্জিত হলো তৃতীয় স্বাধীনতা। সেই ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ :

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের আহ্বান
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আমরা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যগণ গভীরভাবে মর্মাহত ও হতাশ। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটা নীতি বাতিলের ন্যায্য দাবি নিয়ে গত ১ জুলাই থেকে কোমলমতি, নিরীহ, নিরস্ত্র শিক্ষার্থীগণ অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করলে দেশের অসংখ্য মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ করছি যে, সরকার তাদের সাথে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা না করে এ আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য হিংস্র রক্তাক্ত পথ বেছে নেয়। প্রথমে ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনীকে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর লেলিয়ে দেয়। তাদের বর্বরোচিত আক্রমণে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং অসংখ্য আন্দোলনকারীকে গুরুতর আহত ও গুম করা হয়। শুধু তা-ই নয় এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতিহত করতে বর্বর বাহিনীর সাথে যুক্ত হয় আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত বিজিবি, র্যাব, আনসার ও পুলিশের নির্বিচার আক্রমণ; ব্যবহার করা হয় হেলিকপ্টার ও স্নাইপার, যা যুদ্ধক্ষেত্রেও সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। এ আক্রমণ এতটাই বর্বর ও নৃশংস ছিল যে, হত্যার শিকার প্রতিটি মানুষের শরীর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায়, অন্ধ করা হয় বহু ব্যক্তিকে। এমনকি আক্রমণকারীরা হাসপাতালে গিয়েও গুরুতর আহতদের ওপর নির্মম আক্রমণ চালায় এবং চিকিৎসাবঞ্চিত করে, যা কোনো সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না।

নির্লজ্জতা ও নির্মতার এখানেই শেষ নয়; আন্দোলন দমাবার জন্য সরকার কারফিউ জারি করে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নামায় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে। লক্ষ করলাম, জাতিসঙ্ঘ মিশনে ব্যবহৃত এপিসি ও অন্যান্য অস্ত্র-সরঞ্জামাদিও ব্যবহার করা হয় শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বিরুদ্ধে। অতি উৎসাহী কিছু অফিসার বিবেক বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনরত মানুষের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে, যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। বহু ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে অর্জিত গৌরব ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় এর মাধ্যমে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের গৌরব আমাদের এ প্রাণের সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বর্তমান প্রজন্ম আমাদের অনুজ, আমাদের ছোট ভাইবোন ও সন্তান। তারা ইউনিফর্ম পরিধান করে বিধায় অনেক কিছুই খোলাখুলি বলতে পারে না। তাই অগ্রজ হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাদের গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা। সুতরাং আমরা জনগণের বিরুদ্ধে এসব হীন কাজ থেকে সামরিক বাহিনীকে বিরত রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই।

এত অল্প সময়ে নিজ দেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় অর্থে লালিত বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিশাল এ হতাহতের নজির বিগত এক শ’ বছরের ইতিহাসে এ দেশে তো বটেই, বিশ্বের কোথাও মিলবে না। এমন হত্যাকাণ্ডের নিন্দা বা ধিক্কার ও প্রতিবাদের উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। বিপুল এ প্রাণহানির দায় অবশ্যই সরকারের। সাংবিধানিক শপথ ও আইন উপেক্ষা করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রকাশ্যে চরম উসকানিমূলক দায়িত্বহীন ভাষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর তাদের লালিত গুণ্ডাবাহিনীকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দিলেন, এতে আমরা, সমগ্র জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হতবাক, স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও গভীরভাবে মর্মাহত। রাষ্ট্র যখন আক্রমণকারী হয়, জনগণ বিচার চাইবে কার কাছে।

আমরা মনে করি, সংবিধান অনুযায়ী বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু তা কোনোক্রমেই দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী হওয়া কাম্য নয় এবং যতক্ষণ সে দায়িত্ব জনবিরোধী পর্যায়ে না পড়ে শুধু ততক্ষণ সে দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। কিন্তু জনবিরোধী হওয়ার উপক্রম হলেই তা থেকে বিরত হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। এ বাহিনীর সব সদস্য এ দেশের সাধারণ জনগণেরই অংশ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ তথা দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ সেই নিরিখে অবৈধ ও জনবিরোধী। এমনকি যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে সে সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী ও একই সাথে ফৌজদারি অপরাধ।

বর্ণিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি, অবিলম্বে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে এই নিষ্ঠুর অপারেশন থেকে প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হোক। একই সাথে সামরিক বাহিনীর সকল অফিসার ও সৈনিকদের উপরোল্লিখিত কার্যকলাপ থেকে বিরত থেকে সংবিধানের মূল দাবি অনুযায়ী জনগণের পাশে থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, এখনো সময় আছে সামরিক বাহিনীর ঘুরে দাঁড়িয়ে এ কলঙ্ক মুছে দেয়ার। একই সাথে গণহত্যার সাথে জড়িত পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও গুণ্ডাবাহিনীর সদস্যদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করি, জনগণ এখনো সামরিক বাহিনীকে তাদের আশা ও ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচনা করে। সামরিক বাহিনী সদাচরণশীল হলে জনগণের সে আস্থা আবার ফিরে আসবে। তবে তা হতে হবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আগেই। সে নিশ্চয়তা আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে দিতে পারি। আমরা মনে করি দেশের মালিক জনগণ, কোনো ব্যক্তি নয়। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ সুবহানু ওয়াতায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমীন।

-দেশে বিদেশে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যগণ

লেখক : কলামিস্ট, রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক
Email: hoque2515@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল