২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পানি আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশ

পানি আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশ - ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের প্রতি দীর্ঘ দিন ধরে ভারত পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। আগামীতে এটিকে আরো বড় অস্ত্র বানাবে ভারত, এটি সহজে অনুমেয়। সুবিধামতো পানি আটকাবে, ছাড়বে। উজানের দেশ হওয়ায় পানির ওপর যথেচ্ছ খবরদারি করেছে দিল্লি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ভারতে এই অন্যায্য কায়কারবার ক্ষমতা সুসংহত করতে মুখবুজে সহ্য করেছে।

ভারত উজানে, বাংলাদেশ ভাটিতে। তাই বলে পানির মোড়লিপনা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা দেয় না। অতীতে বহু বছর ভারত পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো আইনের তোয়াক্কা না করলেও হাসিনা সরকার মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। তবে এবার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। পূর্ব সতর্কতা ছাড়া বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ এবার অন্তত কথা বলছে। আমাদের রাজনীতি নিয়ে ভারতের আধিপত্য এবার খাটেনি। তারা এবার আন্দোলন দমানোর কাজে সুবিধা করতে পারেনি। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট এবার যে মাত্রায় পৌঁছেছে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও তারা রক্ষা করতে পারেনি তাদের খাস লোক শেখ হাসিনাকে। পেরেছে তাকে আশ্রয় দিতে। আর জেদের মারে পানি ছেড়ে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের কোনো দেশ নদীর ওপর দেয়া বাঁধের গেট খুলে দেয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে ভাটির দেশকে জানানোর কথা। কিন্তু পূর্ব সতর্কতা ছাড়া ডুম্বুর ও কলসি বাঁধ খুলে দেয়া হয়। একপর্যায়ে ফারাক্কা বাঁধের বেশির ভাগ গেটও খুলে দিয়েছে। অনেকে বলাবলি করছেন, ঢাকায় পছন্দের সরকারের পতনের পর ভারত হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ উপলব্ধি করছেন ভারতের এ ভূমিকা প্রতিবেশীসুলভ নয়; অর্থাৎ তার সবশেষ শক্তির ব্যবহার করে অসহায়ত্ব আর ঢাকা রাখতে না পারার লক্ষণ।
আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে ৫৪টি নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো ও প্রত্যাহারের খবরদারি নয়াদিল্লি প্রতিষ্ঠা করেছে। সামনে আরো করবে। সেটি ধরে নিয়ে এখন এগোতে হবে বাংলাদেশকে। ভারত না চাইলে কখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে শেখ হাসিনাকে নামানো যাবে না- এই মিথ এবার খান খান করে দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; যা সিনেমার কাহিনীর থ্রিলকেও হার মানিয়েছে। একসময় তারা ভারতের পানি আগ্রাসন-পানি নৈরাজ্য ঠেকাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎপর হবে, সে আশাবাদ জাগায়।

শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে মরুকরণের ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে মারা ভারতের লুডু খেলার মতো। ভারতের এ পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার তাগিদ এখন বেশ জোরদার। মোক্ষম সময় যাকে বলে। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়িসহ আশপাশে অমানবিক অবস্থা গত ক’দিন শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হচ্ছে। সারা পৃথিবী নতুন করে জেনেছে বাংলাদেশীরা প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে চরম পানি আগ্রাসনের কী নির্মম শিকার হয়েছেন। আক্রান্ত জেলাগুলো উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বানভাসি মানুষকে উদ্ধার, নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া ও পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি বিভিন্ন মহলের।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় গোমতি জেলায় অবস্থিত গোমতি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডুম্বুর স্লুইস গেট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা এখন আর নালিশের বিষয় নয়। এটি তথ্য। পাল্টা তথ্য হিসেবে সেখানকার সরকার বলছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় গত তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কারণে এ অবস্থা। তা ছাড়া ভারত কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে জানিয়েছেন তারা ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেননি। পানির চাপ বেশি হওয়ায় বাঁধের কপাট নিজে নিজে খুলে গেছে! এ ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করার সময় তখন ছিল না। অজুহাত বা যুক্তি যা-ই হোক, আগে কখনো ভারত এ ধরনের জবাবদিহি বা অজুহাত দেয়ারও গরজ করেনি। ড্যামকেয়ার ভাব ছিল দিল্লির। এবার অন্তত অজুহাত হলেও দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কিছু দেয়া লাগতে পারে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বাঁধ দিতে যা করার দরকার তা করার একটি সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়েছে। তাদের ধারণা পাল্টা বাঁধ দেয়া হলে কখনো ভারতের সামনে আমাদের মাথা নত করতে হবে না; বরং ভারত আমাদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হবে। এ দাবি ও যুক্তির বাস্তবতা কতটা যৌক্তিক তা সময়সাপেক্ষ। সেন্টিমেন্ট যে তৈরি হয়েছে, এর একটি প্রভাব অবশ্যই না থেকে পারে না।

বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ হোক বললে বন্ধ হয় না। বন্যা থেকে সৃষ্ট নদীভাঙনের জন্য প্রতিবাদস্বরূপ তৈরি মানববন্ধন ও লেখা ব্যানারের ভাষা নদীগুলো পড়তে জানে না। নদীতীরের মানুষগুলোও সবাই সেটা বোঝে না। এজন্য রাষ্ট্রীয় কমিটমেন্ট কাজে লাগাতে হয়। এবার গোটা জাতি একাট্টা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আহ্বানে ১০ মিনিটে যে কোনো প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদ যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তাতে দেশে বিদেশে আমাদের আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন সমস্যার বৈষম্যগুলোর কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবী নতুন করে জেনে ফেলেছে আমরা বাংলাদেশীরা প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে চরম পানি আগ্রাসনের শিকার। এ পানিবৈষম্য আমাদের কৃষি, যোগাযোগ, মৎস্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুন্দরবন সব কিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আসছে। গত ৫২-৫৩ বছরে এসবের কড়া প্রতিবাদ হয়নি; বরং ভারতকে ক্ষেপানো যাবে না বলে জুজুর ভয় দেখানো হয়েছে। আর টানা কয়েক বছর ধরে এর উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে বিএনপিকে। বলা হয়েছে, ভারতকে চটানোর কারণে দুর্গতি পোহাতে হচ্ছে বিএনপিকে। ঢাকা সফরের সময় প্রণব মুখার্জির সাথে দেখা না করার মস্ত ভুলে কী নাস্তানাবুদ হয়েছে দলটি। আগামী ১০-১২ বছরের মধ্যে বিএনপি ‘নাই’ হয়ে যাবে- এমন জ্ঞানগর্ব যুক্তির বাজারও গরম করা হয়েছিল।

পানির চাপ অনেক বেশি হয়ে গেলে ভারত বাঁধের গেট খুলে পানি সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একতরফাভাবে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাঁধগুলো দিল্লি বানিয়ে রেখেছে। ভারত নিজেদের সুবিধা-অসুবিধা মতো বাঁধ খুলবে-আটকাবে। আমাদের নিম্নাঞ্চলে ফ্লাশ ফ্লাড হবে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে বিছানা পর্যন্ত পানি দেখব। জেগে ভারতকে ক’টা গাল দেবো। এতেই কি দায়িত্ব শেষ? এ চর্চার অবসানের আলামত এবার স্পষ্ট। প্রাণহানি, ভোগান্তি, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক বা মানবিক বিপর্যয়ের শিকারদের কাছে তা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। কুমিল্লা, ফেনী, বৃহত্তর নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলার মানুষ বন্যায় কী যে যাতনা সইছেন তারা জানেন।

বাতাস-পানি কখনো সীমানা মানে না। এদের আটকাতে বা ধাওয়াতে পাসপোর্ট ভিসা লাগে না। সুউচ্চ বা বিশাল দেয়াল দিয়েও তা রোখা যায় না। কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় মাত্র। কিন্তু যার বা যে দেশের কারণে এ অনাসৃষ্টি তাদের তো কঠিন বার্তা দেয়া যায়। নিজেদের প্রস্তুতিও নেয়া যায়। তা বুঝে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দফতরগুলোর সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তা জেনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশে রেসকিউ অপারেশন এবং ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড তৈরি হয়েছে এবার। একটু আত্মসমালোচনাও হচ্ছে। বন্যা মোকাবেলায় স্থায়ী ব্যবস্থা করার আলোচনা এবার বেশ চাঙ্গা। এই মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা থেকে বাঁচার বা ক্ষতি কমানোর কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয় আছে। সেটি নদী খনন হতে পারে, খাল খনন বা খাল উদ্ধার হতে পারে।

আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে ভারতকে শিক্ষাও দেয়া যেতে পারে। এগুলো কম কথা নয়। একসময় কল্পনাও করা যায়নি এ ধরনের সাহসী ভাবনার ফুসরত আছে। সেই সঙ্গে যত্রতত্র বাড়িঘর, রাজনৈতিক আশ্রয়ে অমানুষের অবিরাম নদী দখল, পানিপথ বন্ধ করে স্থাপনা নির্মাণ নিয়েও কথা হচ্ছে। নদীগুলোতে পরিকল্পিত খনন এবং দখল হওয়া জলাশয় ফিরিয়ে আনার বিষয়ও আলোচিত। এটি অবশ্যই ভালো লক্ষণ। বাকিটা নির্ভর করছে চলমান জাতীয় ঐক্য ও সেন্টিমেন্ট ধরে রাখা ও বাস্তবায়ন করা।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement