২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সুশাসন

নিরাপদ প্রস্থানে না গিয়ে কেন পলায়ন!

নিরাপদ প্রস্থানে না গিয়ে কেন পলায়ন! - ছবি : সংগৃহীত

লিগ্যাল ফ্রেইমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীন ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের ১৬০টিতে জয়লাভ করে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৩৮টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টু নেতৃত্বাধীন পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) ৮১টি আসনে জয়লাভ করে তথাকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ নির্বাচনটিতে আওয়ামী লীগ যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসনপ্রাপ্ত হয়নি অনুরূপ পিপিপিও পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসনপ্রাপ্ত হয়নি।

নির্বাচন-পরবর্তী সংসদের বৈঠক আহ্বান করলে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বৈঠকে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত অন্য সংসদ সদস্যদেরও সংসদের বৈঠকে অংশগ্রহণে বিরত থাকতে বলেন। এ জটিলতার অবসান না হলে তা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ লাভ করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইট নামক সেনা অভিযান পরিচালনা করলে আওয়ামী লীগ ও স্বাধিকারের সপক্ষের নেতাকর্মীদের বড় অংশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ড. কামাল হোসেন ভারতে না গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভ্যুদয় ঘটলে শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানের কারাগারের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। এর পরদিন শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন; যদিও মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারে রাষ্ট্রপতির পদটি তার জন্য নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল।

১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনটি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ায় বিপ্লবোত্তর স্বাধিকারের সপক্ষের সব দল সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের আবশ্যকতা থাকলেও আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করে। তৎপরবর্তী ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবৈধ দলীয় প্রভাব প্রয়োগে বিস্ময়করভাবে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে নিজেদের বিজয় হাসিল করে।

দেশ শাসন ও সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ ও এর শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান চরমভাবে ব্যর্থ হলে দ্রুত দলটির ও এর নেতার জনপ্রিয়তায় ব্যাপক হ্রাস ঘটে। এমতাবস্থায় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ-উত্তর শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে একদলীয় বাকশাল নামক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। বাকশাল প্রবর্তন-পরবর্তী সাত মাসের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমান তার মন্ত্রিসভার সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত সেনা বিপ্লবে নিহত হলে তা দেশের সাধারণ জনমানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে।

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর দলটি ক্ষমতার বাইরে ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয়ে থাকাকালীন দলটির ঐক্য অটুট রাখার প্রয়াসে তাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হলে তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে দিল্লি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ হাসিনা ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে অবস্থানকালীন সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিহত হন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহতের ঘটনায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা জঅড এবং বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাশাসক এইচএম এরশাদের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে জনমানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা বিরাজমান।
শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর প্রথমত স্বল্পসময়ের জন্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ দেশ শাসন করেন। এরপর প্রথমত জিয়াউর রহমান এবং তার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের শাসনকার্য পরিচালনা অন্তে সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরশাদের শাসনক্ষমতা গ্রহণকে আওয়ামী লীগ নিজেদের জন্য স্বস্তিদায়ক মনে করে আশান্বিত হয়েছিল। যাই হোক, এরশাদের অধীন তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপর বিরোধী দল বিএনপির সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ আশাহত হয়।

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হলে তিন-জোটের রূপরেখায় কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনটিতে আওয়ামী লীগের পরাজয় দলটি বিশেষত এর সভানেত্রীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও অবমাননাকর ছিল।
পঞ্চম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ উত্থাপিত রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত বিলটি সমর্থন করে বিএনপি চরম উদারতা প্রদর্শন করে। এর কিছুকাল পর থেকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে দেশব্যাপী ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে, একপর্যায়ে সম্মিলিতভাবে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। এ তিনটি দলের সংসদ থেকে পদত্যাগ-পরবর্তী ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হলে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ষষ্ঠ সংসদে বিএনপি তাদের বিরোধীদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রবর্তন করে।

ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না এমন রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসায় বাংলাদেশে একদা জনআকাক্সক্ষা ও জনঅভিপ্রায় এবং সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। এ ব্যবস্থায় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।

সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭-তে উন্নীত করলে নিজস্ব বলয়ের ব্যক্তিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগদান বিষয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। অতঃপর অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল তা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনবিষয়ক সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে গঠিত হওয়ায় এবং তৎপরবর্তী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিকভাবে গঠিত হওয়ায় উভয় সরকারের সিদ্ধতা নিয়ে সাংবিধানিক ও আইনগত বিতর্ক দেখা দেয়।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পেছনে নেপথ্য থেকে বাইরের শক্তি যে কলকাঠি নেড়েছিল তার সত্যতা ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি লিখিত ‘কোয়ালিশন ইয়ার্স’ পুস্তকে পাওয়া যায়। এ নির্বাচনটিতে বিজয়-পরবর্তী আওয়ামী লীগ প্রধান জনমত, জনদাবি ও জনআকাক্সক্ষাকে উপেক্ষা করে একান্ত হীন অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধীদলীয় মতকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় একতরফাভাবে একদা মীমাংসিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে পূর্বেকার বিতর্কের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এ ব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন যে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এর কোনোটিই সংবিধান ও আইনের বিধিবিধান অনুসরণ করে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এসব সংসদের নির্বাচন ও গঠন প্রক্রিয়া নানাবিধ প্রশ্নবাণে জর্জরিত। এ তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকা ছিল অসৎ উদ্দেশ্য পূরণে নীলনকশা বাস্তবায়নের সহায়ক।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানের প্রবর্তন রাষ্ট্রক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার অশুভ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অন্তর্নিহিত রহস্যের গহ্বরে লুকায়িত।

জনমত পৃথিবীর কোনো দেশেই স্থিতিশীল নয়। একটি সরকারের কার্যকলাপের ওপর জনমতের ওঠা-নামা চিরায়ত অমোঘ সত্য। দূরদর্শী রাজনীতিবিদ যারা নিজ দেশ ও দল, দেশের ভবিষ্যৎ, উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে ভাবেন তাদের নিকট সবসময় মুখ্য বিবেচিত জনমত ও জনআকাক্সক্ষার সপক্ষে অবস্থান। এ প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই যে, বিএনপির (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) অবস্থান নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে হলেও দলটির প্রধান বেগম খালেদা জিয়া জনমত ও জনআকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে একতরফা সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান প্রবর্তনপূর্বক ষষ্ঠ সংসদের অবলুপ্তির মাধ্যমে এ ব্যবস্থার অধীন সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

সপ্তম সংসদ নির্বাচনটি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ন্যায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল। এ নির্বাচনটিতে আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে নেপথ্যে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন ছিল অপর দিকে সপ্তম সংসদ নির্বাচন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী বিএনপি ক্ষমতাসীন ছিল।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদ ও তার দলের প্রার্থীদের জন্য প্রতিকূল ছিল। এরশাদ এ নির্বাচনটিতে কারা অভ্যন্তর থেকে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব ক’টি আসন থেকে জয়লাভ করে। এরশাদের শাসনামলের শেষ দিকে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ত্যাগে সম্মত হওয়া এরশাদ ও তার দলের জন্য নিরাপদ প্রস্থান (ঝধভব বীরঃ) ছিল। এ নিরাপদ প্রস্থানের কারণেই ক্ষমতা ত্যাগ-পরবর্তী দ্রুততম সময়ের মধ্যে এরশাদ ও তার দলের রাজনীতিতে পুনর্বাসন সম্ভব হয়েছিল। এরশাদের পতন-পরবর্তী অস্থায়ী সরকার তাকে গৃহবন্দী করে গুলশানের একটি অভিজাত বাড়িতে তার নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা করেছিল। এরশাদকে কারাগারের পরিবর্তে নিরাপদ হেফাজতে রাখা নিয়ে নির্বাচনে বিজীত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সংসদে বিএনপির বিরুদ্ধে তির্যক ও কটাক্ষপূর্ণ বক্তব্য ক্ষমতাসীন বিএনপিকে অস্থায়ী সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে এরশাদ বিষয়ে কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন-পূর্ববর্তী বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো তীব্র জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলে দেশকে সমূহ ক্ষতির সম্মুখে ফেলে দিয়েছিল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন ও সংসদের অবলুপ্তির মাধ্যমে সব দলের জন্য নবপ্রবর্তিত ব্যবস্থাটির অধীন নির্বাচনে অংশগ্রহণ দলটির প্রধান ও এর নেতাকর্মীদের জন্য নিরাপদ প্রস্থান ছিল। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সময়োচিত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও দলটি বিপর্যয় এড়িয়ে প্রত্যাশিত আসনের অধিক আসন লাভ করে সরকার গঠনের অনেকটা দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। এ নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতায় উপনীত হলে সরকার গঠনে সক্ষম হতো।

ক্ষমতা থেকে সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ অসাংবিধানিকভাবে ২০০৯ সাল থেকে জনমতের উপেক্ষা ও অবজ্ঞায় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের কৃপায় এবং দেশের অভ্যন্তরস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সহযোগিতায় দীর্ঘ ১৫ বছরের অধিক সময় চারটি কলুষিত ও নীলনকশার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে সক্ষম হলেও ছাত্র ও জনমানুষের আন্দোলন তীব্রতর হলে দলটির প্রধান শেখ হাসিনা আকস্মিক নিজ দলের নেতাকর্মীদের সমূহ বিপদের মধ্যে রেখে পদত্যাগ-পরবর্তী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে পলায়নপূর্বক নিজ ও তদভগ্নি অর্থলিপ্সু শেখ রেহানার জীবন রক্ষা করেন।

২০০৭-০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংসদ কর্তৃক বৈধতাপ্রাপ্ত না হওয়ায় এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী তিনটি যথাক্রমে- ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখীন। তা ছাড়া উপরিউক্ত তিনটি নির্বাচন সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা বিতর্কের আবর্তে নিপতিত। উপরোক্ত চারটি নির্বাচন বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংবিধানিক ও আইনগত অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় দলটির শীর্ষ প্রধানের উচিত ছিল জাতীয় পার্টি প্রধান এইচএম এরশাদ ও বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মতো সেফ এক্সিট নিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নিজেকে এবং নিজের দলকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে জাতীয় রাজনীতিতে সহনীয় অবস্থান গ্রহণ।
স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, আওয়ামী লীগ প্রধান ২০০৯-২৪ সালের মধ্যে এ দীর্ঘ পথযাত্রায় কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ ও পলায়নের পরিবর্তে রাজনীতির মাঠে দেশের অপরাপর দলের সাথে স্বঅবস্থান গ্রহণপূর্বক জনমানুষের সামনে আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে ভোটের মাঠে নিজেদের অবাধ বিচরণ সাবলীল করতে পারতেন।

অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, নির্বাচনবিষয়ক মীমাংসিত রাজনৈতিক বিরোধকে পুনঃবিরোধের আবর্তে ফেলে দেয়ার দায় একান্তভাবেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার। আর তাই অবশ্যসম্ভাবী বিপর্যয় থেকে নিজ ও দলকে রক্ষায় তার জন্য আবশ্যিক ছিল স্বেচ্ছায় পদত্যাগপূর্বক নির্দলীয় ব্যবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন। এ পথে অগ্রসর হতে গিয়ে তিনি অভিনবত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন।

আর তা হলো- আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন যা বর্তমানে সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টার ধরনের গণতন্ত্র অচল। এ ধরনের গণতন্ত্রে জনমত উপেক্ষিত হয় এ কারণে যে, মাত্র ২ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট মূল্যহীন। অপর দিকে আমাদের বর্তমান সংসদের প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসন বিবেচনায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রদত্ত ভোটের ১ শতাংশ ভোটপ্রাপ্ত দলের ভাগ্যেও তিনটি আসন জোটে। গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন-পরবর্তী অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচন ও ’৯৬-এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আন্দোলন-পরবর্তী একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে হলে উভয় দলের আসন সংখ্যাপ্রাপ্ত আসন থেকে অধিক হতো।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নিরাপদ প্রস্থানের দু’টি উদাহরণ সমুজ্জ্বল। এ দু’টি উদাহরণ উভয় দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপি প্রধান এবং তদ্বীয় দলের জন্য প্রতিকূল পরিবেশেও স্বস্তিকর। আওয়ামী লীগ প্রধান স্বীয় জেদ, একগুঁয়েমি, দম্ভ ও অহঙ্কারের কারণে তার পূর্বসূরি অপর দু’টি দলের প্রধানদের গ্রহণীয় পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজ ও দলের জন্য যে বিপর্যয় ডেকে এনেছেন তা থেকে উত্তরণ বোধ করি দুরূহ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement