২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আবু সাঈদ : বৈষম্যবিরোধী বীরশ্রেষ্ঠ

আবু সাঈদ - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের তরুণরা গত ৫ আগস্ট একটি সফল গণ-অভ্যুত্থান সম্পন্ন করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এমন গণ-অভ্যুত্থান বিরল। অবশ্যই এর সাথে আরো বেশ কিছু অনুঘটক যুক্ত রয়েছে, যেগুলো অভ্যুত্থানের ভূমি প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু এই ঘূর্ণিঝড়ের নিউক্লিয়াস ছিল তারুণ্য। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাগের বশে পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দেন। গত ৫ জুন সংক্ষুব্ধ দুই ছাত্রের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কোটা বাতিলের সেই আদেশ বাতিল করে দিলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেন। তারা কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানান। এ বিষয়ে সরকার আইনের মারপ্যাঁচে কথা বলতে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনে নামে। গত পয়লা জুলাই থেকে তারা মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলন চালাতে থাকে। তারা শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে। এ সময় আন্দোলন দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। দেশব্যাপী মহাসড়কগুলোতে অবরোধ পালিত হয়। এতে দেশবাসী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাপ বুঝতে পারে। এমতাবস্থায় হঠাৎ করেই ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে একজন মুখচেনা সাংবাদিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে কোটা সম্পর্কে এমন একটি প্রশ্ন করেন, যেটি ছিল স্পষ্টতই উদ্দেশ্যমূলক। প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী মেজাজ কঠিন করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিরা সরকারি চাকরি পাবে না তো রাজাকারের নাতিরা পাবে?’ রাজাকারের নাতি উচ্চারণ করায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অপমান বোধ করে।

রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যাপক প্রতিবাদ মিছিল হয়। ক্ষমতাসীন সরকার এবং দল এতে প্রচণ্ড প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ যথারীতি ভয়ঙ্করভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলে পড়ে। এমনকি ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে হামলায় আহত চিকিৎসারত ছাত্রদেরও হামলা করে। বেধড়ক প্রহার করে নারী শিক্ষার্থীদেরও। এসব হামলার ছবি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ক্ষোভ এতে বিক্ষোভে রূপ নেয়। শুরু হয় দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও।

১৬ জুলাই ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক মোড়ে অকুতোভয় ছাত্রনেতা অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ একাই পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান। তার হাতে ছিল সাধারণ লাঠি। কিন্তু পুলিশ এই নিরস্ত্র ছেলেটির বুকে কাছ থেকে গুলি চালায়। প্রথম দফা গুলিতে আবু সাঈদ শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেও সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় পুলিশ আবার তার বুকে গুলি চালায়। অসংখ্য বুলেটের আঘাত সইতে না পেরে আবু সাঈদ বসে পড়েন। বন্ধুরা তাকে হাসপাতালে নেয়ার পথে এই বীরশ্রেষ্ঠ শাহাদতবরণ করেন।

আবু সাঈদের মৃত্যুর ভিডিওচিত্র সাথে সাথেই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে। আবু সাঈদ শহীদ হন ঠিকই কিন্তু আন্দোলনের স্তূপিকৃত বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দেন। তার এভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার দৃশ্য দেখে দেশের শত শত ছাত্র রাস্তায় নেমে আসে। নিজেদের জীবন দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকে। আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড হাজারো অভিভাবক জনতাকে ব্যথিত করে। তারাও রাজপথে নেমে আসেন এই নৃশংস হত্যার প্রতিবাদ করতে।
আবু সাঈদের অপরাধ ছিল, তিনি ‘বৈষম্যের’ বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তার হাতে কোনো মারণাস্ত্র ছিল না। তিনি যুদ্ধ করতে বা কাউকে আঘাত করতে যাননি। তিনি শুধু বুঝাতে চাচ্ছিলেন ভয় দেখিয়ে ছাত্রসমাজের আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের অস্ত্রের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি সেদিনই বাংলাদেশের ইতিহাসে সুগভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে।

যুগে যুগে জালিম-স্বৈরাচারীর কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য এই ছবি অনাদিকাল পর্যন্ত নিষ্পেষিত নির্যাতিত মানুষকে উৎসাহ জোগাবে। ছাত্রদের জন্য এই ছবিটি হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার আদর্শের প্রতীক। বিশ্বের যেখানেই মানুষ শোষিত হবে, নিষ্পেষিত হবে, বৈষম্যের শিকার হবে সেখানেই আবু সাঈদের ছবি তাদের জাগিয়ে তুলবে, মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখাবে।

আবু সাঈদরা শুধু দেশের নয়, তারা বিশ্বমানবতার সম্পদ। দেশে তো বটেই বিশ্বজুড়ে কবি-সাহিত্যিকরা আবু সাঈদকে নিয়ে কাব্য, সাহিত্য, প্রবন্ধ আর উপন্যাস রচনার রসদ পাবেন যুগে যুগে। রাজনীতিকরা আশান্বিত হবেন, স্বপ্ন দেখাতে পারবেন নির্যাতিত মানুষকে। ঐতিহাসিকরা একদিন তাকে ঘিরেই রচনা করবেন ইতিহাসগাঁথা। বিপ্লবীরা প্রেরণা পাবেন মানুষের কল্যাণের জন্য, মানবতার মুক্তির জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে। স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য আবু সাঈদকে ‘কিংবদন্তি’ হিসেবে দেখবেন।

অভ্যুত্থানের পর দেশে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে ছাত্ররা আবারো গর্জে ওঠে আন্দোলনের হুমকি দেয়। সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা আসে। আবার সাবেক বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ফুলকোর্ট মিটিং ডেকে ষড়যন্ত্রমূলক জুডিশিয়াল ক্যুর স্বপ্ন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ ঘেরাও করে ভেঙে দেয় ছাত্ররা। এভাবে তারা আবু সাঈদদের রক্তের ঋণ পরিশোধের প্রত্যয়ে দেশ গঠনের কাজে নিজেদেরকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রেখেছে।

১৬ জুলাই আবু সাঈদ ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রামে আরো পাঁচজন নিহত হয়েছিল পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে। ফলে ১৭ তারিখে আন্দোলন সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। তাদের প্রতিরোধে সরকারও সর্বশক্তি নিয়োগ করে। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, ছাত্রলীগ-যুবলীগ একযোগে শক্তি প্রয়োগে মেতে ওঠে। নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় আন্দোলন দমাতে। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হয়। ফলে রাজধানীতে বাসার ছাদে, ছয়তলার বারান্দায় এমনকি ঘরের ভেতরে গুলির আঘাতে নারী-শিশুর মৃত্যু ঘটে। এরপর ২০ জুলাই সেনাবাহিনী নামিয়ে এবং কারফিউ জারি করে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলে।

২২ জুলাই থেকে পরিস্থিতি বাহ্যত শান্ত দেখা যাচ্ছিল। চারদিকে বিভিন্ন বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। জুলাইয়ের শেষ দিকে জানা যায়, আবু সাঈদ হত্যা মামলার এফআইআরে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের নিক্ষিপ্ত ইটের আঘাতে তিনি নিহত হয়েছেন। এ মামলায় রংপুরের এক স্কুলছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এত বড় মিথ্যাচার, বর্বরতা ছাত্র-জনতা নিতে পারেনি। পয়লা আগস্ট থেকে আবারো আন্দোলন শুরু হয়। চূূড়ান্তভাবে অনেক রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের মাধ্যমে সফলতা লাভ করে।

দরিদ্র পরিবারের সন্তান আবু সাঈদ খেয়ে না খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের স্বপ্ন দেখছিলেন। বড় বোনকে আশা দিয়েছিলেন ‘বিসিএস’ করে একদিন অফিসার হবেন। দরিদ্র বাবা-মা, বড় ভাইবোন সবাই স্বপ্নের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের গুলির আঘাতে পরিবারটির স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে চুরমার হয়ে গেল। আবু সাঈদের কাজ সম্পন্ন করতে অনেক দূর হাঁটতে হবে। বিপ্লবকে পাহারা দিয়ে দেশ গঠনে সবাইকে একেকজন আবু সাঈদ হতে হবে। ন্যায়ের ঝাণ্ডা সমুন্নত রেখে সামনে এগোতে হবে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement