অন্তর্বর্তী সরকার, চ্যালেঞ্জ ও হুমকি
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০৬:২৬
নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পুলিশ বাহিনীর নির্বিকার আচরণ, বিরূপ সিভিল প্রশাসন, ১৫ বছরের বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বঞ্চনা নিরসনের আবেদন ইত্যাদি। মানুষের নিন্দিত পুলিশ বাহিনী, গ্রামপুলিশ, আনসার-ভিডিপির সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের দাবির সাথে যোগ হয়েছে এইচএসসির পরীক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশনের দাবি। দাবিদাররা ভুলে গেছেন, তাদের পুঞ্জীভূত ১৬ বছরের জঞ্জাল মুহূর্তেই সমাধানযোগ্য নয়। তারা এও ভুলে গেছেন, ছাত্রদের আন্দোলন সফল না হলে আরো অনেক বছর তাদের বঞ্চনা সহ্য করতে হতো। যেভাবে দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে মনে হয় দেশের প্রতিটি সেক্টর দাবি আদায়ে মাঠে নামবে। তারা ভুলে গেছে, এ সরকার অন্তর্বর্তীকালীন। এই সরকারের অন্যতম কাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশটির প্রয়োজনীয় পুনর্গঠন ও সংস্কার করে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পথ করে দেয়া।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয় একটি সম্পূর্ণ হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে, যখন দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। স্বৈরাচারের উচ্ছিষ্টভোগী বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের ষড়যন্ত্র, দেশব্যাপী তাদের দলীয় ক্যাডার, সন্ত্রাসী বাহিনী, যাদের অনেকের হাতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের দেশী-বিদেশী প্রচলিত অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র। ওই দলীয় ক্যাডারদের সাথে যোগ হচ্ছে পলাতক প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরা।
দেশীয় সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতায় এনে অবৈধভাবে ১৬ বছর টিকিয়ে রাখা আওয়ামী সরকারের বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র। যারা আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় রাখার বিনিময়ে এমন কোনো সুবিধা নেই যা নেয়নি। এ ছাড়াও, লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিকের এ দেশে চাকরির আয় ভারতকে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশে পরিণত করেছে। অবাধে বাংলাদেশের সমুদ্র পোর্ট ব্যবহার এবং সড়কপথে তাদের মূল ভূখণ্ড থেকে বলতে গেলে বিনা মাশুলে পূর্বাঞ্চলে মালামাল পরিবহন করে। কেবল বাকি ছিল দেশের সার্বভৌমত্বটুকু ধ্বংস করে তাদের সেভেন সিস্টার রক্ষার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা।
স্বৈরাচারের দোসর ভারতীয় সরকার কোনোভাবেই বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না। ফলে এক দিকে তারা তাদের অনুগত এ দেশীয় অনুচরদের দিয়ে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে, পাশাপাশি নিজেরাও বিভিন্নরকম অন্যায্য ও অগ্রহণযোগ্য হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের পূর্ব সতর্কতা ছাড়া, রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন বাঁধের সব গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দিয়ে তাদের রাগ কিছুটা প্রমশিত করার চেষ্টা করেছে।
বিতাড়িত স্বৈরশাসককে আশ্রয় দিয়ে তারা আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন করে যেন বাংলাদেশের ওপর তাদের দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের বীজ নতুন করে বপন করছে। স্বৈরাচারী হাসিনা এ দেশে তাদের রেখে যাওয়া অনুচরদের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের মিথ্যা অপপ্রচার সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া তারই অংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণতার সাথে বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে ও সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে সক্ষম হন। সাথে এ দেশের আপামর জনসাধারণ হিন্দু জনগণ ও তাদের মন্দির পাহারা দেয়ার কাজ করেছে। তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, হিন্দু নির্যাতনের খবর সম্পূর্ণ অসত্য।
আমলারা সবসময় সব সরকারের সুবিধাভোগী। তারা সরকারের পরিবর্তনের সাথে রূপ বদলায়। একই কথা প্রযোজ্য পুলিশ প্রশাসনের ক্ষেত্রেও। সুতরাং স্বৈরাচারের পছন্দের কোনো আমলা বা পুলিশকে স্পর্শকাতর দায়িত্বে না রাখাই ভালো। ১৬ বছরের সুবিধা বঞ্চিতরা এত বছরের পুঞ্জীভূত এবং শত শত মানুষের বঞ্চনার প্রতিদান এত দ্রুত আশা করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে নতুন সরকারের ওপর জুলুম হয়ে যাবে। এদের নৈরাজ্যের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় এই সরকারের সব সংস্কার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। তাদের প্রত্যাশা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা। এর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা দরকার। ইতোমধ্যে অনেকটাই ফিরেছে। বাকিটাও আসবে। এর জন্য স্বৈরশাসকের সুবিধাভোগী এবং মানসিকভাবে স্বৈরাচারীর দোসর বনে যাওয়া পুলিশদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে যেন ভবিষ্যতে কেউ এমনটি না করে। বাকি পুলিশদের প্রশিক্ষণ এবং মোটিভেশন দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। আন্দোলনে বিজয়ীদের দায়িত্ব হচ্ছে দেশটাকে পরিচালনা করতে সহযোগিতা করা।
দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি মেরামত করা একটি চ্যালেঞ্জ। ১৬ বছরে ধ্বংস করা অর্থনীতি মেরামত করতে অনেক সময় লাগবে, তবে এখনই নজর দিতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। দুর্নীতিবাজদের ব্যাংকে এবং ব্যাংকের বাইরে গচ্ছিত অর্থ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সরকারের কোষাগারে ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশে উৎপাদিত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সাপ্লাই চেন মেরামত করা জরুরি। উৎপাদিত পণ্য কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে যে চাঁদাবাজি হয় তা বন্ধ করে এবং সিন্ডিকেট কঠোর হস্তে দমন করে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনা, আরো অনেক প্রশিক্ষিত রেমিট্যান্স যোদ্ধা বিদেশে পাঠানো দরকার। সর্বোপরি একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করে দীর্ঘমেয়াদে দেশের এই ভঙ্গুর সেক্টর মেরামত করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংকিং সেক্টর পুনর্গঠনে হাত দিয়েছে। সৎ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ মালিকদের দিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং তার চেয়েও যোগ্য লোকদের দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ রেগুলেটরি বডি মেরামত করতে হবে। স্বৈরাচার ও তার দোসরদের দখলকৃত ব্যাংকগুলোকে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। দুর্বল ব্যাংক বন্ধ অথবা একীভূত করে মোট ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে এনে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা কমাতে হবে। স্টক মার্কেট, বন্ড মার্কেট, ইন্স্যুরেন্স সেক্টরের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নিতে হবে।
মাত্র শ’খানেক বড় বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরি করে দেশটা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কেবল ব্যবসাই করছে না বরং টাকার জোরে এমপি, মন্ত্রী হচ্ছে, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে দেশের গডফাদারে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের কেবল ব্যবসায় মনোনিবেশ করার মতো আইন প্রণয়নের কথা ভাবা যায়।
বর্তমান সরকারের জন্য একটি থ্রেট হলো বিতাড়িত স্বৈরাচারী সরকারের রাষ্ট্রপতি এখনো বহাল। তার অধীনে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা ষড়যন্ত্র করছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়াচ্ছে। এখনই একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করা দরকার।
উল্লেখ্য, সংবিধান যারা রচনা করেন তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত, সুতরাং সেই জনগণের সরাসরি মতামতই এখন সংবিধান। সংবিধান মানুষের জন্য, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। অতএব গণ-আন্দোলনে গঠিত সরকারের সংবিধানের তেমন পরোয়া করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। এর আগেও ১৯৯০ সালে আর এক স্বৈরাচার হটিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল যাদের সব কাজ পরবর্তীতে নির্বাচিত সংসদ বৈধতা দিয়েছিল।
উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের সংস্কারের জন্য সরকারকে একটি মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সরকার গণ-আন্দোলনে গড়া সরকার। এই গণ-আন্দোলন কোনো দলীয় কাঠামোয় হয়নি। গণবিপ্লবের ভিত্তি স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি ক্ষোভ এবং ঘৃণা, তরুণ মনোভাবের আবেগ ও দেশের প্রতি ভালোবাসা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংজ্ঞায়িত করা দরকার। কারণ দীর্ঘদিন ছাত্রদের বিভিন্ন অফিস আদালতে হস্তক্ষেপ কাম্য নয়; তা ছাড়া ছাত্রদের মধ্যেও সুবিধার অন্তর্কলহ শুরু হতে পারে। ফলে এ ধরনের সরকারের টিকে থাকা কঠিন হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব মূলত দীর্ঘদিন দেশ চালানো নয়। বরং ভঙ্গুর দেশটির মেরামত ও সংস্কার করার পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ কাজের জন্য যৌক্তিক যতটুকু সময় দরকার ততটুকু সময় দেশপ্রিয় জনগণ দিতে প্রস্তুত।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা