১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১, ১০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

স্বয়ম্ভর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্তরায় : বন্যার রাজনৈতিক অর্থনীতি

স্বয়ম্ভর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্তরায় : বন্যার রাজনৈতিক অর্থনীতি - নয়া দিগন্ত

নিজের ভালো-মন্দ নিজেকে বুঝতে হয়। তীব্র প্রতিযোগিতার বিশ্বে যার যার অবস্থানে নিজেকে স্বাবলম্বী-স্বয়ম্ভর করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। স্বয়ম্ভর-স্বাবলম্বী হওয়ার পথে কাছের কিবা দূরের ভূরাজনৈতিক শক্তি বিভিন্ন কূটকৌশলে ঠক্কর দেবে। এটি ধ্রুব সত্য যে, নিজের আত্মরক্ষার, উন্নতির অধিকার ও দায়িত্ব যার যার তার তার। কেউ কাউকে হেনস্তা করে, দুর্বল করে তার কাছ থেকে ফায়দা লুটবে- এটি তার স্বভাবধর্ম। অপরপক্ষেরও দায়িত্ব এ হেনস্তা হওয়ার কারণ সৃষ্টি যাতে না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। এটি তারও স্বভাবধর্ম হওয়া উচিত। দেহ মন শরীরে নানান রোগ বাসা বাঁধে নিজের অসচেতনতা অযত্ন ও স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে অবহেলার কারণে। এখানে রোগকে দোষারোপ করে পার পাওয়ার উপায় নেই, নিজেকে রোগমুক্ত রাখায় নিজের ভূমিকার মূল্যায়ন জরুরি। ‘চোর চুরি করবে, কিন্তু গৃহস্থকে সজাগ থাকতে হবে’ এটি একটি ব্রিটিশ ডকট্রিন। ভারতে ব্রিটিশ জাতি ১৯০ বছর শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিবরে রাজত্ব চালিয়ে যেতে পেরেছিল। সে সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল গৃহস্থের সজাগ দৃষ্টি।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বেঙ্গল দেহেও দুই, অন্তরেও দুই। এপার বাংলা ও ওপার বাংলার নামনিশানা তো তৈরি করে দিয়ে গেছে সেই সাবেক ব্রিটিশ সরকার। উদ্দেশ্য এ দেহ ও অন্তরে দুই বাংলা যত দূরত্বে থাকবে তত উভয়ে হিংসার ও সঙ্কটে বসবাস করতে থাকবে। ক্ষুরধার লেখনীর লেখক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, দুই বাংলা মুদ্দতে টাওয়ার বাংলা (পশ্চিমবঙ্গ, যা ভারতের মধ্যে লীন হয়ে নির্বাণ লাভে লালায়িত) আর খামার বাংলা (পূর্ববঙ্গ বা বর্তমানের বাংলাদেশ, যা বরাবর নিজের কর্মফল ভোগ ও ভোগার জন্য ৫৩ বছর আগে স্বাধীন হয়েছে)। ইতিহাসের পাতায় পাই, টাওয়ার বাংলা শিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে খামার বাংলার কৃষির অবদানে। ১৯৪৭-এ ভারত ভাগের আগ পর্যন্ত খামার বাংলা টাওয়ার বাংলাকে দিত পাট ও ধান আর টাওয়ার বাংলা খামার বাংলাকে দিত আর্ট ও গান। রাজনৈতিক ভাগ-বাঁটোয়ারার পর টাওয়ার বাংলা ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি গ্রীষ্মে আটকিয়ে আর বর্ষায় গেট খুলে অকস্মাৎ বন্যার ব্যাঘাত সৃষ্টি করে খামার বাংলার পাট ও ধানের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত করে জীবন-জীবিকাকে বিপন্ন করে চলছে। পক্ষান্তরে, টাওয়ার বাংলা তার আর্ট ও গানের ধারা আরো প্রসারিত করে খামার বাংলার ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা ও ঐক্যবদ্ধতার বিপক্ষে যেতে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট পয়মাল করছে।

সুযোগসন্ধানীরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। উজানের দেশ অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানি উজানে অন্যত্র সরিয়ে গায়ের জোরে অসম ব্যবহার করছে, করবে। এ ব্যাপারে ভাটির দেশের পক্ষে ন্যূনতম প্রতিবাদ করার অধিকারটুকুও উজানের দেশের কাছে বন্ধক দিতে পানি চুক্তি করে বরং নিজের আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিচার চাওয়ার, মধ্যস্থতার আহ্বান- অধিকারকে বিসর্জন দেয়া হয়েছে।

১৯৭৬ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ‘ফারাক্কা অভিমুখে রোড মার্চ’ ব্যতীত বাংলাদেশ বিগত ৫৩ বছরে পানি পাওয়ার ও বন্যা ঠেকানোর ব্যাপারে আত্মসচেতন নয়ই, এমনকি দাবি করতে সোচ্চার হয়নি, সোচ্চার হয়নি সমতার ভিত্তিতে পানির ন্যায্য হিস্যা চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে। ভাটির দেশ ‘সম্পর্ক উত্তরোত্তর উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার’ সম্মোহিত অবস্থায় থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অধিকার হাওয়া হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অধিকার সমতার ভিত্তিতে বিভাজিত না হয়ে পানি রাজনীতিতে নেতিবাচক আবহ তৈরি হওয়াতে ভাটির দেশের কৃষি অর্থনীতি, জীবন ও জীবিকায়, প্রাকৃতিক সুরক্ষা সুন্দরবনের সমূহ ক্ষতিসাধন আজ বেপরোয়া মোড় নিয়েছে।

অথচ একই সমতলে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিন্ধু অববাহিকা ঘিরে হওয়া পানির হিস্যাটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো ও দীর্ঘ সময় ধরে চালু থাকা আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন চুক্তি। ‘ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি’ বা সিন্ধু পানি চুক্তি নামে পরিচিত সমঝোতাটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল বিশ্বব্যাংক। প্রসঙ্গত, একই সময়ে ভারতের গঙ্গা নদীর ওপর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে ফারাক্কায় পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ভারত।

পাকিস্তানের সাথে ভারতের পানিবণ্টন চুক্তির দর কষাকষির বা বাধ্যবাধকতার আলোকে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করতে পারেনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ায় ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সুযোগ পায়। ১৯৭২ সালের মার্চে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা এবং শান্তি চুক্তি’ সই হয়। এ চুক্তি অনুসারে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় গঠিত হয় যৌথ নদী রক্ষা কমিশন (জেআরসি)। ইতোমধ্যে ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টন নিশ্চিতে এ কমিশন তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি। লক্ষণীয় যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তিটি শক্তিশালী করেছে বিশ্বব্যাংকের উপস্থিতি। আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাটি যুক্ত থাকায় ভারত বা পাকিস্তান কেউ এ চুক্তি উপেক্ষা করে কোনো কাজ করতে পারে না। যেকোনো কাজের আগে অপর দেশকে অবগত করতে হচ্ছে এবং কোনো বিষয় নিয়ে দ্বিমত দেখা দিলে তা সমাধানে নিতে হচ্ছে উদ্যোগ।

অপর দিকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার নদীগুলো ব্যবস্থাপনায় ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন করা হয়। দুই দেশের মধ্যে মোট নদী ৫৪টি। সেচ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এসব নদীর পানিসম্পদ ভাগাভাগির মতো বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান ছিল কাম্য। জেআরসির কার্যপদ্ধতি অনুযায়ী বছরে চারটি সভা করার কথা ছিল। সে হিসাবে অর্থাৎ ৫২ বছরে ২০৮টি জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু বাস্তবে কমিশন আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে কেবল ৩৮টি সভা। ৫২ বছরে এ কমিশনের তথাকথিত সাফল্য বলতে শুধু গঙ্গা চুক্তি।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তি সই করেন। এ চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের ন্যায্যভাবে পানি ভাগ করে নেয়ার কথা ছিল। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর রাজশাহী অঞ্চলে পানি সঙ্কট এবং নদী শুকিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের সাথে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে আগে যেখানে নদী ছিল সেখানে এখন বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চাষাবাদ হয়। এছাড়া ২০২৬ সালে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। সম্প্রতি এ চুক্তি নবায়নের বিষয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন, যা এ চুক্তির ভবিষ্যৎও শঙ্কায় ফেলেছে।

বণিক বার্তায় গত পরশু প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে একটি স্বল্পমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ২০১১ সালে ১৫ বছরের জন্য তিস্তা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার জেরে চুক্তিটি স্থগিত হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত বিষয়টি সমাধানে আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি কমিশন। ফেনী, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিবণ্টনের জন্যও ১৯৯৭ সালে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তবে ২৭ বছরে এ কার্যক্রমও কেবল সচিব পর্যায়ে আলোচনা ও ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নে সীমাবদ্ধ। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা স্মরণকালের মধ্যে সেরা বন্যাকবলিত।

এ ব্যাপারে পানি বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হলো- ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিবেশী হিসেবে যেমন সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটিও নেই। যেকোনো পারস্পরিক সম্পর্কে একটি রাষ্ট্রের দু’টি বিষয় লক্ষ রাখা উচিত। প্রথমটি হলো তার ডিগনিটি এবং দ্বিতীয়টি রাষ্ট্র তথা জনকল্যাণ। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে এ বিষয়গুলোর ঘাটতি ছিল বাংলাদেশের দিক থেকে। যেমন কোনো যৌথ নদীতে কোনো দেশ একক সিদ্ধান্তে বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না, অপর দেশের অনুমতি নিতে হয়। আবার বাঁধ নির্মাণের পরও নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করতে হয়। বাঁধ খুলে দেয়ার আগে জানাতে হয়। কিন্তু ভারত এগুলো মান্য করেনি। বাংলাদেশও গত ১৫ বছরে এসবের কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।’

এমন পরিস্থিতিতে নদীগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ বিশ^ব্যাংক বা জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা নিতে পারে। তবে তার জন্য বাংলাদেশকে আগে জাতিসঙ্ঘের পলিসির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। তাকে ইউএন ওয়াটার কোর্সেস কনভেনশনে স্বাক্ষর করতে হবে। তখন এ ধরনের বিষয়গুলোয় জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা নেয়া যাবে এবং কোনো দেশের সাথে চুক্তি হলে দেশগুলো সেটি মেনে না চললে বা কোনো চুক্তি ভঙ্গ করলে জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা নেয়া যাবে।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যরা গাঢাকা দিয়েছেন কক্সবাজারে পাহাড়ধসে ৬ জনের মৃত্যু, ২৪ ঘণ্টায় ৫০১ মি.মি. বৃষ্টি সুপরিকল্পিতভাবে ঐক্য বিনষ্টের চেষ্টা চলছে : মির্জা ফখরুল ড. ইউনূসের মেগাফোন কূটনীতিতে বিস্মিত বিরক্ত ভারত বাম চোখে কিছু দেখেন না বেলাল, গুলি একটা রয়েই গেছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল আজ ঢাকা আসছে গাজায় ইসরাইলি হামলায় আরো ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত আমদানির প্রভাব পড়েনি ডিমের বাজারে বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে মাছ-সবজি সিন্ডিকেটের কবলে তাঁতবোর্ড প্রাথমিক তদন্তে সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে মামলা থেকে নাম বাদ হবে ইউক্রেন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করলে যুদ্ধে জড়াবে পশ্চিম : পুতিন

সকল